ফিচার I আহার ভঙ্গির ভালো-মন্দ
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণের পরও রুগ্ণ থেকে যাওয়ার প্রধান একটি কারণ হতে পারে ভঙ্গি। অথচ এর বিপরীত চিত্রও আছে
খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতি অনেক সময় অসুখ-বিসুখের কারণ হয়ে উঠতে পারে। একেক মানুষের খাওয়ার ভঙ্গি একেক রকম। আমাদের আশপাশে দেখা যায়, কেউ হয়তো কোনো খাবারের দোকানে চেয়ারে বসে খাচ্ছে, কেউ হেঁটে হেঁটে। অনেকেই পথরেস্তোরাঁর পাশে দাঁড়িয়ে খায়। দৌড়াতে দৌড়াতে খাওয়ার লোকেরও দেখা মেলে। বাড়ির ভেতরে খাদ্য গ্রহণের চিত্র ভিন্ন। কেউ মেঝেতে বসে খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারও ডাইনিং টেবিল চাই। সিনেমা দেখতে দেখতে সোফায় গা এলিয়ে খাওয়া, কিংবা গেম খেলতে খেলতে উপুড় হয়ে ভাজাপোড়া চিবোনো- সবই চলে। এসব ভঙ্গির মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ফলে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়ার ফলেও হিতে বিপরীত হতে পারে।
অবশ্য কিছু ভঙ্গিতে আছে উপকারিতাও। যেমন মেঝেতে বসে খাওয়া। এতে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। এই ভঙ্গিতে খাওয়ার সময় থালা কিছুটা সামনে থাকে বলে খাদ্য গ্রহণকালে ঝুঁকতে হয়। খাবার মুখে তুলে আবারও সোজা হওয়া লাগে। যতক্ষণ ধরে খাওয়া হয়, ততক্ষণই চলে এই প্রক্রিয়া। ফলে অ্যাবডোমেনের পেশিতে টান পড়ে। ক্ষণে ক্ষণে সেটির সংকোচন ও প্রসারণ ঘটে, যা খাদ্যদ্রব্য দ্রুত হজমে সহায়তা করে। ফলে উদরজনিত বিভিন্ন বালাই থেকে রেহাই মেলে। এসব উপকারিতা পেতে চাইলে মেঝেতে বসে খাওয়ার অভ্যাসটি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তবেই সুফল মিলবে। অ্যাবডোমেনের মাসলের এই নড়াচড়া পেটের মেদের ওপরও ভালো প্রভাব ফেলে। চর্বি হটায়। ভুঁড়ি কমলে শরীরের অনেক রোগবালাই এড়ানো যায়। মেঝেতে বসে খেলে অতিরিক্ত ভোজন অনেক সময় সম্ভব হয় না। খাদ্য আসক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অতি আহারজনিত স্থূলতা থেকে মুক্তি মেলে। নিয়মিত বসে খাওয়ার অভ্যাস করলে ধীরে ধীরে ওজন কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়। শরীরের রক্তসঞ্চালন বাড়ে। এতে দেহের প্রতিটি কোষে রক্ত পৌঁছে যায় সহজে। ফলে রোগবালাই কম হয়। শরীর সতেজ থাকে। রোগ ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে না। রক্তসঞ্চালন ভালো থাকায় হৃৎপিন্ড সুস্থ থাকে। এমনকি মেঝেতে বসে খেলে হার্টের ওপর চাপ কম পড়ে। হাঁটু মুড়ে থাকাকালীন শরীরের ওপরের অংশে রক্তের প্রবাহ বাড়ে। এতে অঙ্গটির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে। সারা শরীরে সমানভাবে রক্ত প্রবাহিত হয়, ফলে নিচে বসে খাওয়াকেই স্বাস্থ্যসম্মত বলে পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভঙ্গিতে খেলে হাড়েরও উপকার মেলে। বিশেষ করে কোমর, পা ও মেরুদন্ডের। থালার দিকে বারবার ঝোঁকা ও সোজা হওয়ার ভালো প্রভাব পড়ে হাড়ের ওপর। দীর্ঘকাল নিচে বসে খাওয়ার ফলে এসব অস্থি মজবুত হয়।
নিচে বসে খেলে মাথা ও শরীর থাকে রিল্যাক্স। মেডিটেশনে সে কারণেই পদ্মাসনে বসার পরামর্শ দেওয়া হয়। শরীরে অক্সিজেন প্রবাহিত হওয়ার ফলে শরীর রিল্যাক্স থাকে। মগজ শান্ত হয়। এমনকি নিচে বসে খেলে আয়ুও বাড়ে। ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল। নিচে বসে খেলে শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথাও উপশম হয়। নিয়মিত এভাবে খাবার খেলে পিঠ, পেলভিস ও তলপেটের পেশির কর্মক্ষমতা বাড়ে। দেহের অন্যান্য অঙ্গে ব্যথা থাকলে তা-ও সারে। মেঝেতে বসে খেলে মানসিক চাপও কমে। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকক্ষণ ধরে মেঝেতে বসে থাকলে শরীরে ও মগজে কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা স্ট্রেস হরমোন ক্ষরণ কমায়। এতে মানসিক অবসাদ কমে।
বসে খাওয়া যেমন উপকারী, দাঁড়িয়ে খাওয়া তেমনই ক্ষতিকর। কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে যে দাঁড়িয়ে খেলে খাবারের স্বাদ কম লাগে। কেননা, শরীরের ভারসাম্যের সঙ্গে স্বাদের বিষয়টি যুক্ত। দাঁড়িয়ে থাকলে মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে আমাদের রক্ত নিচের দিকে বেশি প্রবাহিত হয়। তা নিচ থেকে ওপরে তুলে সারা দেহে ছড়িয়ে দিতে হৃদপিন্ড বেশি পরিশ্রম করে। ফলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ থেকে হতে পারে হাইপো থ্যালামিক পিটুইটারি অ্যাড্রিনালিন, যা স্ট্রেস হরমোন বাড়ায়। এতে শরীর অবসন্ন হয়। ফলে খাবারের সঠিক স্বাদ মেলে না। এমনকি অল্প শারীরিক সমস্যাতেও সুস্বাদু খাবার বিস্বাদ লাগতে পারে। তাই রাস্তার পাশে কিংবা কোনো পার্টিতে গিয়ে বন্ধুরা মিলে কথা বলতে বলতে দাঁড়িয়ে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই ভালো। এতে হজমে সমস্যা হয়। ফলে মানসিক চাপ বাড়তে পারে। দেহ ও মন উভয়ই খারাপ হয়। এ কারণেই বিশেষজ্ঞরা দাঁড়িয়ে খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগের পরামর্শ দেন।
দীর্ঘকাল ধরে এভাবে খাওয়ার অভ্যাস চালিয়ে গেলে পাকস্থলীতে সমস্যা হতে পারে। কেননা এই ভঙ্গিতে খেলে খাবার সরাসরি পাকস্থলীতে চলে যায়। এতে খাদ্য হজম হওয়ার যথাযথ সময় পায় না। ফলে পুরো পরিপাকতন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। খাদ্যনালি ও পাকস্থলীতে গুরুতর কোনো সমস্যা না থাকলেও দাঁড়িয়ে খাওয়ার ফলে অ্যাসিডিটিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর প্রভাব পুরো শরীরে পড়তে পারে। বদহজমের কারণে গ্যাস, পেট ফাঁপা, খাবার জমাট হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ও বুকজ্বালা হতে পারে। এতে অস্বস্তিভাব বাড়ার পাশাপাশি মেজাজ খিটখিটে হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যার প্রভাবে দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটে।
বসে কিংবা শুয়ে খাওয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের বেলায় আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। শিশুকে বসে খাওয়াতে চাইলে মাকে বিশেষ কায়দায় বসতে হয়। এ ক্ষেত্রে পিঠের পেছনে ও কোলের নিচে বালিশ দিয়ে বসা যেতে পারে। সন্তানকে শুয়ে খাওয়াতে চাইলে শিশুটিকে মায়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ানো ভালো। এ ক্ষেত্রে এমনভাবে শোয়াতে হয়, যাতে মা হাত দিয়ে শিশুর পশ্চাদ্দেশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে।
বয়স্করাও শুয়ে শুয়ে খাবার খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই অভ্যাস বর্জনীয়। এতে বদহজমের আশঙ্কা থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে খাওয়াও উচিত হবে না। এতে পুরো পরিপাকতন্ত্রে গোলমাল তৈরি হতে পারে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট