skip to Main Content

রসনাবিলাস I ফারজি ক্যাফে

ভারতীয় খাবারকে বৈশ্বিক করে তোলার আয়োজন সেখানে। ফলে এক্সপেরিমেন্ট অনিবার্য। আছে মনোরম ইন্টেরিয়রে ভোজনের আনন্দ। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

চোখের সামনে সদ্য ব্রিউ করা আমেরিকানো। তবে চুমুক দেওয়ার আগে ভ্রু কুঁচকে গেল। ক্রেমা খানিকটা না, বরং বলা ভালো নেই-ই। পুরোনো কফি দিয়ে বানানো, নাকি দৃষ্টিবিভ্রম- এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই সুদর্শনা নারী বারিস্তা অভয় দিয়ে জানালেন, ‘এটা আমাদের নিজেদের ব্র্যান্ডের কফি, মিডিয়াম রোস্ট, তাই ক্রেমা অনেক কম’। চুমুক দিতেই বোঝা গেল, তিনি ভুল কিছু বলেননি। স্বাদ অসাধারণ, ফ্লেভার, অ্যারোমা আর অ্যাসিডিটি-ব্যালান্সড। কেবল ওপরের ক্রেমাটাই নেই।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই হাজির হলেন শাওন। তিনি এই ক্যাফের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন। জানালেন ফারজি ক্যাফের ইতিহাস। ফারজি মূলত উর্দু শব্দ, যার অর্থ ধোঁকা, জাদু, চমক। তিনটি অর্থই এখানকার খাবারের সঙ্গে বেশ ভালোই মিশে যায়। ফারজি ক্যাফের পথচলা শুরু হয় জোরাওয়ার কারলার হাত ধরে। তিনিই জানালেন, ফারজি হলো ইন্ডিয়ার কুজিনের ‘প্লেফুল টুইস্ট’। তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নানা ধরনের খাবার থেকে প্রভাবান্বিত হন, আর সেটাকে ইন্ডিয়ান কুজিনের সঙ্গে মিলিয়ে চমক দিতেই পছন্দ করেন।
একটু পরই এসে হাজির হলেন ফারজি ক্যাফের হেঁসেল-প্রধান সুরাজ পাটিল। মুম্বাইয়ের এই যুবক ঢাকার খাবারের বিশেষ অনুরক্ত। চেখে দেখেছেন হাজির বিরিয়ানিও! কথায় কথায় তিনি বিস্তারিত জানালেন এই ক্যাফের ইতিহাস। ইন্ডিয়ান মাস্টারশেফ জোরাওয়ার কারলা জয়পুর থেকে শুরু করেন এই ক্যাফের, আর তা খুব কম সময়ের মধ্যেই ভারতের ২২টি প্রদেশ ছাড়াও ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, সিডনি, আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কথা চলছে কলকাতার পাশাপাশি ইতালি ও বাহরাইনেও শাখা খোলার। ফারজি ক্যাফের উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় খাবারের সীমানাকে আরও বাড়িয়ে তোলা, স্থানীয় খাদ্য ও উপকরণের সঙ্গে বৈশি^ক প্রযুক্তির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। খাবারগুলো পরিবেশনও করা হয় বাহারিভাবে, মানে যেভাবে আমরা ওই পদ দেখে অভ্যস্ত, তার থেকে খানিকটা ভিন্নভাবে। ঢাকায় মলিক্যুলার গ্যাস্ট্রোনমি ঘোষণা দিয়ে চালু করার পথিকৃৎ এই ফারজি ক্যাফে। মলিক্যুলার গ্যাস্ট্রোনমি হলো খাদ্যবিজ্ঞানের এমন এক উপশাখা, যা খাবারে ব্যবহার করা উপকরণগুলোর দৃশ্যমান ও রাসায়নিক রূপান্তর কাজ করে। মলিক্যুলার গ্যাস্ট্রোনমির কাজের ক্ষেত্র তিনটি- সামাজিক, শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত। ঢাকায় এই বিশেষায়িত খাবারের ঘরানার উদ্যোক্তা রনি চৌধুরী। এ শহরে তিনি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি এনেছেন ২০১৯ সালে।
ক্যাফের ইতিবৃত্ত জানার সঙ্গেই চলল ঘুরে দেখা। বিশাল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মৃদু আলোর সঙ্গে কাচ ভেদ করে বাইরের প্রাকৃতিক আলোর মিশেল দৃশ্যমান হলো। দেয়ালগুলোয় কাঠ আর পোড়ামাটির টেক্সচারের টাইলস। পায়ের তলাতেও কাঠের টেক্সচারের টাইলস, মাথার ওপর টাংস্টেনের হলুদ আলোর সঙ্গে মানানসই- রেট্রো মুডে। বসার আয়োজন নরম গদির সোফা আর চেয়ারে। নাক বরাবর কাপলদের বসার ব্যবস্থা। শেষ প্রান্তে হাতের ডানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই মূল ক্যাফে, অন্তত ইন্টেরিয়র তা-ই বলে। সেখানে এক পাশে কফি কাউন্টার। মাথার ওপরে আর এক পাশে গ্লাস দিয়ে ঘেরা। পুরোটাই কৃত্রিম সবুজের আচ্ছাদন। এখানকার ইন্টেরিয়রকে দুভাগে ভাগ করলে প্রথমে যেখানে বসেছিলাম, সেটা ফাইন ডাইনের অংশ, আর এদিকটা ক্যাফে- ধূমপায়ীরা চাইলে এখানে বসে কফি বা নানা রকমের মকটেল অর্ডার করতে পারেন।
প্রথমেই ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে এলো অ্যামিউজ বুশ- ফারজির সিগনেচার ওয়েলকাম শট। দই আর স্ট্রবেরি জ্যামের জমাট গোলক, স্ফেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় তৈরি। কথায় আছে, প্রথমে দর্শনদারি, পরে গুণবিচারি। অ্যামিউজ বুশ সবার আগে পরিবেশন করাই হয় এই উদ্দেশ্যে। এটা ক্যাফেতে খেতে আসা মানুষের এতটাই বিমোহিত করে যে, এরপর চোখ বুজে বিশ্বাসের সঙ্গেই তারা অর্ডার করেন নানা পদের খাবার। এরপর এলো স্টার্টারের সারি। স্যু শেফ নিজে তদারক করলেন, বসে খাবারগুলোর বর্ণনা দিলেন। দাল চাওল আরানচিনি, বাটার চিকেন বাও, তন্দুরি গোট শোল্ডার, টেম্পুরা ফ্রায়েড প্রনস। এর আগে পরে আরও উপাদানযোগে নামগুলো বেশ বড়! এটা অবশ্য করা হয়েছে যারা এখানে খেতে আসেন, তাদের খাবারের উপকরণগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতেই- বললেন সুরাজ পাটিল। আরানচিনি মূলত সিসিলি এলাকার হালকা খাবার। সেটাকে ইন্ডিয়ান টুইস্ট দেওয়া হয়েছে- রিসোত্তোর বদলে আমাদের চেনা-জানা খিচুড়ি দিয়ে। সেটাকে চিজ দিয়ে গোল করে পাঁপর-গুঁড়োসহ ডিপ ফ্রাই করে পরিবেশন করা হয় টমেটো-পেঁয়াজের সালসা, পাঁপরের রোল আর চাটনি-মেয়োর সঙ্গে। এটায় কামড় বসাতেই শেফ জানালেন, আপনাকে তো আমাদের স্পেশাল ড্রিংকসটাই দেওয়া হয়নি, বলেই ছুটলেন মকটেল কাউন্টারে। এদিকে আমি আরানচিনির চিজি-খিচুড়ির স্বাদে মুগ্ধ হয়ে হাত বাড়িয়েছি বাটার চিকেন বাওয়ের দিকে। চায়নিজ ঘরানার বান-রুটিকে দুই টুকরো করে মাঝখানে স্লাইডারের মতো করে পুর দেওয়া হয়েছে মুর্গ মাখানির। সঙ্গে গ্রিন চিলি মেয়ো। এখনকার বার্গার জয়েন্টগুলো চাইলেই আইডিয়া চুরি করতে পারে! অসাধারণ স্বাদ। এই হালকা ঝালের হলকা থেকে মুক্তি দিতে এলো সিগনেচার ড্রিংক- গ্র্যানি মিন্ট রয়্যাল। সবুজরঙা ড্রিংকসের ওপরে সাদা ক্রিম। তবে এটাও এলো ধোঁয়া উড়িয়ে। সুরাজ জানালেন, এটাকে মার্টিনির এদেশীয় রূপ বলা যেতে পারে। এতে আছে সবুজ আপেল, সবুজ আপেলের সিরাপ, লেবুর রস, আপেল জুস, মিন্ট ফোম আর এল্ডার ফ্লাওয়ার সিরাপ। টক-মিষ্টি স্বাদে চুমুক দিতেই অদ্ভুত প্রশান্তি। এরপর কাঁটায় গেঁথে চিংড়ির স্বাদ নেবার পালা। টেম্পুরা ফ্রায়েড প্রন, ওপরে লেবু আর মরিচের ফোম, তবে অন্য জায়গার মতো মুচমুচে নয়, বরং টক-ঝাল গ্রেভিতে মাখামাখি। এরপর তন্দুরি গোট শোল্ডার চেখে দেখার পালা, সঙ্গে জিরাখারি। ইরান থেকে জরথুস্ত্রের অনুসারীরা ভারতে এনেছিল জিরাখারি নামের এই পাফ পেস্ট্রি, অনেকটা আমাদের প্যাটিসের মতোই। সারা রাত ধরে তন্দুরি মসলায় রান্না হওয়া কচি ছাগ-স্কন্ধের মাংসের সঙ্গে এই জিরাখারিও মন্দ নয়। তবে স্টার্টারগুলো পরিমাণে অঢেল।
এরপর তিনখানা মেইন ডিশের আগমন দৃশ্যপটে। চাটনি চিকেন বিরিয়ানি, কর্ণাটকি ঘরানার টুন্নে বিরিয়ানির থেকে অনুপ্রাণিত। এই বিরিয়ানিতে ধনেপাতা-পুদিনাপাতার চাটনি দিয়ে পুরো চালই সবুজ। সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট টুকরা করা হাড়বিহীন মুরগি, গ্রেভিসমেত। আর অল্প অল্প করে সাদা মুক্তার মতো ছড়ানো- স্ফেরিফিকেশন করা রাইতা। আমাদের চেনা-জানা স্বাদের থেকে পুরোই আলাদা ঘরানার। খেতে দারুণ। এখানেই ঘটনার শেষ নয়। আরও একখানা বিরিয়ানি অপেক্ষায় ছিল- শর্মা বিরিয়ানি। মূলত আখনি থেকে তৈরি এই বিরিয়ানি পরিবেশিত হয় ডোনার কাবাবের মতো টাওয়ারে হাড় ছাড়া কচি ছাগলের মাংসের টুকরা দিয়ে। খুবই আলতো আঁচে মাংস রান্না হয়। সঙ্গে শসার রাইতা। এটাও চেনা জানা স্বাদ থেকে খানিকটা দূরে। তাই মন্দ লাগে না। এত খাবার খেয়ে যখন পেটে আর তিলধারণের ক্ষমতা নেই, তখন এলো চিকেন টিক্কা মাসালা, টমেটো গ্রেভি, বাটার আর ক্রিমের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে। সঙ্গে কর্নিশ ক্রাঞ্চার নান। ইংল্যান্ডের জাতীয় খাবার বলেই ইংলিশ ফোন বুথে করে এলো। এর আগে সেগুলো দেখে ভেবেছিলাম, বুঝি এটাও ইন্টেরিয়রের অংশ! এই খাবারে ইংলিশ কর্তৃত্ব কেবল নানের ওপর খানিকটা কর্নওয়ালের তৈরি পনির (কর্নিশ চিজ) আর ঝাল ঝেড়ে ফেলা।
শেষে এলো রসমালাই ত্রেস লেচেস, অর্থাৎ তিন লেয়ারের রসমালাই। প্রথমে জাফরান-রাবড়ির সায়রে গোলাপ-বাদামের সন্তরণ দেখে কাপকেক সাইজের এক টুকরা রসমালাই। তাতে আবার স্পঞ্জি রসমালাই একা নয়, তাকে ক্রিমি করেছে গাজরের হালুয়া, আর এই তিন লেয়ারের আভিজাত্যের কারণে তার মাথায় গোলাপ-চিনির তাজ। খেতে অসাধারণ।

ঠিকানা: ফারজি ক্যাফে, টাওয়ার অব আকাশ, ৫৪ গুলশান অ্যাভিনিউ, গুলশান ১, ঢাকা।
ফেসবুক: FarziDhaka
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top