skip to Main Content

এডিটরস কলাম I চাই প্রকৃতিনিষ্ঠ ল্যান্ডস্কেপ

ল্যান্ডস্কেপ প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্য রচনার চিত্রকলা। এর মাধ্যমে একটি অঞ্চল, দেশ বা পুরো জগৎকেই বিরামহীন সৌন্দর্যে পরিণত করা যায়

বাগান যেকোনো নান্দনিক ও সুশৃঙ্খল শহর বিন্যাসের সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ। ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে এর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ বিষয়েই আজ আমরা কথা বলব।
ল্যান্ডস্কেপ প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্য রচনার চিত্রকলা। এর মাধ্যমে একটি অঞ্চল, দেশ বা পুরো জগৎকেই বিরামহীন সৌন্দর্যে পরিণত করা যায়। ক্লান্তিকর নাগরিক কোলাহল এবং একঘেয়েমি দূর করতে ল্যান্ডস্কেপ সফলভাবে কাজ করে। উন্নত দেশগুলোতে এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার খুব সীমিত, অথচ এখানকার নিসর্গ এর অনুকূলেই ছিল।
বাংলাদেশের প্রায় কোনো শহরই খুব একটা পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। ইংরেজ বণিক ও পরবর্তীকালে ব্রিটিশরাজের প্রয়োজন এবং সুবিধামতো এখানে নগর গড়ে ওঠে। তারা নিজেদের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট, রেলপথ নির্মাণ করে। পরবর্তীকালেও শহরকে নতুন রূপে সাজিয়ে, সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণের তেমন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। যে কারণে খাল-নদী-জলাশয় ভরাট এবং বন উজাড় করে যত্রতত্র শহর বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু সেখানেও পানিনিষ্কাশন, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, পার্ক বা উদ্যান, সবুজ প্রাকৃতিক এলাকা- কিছুই রাখা হয়নি। ফলে প্রায় প্রতিটি নগর জঞ্জালে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা- এসব শহর কলকারখানা, শিল্পাঞ্চল, ঘনবসতি, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ইত্যাদি কারণে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু পুরোনো এলাকা পুনর্নির্মাণ এবং নতুন গড়ে ওঠা অঞ্চলগুলো যদি পরিকল্পিতভাবে নবায়ন করা যেত, তাহলে শহর হয়ে উঠত বাসযোগ্য, নান্দনিক এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির সামঞ্জস্যে অনন্য।


স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পার্ক, বিনোদনের জন্য ক্ষুদ্রাঞ্চল, শিল্প-কারখানা, অট্টালিকার সম্মুখভাগ, শহরের সড়কদ্বীপ ও বিভাজক, রাস্তার দুই পাশ, ত্রিকোণা স্থান, লেকের পাড়- একেক স্থানের ল্যান্ডস্কেপ একেক রকম হয়। আবার কোনো নকশা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমেও এর মনোমুগ্ধকর রূপ দেওয়া সম্ভব। পেশাদারি দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বনরক্ষণবিদ্যা, সৌন্দর্যবিষয়ক জ্ঞান, স্থাপত্যবিদ্যা, বাগান পরিচর্যার দক্ষতা, ভূতত্ত্ববিষয়ক ধারণা থাকলে অনায়াসেই একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সৌন্দর্যমন্ডিত ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করা সম্ভব।
ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণে মনে রাখা দরকার, প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহারই হতে পারে সৌন্দর্যের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও পরিবেশ-উপযোগী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কৃত্রিম উপাদান এবং আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন সব বিদেশি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। এসব সামগ্রী ও অনেক ধরনের বহিরাগত গাছ যেমন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি ব্যয়বহুলও বটে। এ জন্য যত বেশি প্রাকৃতিক উপকরণ, দেশজ বৃক্ষ ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হবে, ততই শহরের পরিবেশ হয়ে উঠবে বসবাসের উপযোগী, দূষণমুক্ত ও সুন্দর। যেমন দেশজ ফুলের গাছ, বৃক্ষরাজি, নুড়ি-পাথর, অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সামগ্রী ইত্যাদি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে একটি সুন্দর ল্যান্ডস্কেপিং সম্ভব।


আমাদের দেশের বড় শহরগুলোতে ল্যান্ডস্কেপ নির্মাণ করা হলেও তা সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যথাযথ দেখভাল বা নিয়মিত পরিচর্যা না করলে কোনো সৌন্দর্যই অটুট কিংবা টেকসই থাকে না। বেশ আগে থেকেই ঢাকা বারবার বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ল্যান্ডস্কেপিং সে ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সবুজ গাছ শহরে যেটুকু আছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন ধরনের গাছপালা রোপণ করা যেতে পারে। তাহলে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শহরও পাতা-ফুলে রঙিন হয়ে উঠবে। তা ছাড়া শব্দ এবং বায়ুদূষণের নগরীতে ল্যান্ডস্কেপের লতাগুল্ম ও গাছগাছালি শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। নির্মল বায়ুর জোগান দেয়। দৃষ্টিকে করে আরামদায়ক আর মনকে প্রশান্ত। শুধু তা-ই নয়, ল্যান্ডস্কেপ শহরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখে। ধুলোবালি কমায়, সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।


স্থাপত্যবিদ্যায় ল্যান্ডস্কেপের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শিল্পকলা হিসেবেও গণ্য। দুটি বিষয়ের মধ্যে আন্তসম্পর্ক রয়েছে। স্থাপত্য এবং ল্যান্ডস্কেপ একে অন্যের পরিপূরক। যা একটি শহরের স্থায়ী সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের ভেতরে সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তোলার পাশাপাশি নগরেও সবুজ-শ্যামল বাংলার মনোমুগ্ধকর রূপ উপস্থাপন করা সম্ভব ল্যান্ডস্কেপিংয়ের মাধ্যমে। এই শিল্পকর্ম নির্মাণই পারে সৌন্দর্য বৃদ্ধির সঙ্গে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সবুজ নগর উপহার দিতে। কারণ, পরিচ্ছন্নতা এবং সবুজায়নই আদর্শ ল্যান্ডস্কেপের মূল লক্ষ্য।


দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের রুচিবোধেও পরিবর্তন ঘটছে। যাপিত জীবনধারায়ও আসছে বদলের ছোঁয়া। তাই বসবাসের এলাকা হয়ে উঠছে পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব। সাম্প্রতিক অতিমারি মানুষের চেতনায় নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে প্রাকৃতিক জীবনের তৃষ্ণা। শহর পরিকল্পনায় ল্যান্ডস্কেপ যোগ করবে সেই আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপায়ণ। কেননা, মানুষ তো প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইলাষ্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top