ফুড বেনিফিটস I যষ্টিমধু
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। বিশেষত কণ্ঠ পরিচর্যায় এটি কার্যকর। তা ছাড়া অনেক ব্যাধির উপশম ঘটায়
গ্লাইসাইররিজা গ্লাবরা গাছের শিকড় মিষ্টি স্বাদের। এই বৃক্ষমূল বাংলায় যষ্টিমধু নামে পরিচিত। একটি ভেষজ। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এর ব্যবহার বিস্তর। শিকড়ের প্রধান ঔষধি উপাদান ট্রাই-টারপিনয়েড স্যাপোনিন গ্লিসাইরিজিন। তা ছাড়া আছে ফরমোনোনেটিন, গ্ল্যাবরোন, নিওলিকুইরিটিন, হিসপা-গ্ল্যাবরিডিন এ ও বি নামে আইসোফাবন; গ্লাবরানিন এ ও বি, গ্লিসাইরেটল, গ্ল্যাবরোলাইড, আইসোগ্ল্যারোলাইড নামের ট্রাই-টারপিনয়েড স্যাপোনিন; হারনিয়ারিন, আম্বিলিফেরন নামের কৌমারিন এবং আনোসেরিন, এমাইরিন, স্টিগমাস্টেরল নামের ট্রাই-টারপিন স্টেরল। এসব উপাদান নানান রোগের পথ্য। যেমন যষ্টিমধু আলসার সারাইয়ে সক্ষম। তা ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত। এর গ্লাইসিরাইজিন ও গ্লাইসিরাটিক অ্যাসিড আলসার তৈরিতে দায়ী হাইড্রোক্সিপ্রোস্টাগ্লান্ডিন ডিহাইড্রোজিনেস ও প্রোস্টাগ্লান্ডিন রিডাকটেজ এনজাইমের ক্ষমতা নিস্তেজ করে দেয়। পাকস্থলীর আলসার নিরাময়ে এনজাইম প্রোস্টাগ্লান্ডিল ই ও এফ নিঃসরণ বাড়িয়ে মিউকাস মেমব্রেনকে সুরক্ষা দেয়। এতে উদরের এপিথেলিয়াল কোষগুলো শক্তিশালী হয়। ফলে গ্যাস্ট্রিক ও পেপটিক আলসার সারে। পাশাপাশি বুকজ্বালা, কোলাইটিস, গ্যাস্ট্রাইটিস, পাকস্থলীর ভেতরের এবং পরিপাকতন্ত্রের ওপরের স্তরে প্রদাহ দূর হয়। এ উদ্দেশ্যে ফুটন্ত পানিতে যষ্টিমধু ভিজিয়ে ঠান্ডা করে মধুযোগে পান করা যেতে পারে। এই মিশ্রণ পানে অ্যাসিডিটি সমস্যা থেকেও পরিত্রাণ মিলবে। অন্ত্র ছাড়াও মুখের ঘা নির্মূলেও যষ্টিমধু কাজে লাগে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য। যষ্টিমধু ভেজানো পানি দিয়ে গার্গল করলে ধীরে ধীরে মুখের আলসার ভালো হয়। বাজারে এই শিকড়ের গুঁড়া মেলে। তাতে সামান্য হলুদ কিংবা মধু মিশিয়ে মুখের ক্ষতস্থানে মাখলে উপকার পাওয়া যায়। ব্যথা আর জ্বলুনিও কমে। ঘায়ের কারণে আশপাশ ফুলে উঠলে তা-ও সারবে। লিভারের সুরক্ষায়ও কাজ করে যষ্টিমধু। এর গ্লাইসিরাইজিন উপাদান বিষাক্ত পদার্থের কবল থেকে লিভারের কোষগুলোকে রক্ষা করে। এতে গ্লাইসিরাইটিনিক নামের এক প্রকার অ্যাসিড থাকে, যা টিউমার সৃষ্টিকারী ‘এপস্টাইন বার ভাইরাস’-এর কার্যক্ষমতার বিলোপ ঘটায়।
শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন বালাই নাশে যষ্টিমধুর উপকারিতা ব্যাপক। কাশি, কফ, গলাব্যথা, হাঁপানি কিংবা ব্রঙ্কাইটিস- এগুলোর পথ্য আছে এই মিঠা শিকড়ে। ব্যাকটেরিয়ার কারণে শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে যে ইনফেকশন হয়, তা সারিয়ে তুলতে পারে যষ্টিমধু। ঠান্ডা কাশিতে ফুসফুস থেকে শ্লেষ্মাও বের করে দিতে পারে। ব্রঙ্কিয়াল টিউবের মাংসপেশির সংকোচনকে শিথিল করে। টনসিলাইটিস এবং কণ্ঠনালির প্রদাহও সারায়। ফলে সংগীতশিল্পী, আবৃত্তিকার, শিক্ষক ও গণমাধ্যমে কর্মরত কণ্ঠজীবীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
যষ্টিমধুর গ্লাইসিরাইজিক অ্যাসিড মাস্ট কোষ থেকে হিস্টামিন নিঃসরণ কমায়। ফলে অ্যালার্জি প্রতিরোধ হয়। এই শিকড়ে মৃগীর দাওয়াইও আছে। আধা কাপ চালকুমড়ার রসের সঙ্গে দুই গ্রাম যষ্টিমধুর গুঁড়া মিশিয়ে নিয়মিত খেলে এই রোগ থেকে নিস্তার মিলতে পারে। এর গুঁড়া দুধে মিশিয়ে খেলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে। পুষ্টির অভাবজনিত দুর্বলতা কাটাতে যষ্টিমধু নিয়মিত খাওয়া যায়। জন্ডিসেও উপকার মেলে। গরম দুধে এটি মিশিয়ে নিয়মিত খেলে খুব শিগগির এ রোগ সারে।
কর্মব্যস্ত জীবনে মানসিক চাপ যেন নিত্যসঙ্গী। যষ্টিমধুতে আছে নিষ্কৃতি। এই শিকড় চিবিয়ে খেলে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল নিয়ন্ত্রণ হয়। ফলে মানসিক চাপ কমে। দাঁত এবং মাড়ির সুরক্ষা দেয় এই ভেষজ। মুখগহ্বরে ব্যাকটেরিয়াল গ্রোথ নিয়ন্ত্রণ করে। চোখের সুরক্ষায় কাজে লাগে মিষ্টি স্বাদের এই উদ্ভিদ মূলটি। আমলকী ও যষ্টিমধু থেঁতলে সামান্য গরম জলে মিশিয়ে ছেঁকে সেই পানিতে চোখ ধুলে ঝাপসা দৃষ্টির সমস্যা দূর হয়। গরুর দুধের সঙ্গে এর গুঁড়ার মিশ্রণ পান করলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। মধুযোগে সেবন করলে একই ফল মিলবে। হৃদ্্রোগও সারাতে পারে যষ্টিমধু। দুধে এর গুঁড়া মিশিয়ে নিয়মিত দুবেলা পান করলে তিন-চার দিনের মধ্যেই হৃদপিন্ডের উন্নতি ঘটে। বুকের ধড়ফড়ানিও কমে। সাদা ¯্রাব হলে এটি চিবিয়ে খাওয়ার চল আছে। যষ্টিমধু বেটে ফোড়ায় প্রলেপ লাগালে সেরে যায়। এত সব উপকার ছাড়াও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এটি। কোভিড-১৯ এড়াতেও এর ভূমিকা আছে। কারণ, এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এটি শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল হটায়। ইমিউন সিস্টেম আরও উন্নত হয়। যষ্টিমধু প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। এর গ্লাইসিরাইজিন শরীরে কঠিন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বৃদ্ধি রোধ করে। সেটির বংশবিস্তারের লাগামও টেনে ধরে। তা ছাড়া যষ্টিমধু বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক প্রতিরোধ করতে পারে।
রূপচর্চায় যষ্টিমধুর কদর আছে। সে ক্ষেত্রে এর গুঁড়া বেশি ব্যবহৃত হয়। তা ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করলে উজ্জ্বলতা বাড়ে। ব্রণ, বলিরেখা ও দাগ দূর করতে এর জুড়ি নেই। চামড়ার একজিমা, সোরিয়াসিস, প্রদাহ এবং রোদে পোড়া দাগও হটায় এই ভেষজ। পায়ে ছত্রাকজনিত কারণে একধরনের রোগ হয়। যার উপযোগী পথ্য হলো যষ্টিমধু। ত্বকের ফোলাভাব ও চুলকানি থেকে রেহাই দিতে পারে এর নির্যাস থেকে তৈরি টপিক্যাল সল্যুশন। যষ্টিমধু থেকে বানানো লিকোরিস পাউডার সানট্যান ও পিগমেন্টেশন কমায়, ত্বকের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ধরে রাখে এবং মরা কোষ ও ডার্ট দূর করে। চুলের যত্নে কাজে লাগে শিকড়টি। যষ্টিমধু, তিলের তেল ও আমলকী মিশিয়ে তা মাথায় মাখলে চুল পড়া কমে। খুশকি দূর হয়।
যত উপকারিতাই থাকুক, কিছু ক্ষেত্রে যষ্টিমধু খেতে সাবধানতার প্রয়োজন। যেমন উচ্চ রক্তচাপে ভোগা রোগীদের জন্য এটি উপযোগী নয়। বেশি যষ্টিমধু খেলে হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কিডনির সমস্যা থাকলে এড়িয়ে যেতে হবে। গর্ভকালে এটি খাওয়া বারণ। লিভার সিরোসিসের রোগীদের জন্যও মানা। বেশি পরিমাণে যষ্টিমধু খেলে মাথা ধরে। শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি হয়। তাই যষ্টিমধু সেবনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট