skip to Main Content

ফিচার I নার্সারির গ্রাম

ঢাকার কাছেই। যেখানে গড়ে উঠেছে বৃক্ষপল্লি। নগরীর সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য জন্মানো গাছগুলো সেখান থেকেই আসে। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

গাড়ি ছুটছে আশুলিয়ার দিকে। গন্তব্য খাগান বাজার। সেখানেই অপেক্ষা করছেন কিংশুক গ্রিন হাউসের সাইফুল ইসলাম সাকিব। প্রথম গন্তব্যও কিংশুক গ্রিন হাউস। সেখানেই তিনি আশুলিয়ার দন্ডিভ্রমণের কান্ডারি হিসেবে সঙ্গ দেবেন।
আশুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে তিন শর বেশি নার্সারি; খুচরা আর পাইকারি মিলিয়ে, যেখানে কাজ করছে ছয় হাজারের বেশি নিম্ন আয়ের মানুষ। ঢাকার যত নার্সারি, তার ৮০ শতাংশ গাছের জোগানদাতা এগুলো। কোনো কোনোটির ঢাকাতেই রয়েছে নিজেদের শাখা। গাড়ি যখন খাগান বাজার পেরিয়ে কনকর্ড এলাকায়, তখন ভাঙাচোরা এক ব্রিজের ধারেই দেখা গেল কিংশুক গ্রিন হাউসের সাইনবোর্ড। ভেতরে দশ-বারোজন মানুষ গোবর-মাটি তৈরি করছে। ইট বিছানো পথের দুধারে কেবল গাছ আর গাছ। ইনডোর শেডের সামনে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো, এক দম্পতি গাছ তুলছেন গাড়িতে। জানা গেল একখানা এফ-কমার্স শপ আছে তাদের।
একটা শেডের পাশেই কাঞ্চন ফুলের গাছে বসন্ত এসেছে শীতেই, বেগুনি-গোলাপি রঙের মিশেলে ডাল ভরে আছে, গাছতলাও। সেখানে আরও বড় বড় গাছের ছায়ায় চারা করতে দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের ফিলোডেন্ড্রন, হোমালোমেনা, অ্যান্থুরিয়াম, সিঙ্গোনিয়াম, ক্যালাডিয়াম, স্কিনডাপসাস আর পথোসের। লাকি ব্যাম্বু এবং পলিনেশিয়ান আইভির চারাও করা হচ্ছে সেখানে। ৩০ বিঘা জমির উপর সাকিবের কিংশুক নার্সারি। এই অংশ তিতাস নামেই পরিচিত। এ রকম আরও নার্সারি রয়েছে, সেগুলোর নামও নদীর নামেই- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি। পুরো নার্সারিতে গাছ আছে প্রায় চার শ জাতের। শীতকালে ইনডোর গাছগুলো একটু কমই মেলে। তাতেও সেখানে নানা প্রজাতির ফার্ন, ক্যালাডিয়াম, অ্যান্থুরিয়াম, পিস লিলি, জিজি, প্রেয়ার প্ল্যান্ট, অ্যাগ্লোনিমা, বেগোনিয়ার অভাব নেই। আউটডোর প্ল্যান্টের এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো দুধরাজ, টিকোমা, করবি, নানা জাতের পাম, পারিজাত, এলিফ্যান্ট ক্রিপার, নাকাচুয়া, বাওবাব, পাইলেন্থা স্প্ল্যাশ, নানা জাতের ফুচিয়া, ফিডল লিফ, বকুল, লাল কদম, বাসর লতা, শিমুল, কর্কশিট, ছাতিম, পাওলি, এমালিয়া, কাঠবাদাম. বক্সবাদাম, মহুয়া, তেজবহুল, বিভিন্ন মসলার গাছসহ নানা রকমের বৃক্ষ। সেখান আরও রয়েছে সন্ধ্যামালতী ফুল আর অল স্পাইস, মৌরি পাতার মতো সুগন্ধি গাছ। বেশ বড় জায়গার নিরাপত্তা ছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা নেই বলে জানালেন সাকিব। নিরাপত্তার অভাব মানে তেমন বড় কিছু নয়, জানালেন টুকিটাকি দামি গাছ চুরির সমস্যার কথা।
পরের গন্তব্য একটু দূরে পালোয়ানপাড়া। ইমন অর্কিড হাউস। সেখানে দেখা মিলল ঢাকার এক অনলাইন উদ্যোক্তার সঙ্গে। জানালেন অর্কিড, সাকুলেন্ট জাতীয় গাছের জন্য তিনি এখানেই আসেন। খানিক পরেই এলেন অর্কিড হাউসের উদ্যোক্তা রবিউল ইসলাম। তিনি ২০০৬ সালে প্রথমে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে শুরু করেন অর্কিড নার্সারি। সেটার পাশাপাশি ২০১২ সালে সাভারের পালোয়ানপাড়ায় আড়াই বিঘা জমির উপর শুরু করেন দ্বিতীয় নার্সারি। মোটামুটি গর্বের সঙ্গেই বলেন- ঢাকার যত অর্কিড, বেশির ভাগই তার কাছ থেকেই নেওয়া হয়, যদি না সেটা নিজ উদ্যোগে বাইরের থেকে অন্য কেউ আনে। তার কাছে রয়েছে নানা প্রজাতির অর্কিড। ডেনড্রোবিয়াম, অনসিডিয়াম, ক্যাটেলিয়া, মোকারা, পালোমা, সিম্বিডিয়াম, লিটল স্টার এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে প্রতিটি প্রজাতিরই আবার রয়েছে নানা উপপ্রজাতি, ফলে ফুলের ধরন, রঙ- সবই ভিন্ন হয়। অর্কিড ছাড়াও তার সংগ্রহে রয়েছে সাকুলেন্ট ধরনের গাছ- ক্যাঙারু পকেট, হয়া, গ্রিন লিফ, লিপস্টিক, লং ক্যাকটাস ইত্যাদি। এ ছাড়া কিছু ভিন্ন ধরনের সিঙ্গোনিয়াম আর অ্যান্থুরিয়ামেরও দেখা মিলল তার নার্সারিতে। কোনো সমস্যা সম্পর্কে না জানালেও ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন করোনাকালীন খানিকটা মন্দাভাবের কথা। গেল বছরের বৃক্ষমেলাও হয়নি।
এরপর চারাবাগ। হাকিকাত নার্সারিতে গিয়ে দেখা মিলল উজির আলীর সঙ্গে। তাকে বাংলাদেশের নার্সারি ব্যবসায়ীরা একরকম লিজেন্ড বলেই মনে করেন। ইনডোর আর শৌখিন গাছগুলো সেই আশির দশক থেকে দেশে আনছেন তিনি। তার ছেলেও এই ব্যবসায় রয়েছেন। এখন উজির আলীর অনুসরণে আরও অনেকেই শৌখিন গাছ আমদানি করছেন দেশে। তার নার্সারিতে এখন মূলত গোলাপ আর শীতের অন্যান্য ফুলের প্রাধান্য। তবে জিজি, অ্যাগ্লোনিমা, পথোস আর স্নেক প্ল্যান্টের (সেন্সিভিরিয়া) কালেকশন বেশ ভালো। প্রসঙ্গক্রমে পুরোনো দিনের কথা বললেন- একসময় নিয়মনীতি ছিল না বাইরের গাছ আনার। ১৯৮৫ সালে প্রথম এলসি করে বাণিজ্যিকভাবে গাছ সংগ্রহের স্মৃতিচারণাও করলেন। হাকিকাত নার্সারির আরও তিনটি শাখা রয়েছে ঢাকায়- আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর ও আজিমপুরে। জানালেন, সরকারি নীতি থেকে শুরু করে গাছ বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই সমস্যা রয়েছে। সরকারি নীতিমালা সংশোধন হলে অনেক সমস্যা আপনা-আপনিই মিটে যাবে।
পাশে নার্সারির আরেকটি গুচ্ছ। মানে, মসজিদের উল্টো দিকে বেশ বড় জায়গা নিয়ে নয়টা নার্সারি। সেখানে ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট জাতীয় গাছের কালেকশন বেশ ভালো। কিছু দূরেই গ্রিনল্যান্ড নার্সারি। সেখানে নানা রকমের ফার্ন, পথোস, স্কিনডাপসাস, হয়া আর অর্কিডের চারা করতে দেওয়া হয়েছে। বেগোনিয়াও রয়েছে কয়েক ধরনের। নানা জাতের মোরগ-মুরগিরও ঠাঁই হয়েছে সেখানে। গরু-ছাগলও রয়েছে- সবই জাতীয় পুরস্কার পাওয়া গ্রিনল্যান্ড নার্সারির স্বত্বাধিকারী হারুন-উর-রশীদের শখের ব্যাপার। তিনি জানালেন, এখন করোনার প্রকোপ, বৃক্ষমেলা না হওয়া- সব মিলিয়ে নার্সারিটাও শখের মতোই হয়ে গেছে। কোভিডের এই সময়েই ১৫ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ করতে হয়েছে এখানে। কিন্তু ফেরতের খাতাটা এখনো ভারী হয়নি। খানিকটা ক্ষোভ ঝাড়লেন অনলাইন সেলারদের প্রতিও। সরকারকে নিয়মিত কর দিচ্ছেন, জনা দশেক লোকের কর্মসংস্থান করছেন, গাছ আমদানির সময়ে মূল্য সংযোজন কর দিচ্ছেন, এলসি করছেন, যেটুকু জমিতে নার্সারি আছে, তারও খাজনা দিচ্ছেন, তার কাছ থেকে অনলাইনের নামসর্বস্ব পেজগুলো গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ছয়-সাত গুণ। এর ফলে সাধারণ ক্রেতাদের ভেতরেও গাছের দাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিলেন তিনি, সব অনলাইন শপকে নার্সারির নীতিমালার আওতায় এনে নিবন্ধন করতে হবে, প্রয়োজনে ই-ক্যাবেরও সদস্যপদ নিতে হবে। তাহলে হয়তো অনলাইনের এই সব বিকিকিনির হিসাব থাকবে, ব্যাপারটা আর কালোবাজারির পর্যায়ে থাকবে না।
ফেরার সময়, সন্ধ্যায়, দেখা গেল- দোসাইদ গ্রাম থেকে ট্রাক, মিনি ট্রাকে করে ঢাকায় আসছে অগণন গাছ। সেসব ছড়িয়ে যাবে আগারগাঁও, গুলশান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, ধানমন্ডিসহ নানা জায়গার অভিজাত ও ফুটপাতের নার্সারিগুলোয়।
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top