skip to Main Content

কভারস্টোরি I হিরণ্ময় হীরা

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রত্নপাথর। ইতিহাসের শুরু থেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজ-রাজড়ার উত্থান-পতনের গল্প। ক্ষমতার পালাবদল। প্রেম, সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধির কাহিনি। কোনোটি রোমাঞ্চকর, কোনোটি অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ এবং ভয়াবহ। লিখেছেন মাহবুব হোসেন

এক শ ভাগ খাঁটি কার্বন। আগ্নেয়গিরির সুড়ঙ্গের প্রচন্ড চাপ আর তাপে কার্বনের রূপান্তরের ফলই হীরা। গোলাপি, নীল, সবুজ, বাদামি, কালো, কিংবা লাল হীরাও পাওয়া যায়। যুগে যুগে এগুলো সম্রাট-নৃপতিদের কোষাগারে সঞ্চিত থেকেছে, ব্যবহৃত হয়েছে দেবদেবীর মূর্তির চোখ কিংবা রাজনন্দিনীদের অলংকার হিসেবে। এগুলোর কোনোটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভয়ংকর সব কিংবদন্তি, আবার কোনোটি ‘গ্রেট-মোগল’, ‘হেস্টিংস’, ‘নেপলীয়’ কিংবা ‘পাত্রোচিনহো’র মতো হারিয়ে গেছে। আজকের পৃথিবীতে হীরাই সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন।
গোলকুন্ডা দুর্গটির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী হায়দরাবাদ থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে পাহাড়ি এলাকায়। তিন শ বছর আগে দাক্ষিণাত্যের প্রবল পরাক্রমশালী কুতুবশাহির একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল এটি। জানা যায় সম্রাট আওরঙ্গজেব দশ বছর দুর্গটিকে অবরোধ করে রেখেছিলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে একদিন ভূগর্ভে পাওয়া গিয়েছিল এক আশ্চর্য পাথর-হীরা। এই খবর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ইউরোপের ক্যাথরিন দ্য গ্রেট থেকে শুরু করে মোগল সম্রাটদের বিশ্বস্ত দূতেরা ছুটে আসে গোলকুন্ডায়। সেখানে প্রথম হীরার সন্ধান মেলে যিশুখ্রিস্টের জন্মের ছয় শ বছর আগে। কিন্তু সেসব গোপনে এক হাত থেকে আরেক হাতে, এক ভান্ডার থেকে আরেক ভান্ডারে চলে যাওয়াই চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে।
ইতিহাসে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের হীরার নামটি এসেছে প্রথম। রত্নবিশারদেরা ঠিক কীভাবে সেটিকে শনাক্ত করেন, তা জানা যায় না। এর রং কিংবা কাটিং সম্পর্কে কোথাও কিছু বলা হয়নি। ধারণা করা হয়, ৫৪৮-এর দিকে কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করে ফেরার পথে অশ্বারোহী সম্রাটের মুকুট থেকে হীরাটি হঠাৎ ধুলোর ভেতর ছিটকে পড়ে হারিয়ে যায়। কয়েক শ বছর পর গুজব রটে, খেলতে গিয়ে কাদামাটির ভেতর একটি বালক সেটি কুড়িয়ে পায়। কিন্তু পরে সেটির কোনো হদিস মেলেনি।
আরবরা ৬৩৩-এর দিকে পারস্যে আক্রমণ চালায়। এতে টিফসান প্রাসাদটি তাদের দখলে চলে যায়। সেখানে গোপন কুঠুরিতে তারা এক ধনাগারের সন্ধান পায়। লুটপাটের সময় মণিমুক্তা বসানো ১৮০ ফুট লম্বা একটি চোখধাঁধানো কার্পেট তাদের হাতে পড়ে। দামি মণিমুক্তা ছাড়াও সেটিতে বসানো ছিল সোনার পাত। তাতেই তৈরি হয়েছিল কার্পেটের যাবতীয় নকশা। আরবরা সেটিকে ছোট ছোট অংশে কেটে নিজেদের ভেতর ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। ধারণা করা হয়, চুনিপান্নার মতো চোখধাঁধানো কার্পেটটির বাহারি নকশায় বসানো ছিল একাধিক হীরা।
হীরা-জহরতে মোড়া কার্পেটের কথা শুনে আজকের মানুষের চোখ কপালে উঠতে পারে, কিন্তু সে সময়কার পারস্যের রাজ-রাজড়া কিংবা নিছক অভিজাতদের জীবনধারাই ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। বিলাসিতার নামে সোনার পানপাত্রে মদ্যপান করতেন। ধরা যাক শাহ আব্বাসের কথা। ১৫৮৭ থেকে ১৬২৯, তার রাজত্বকাল। প্রাসাদের আসবাব থেকে শুরু করে হাতবেড়িখুন্তি-সবই ছিল সোনাদানায় মোড়া। স্বর্ণের পানপাত্রের সংখ্যাই ছিল চার হাজার। সেগুলোর গায়ে বসানো ছিল হরেক রকমের মণিমুক্তা।
শাহ আব্বাস কিংবা তার পরের শাসনকর্তাদের আমলের মণিমুক্তার বেশির ভাগই আসত খোরাসান আর তুর্কিস্তানের খনি থেকে। পারস্য উপসাগর থেকে তোলা হতো সেসব। এ ছাড়া নানা দেশের রাজ-রাজড়াদের পাঠানো উপঢৌকন তো ছিলই। রানি ভিক্টোরিয়া ইরানের শাহকে উপহার হিসেবে একটি তলোয়ার দেন। তার বাঁট আর খাপে মণিমুক্তা ও সোনার কারুকাজ ছিল। তখন কৌটায় এসব রত্ন ভরে ইউরোপ থেকে জহুরিরা দেশে দেশে পর্যটনে বেরোত, শাঁর্দে আর তাভার্নিয়ে দুজনেই ছিলেন এই দলের। শাহ আব্বাসের দূতরাও ভারত, ভেনিস ও কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য রত্ন তল্পিতে ভরে তার মনোরঞ্জনের জন্য ইস্পাহানে পৌঁছে দিত।
সম্ভবত ১৩০৪-এর দিকে মালওয়ার রাজার হাতে আসে ১৮৬ ক্যারেট ওজনের একটি বিশাল হীরা। এটিই ২২২ বছর পরে, ১৫২৬-এ, আগ্রা লুটের সময় মোগল প্রধান বিজয়ী বাবরের হাতে চলে যায়। কিংবদন্তি বলে, সম্রাট আকবরের সমাধির কাছে মার্বেল পাথরের যে বেদিটি আছে, সেখানে বসানো ছিল এই হীরা। এটিই সেই অসংখ্য গল্প-কাহিনির উৎস কোহিনূর মণি, পরের দিকের দুই শ বছর বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে মূল্যবান হীরা।
১৭৩৬-এ সুলতান হোসেনের জায়গায় এলেন নাদির শা। হীরার প্রতি তারও ছিল দুর্বলতা। তার কিছুদিন আগে আফগান আক্রমণে ইস্পাহানের রত্নভান্ডারের গৌরব স্তিমিত হয়ে গেলেও সে খবর মোগলদের কানে গিয়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে তাদের রাজধানী দিল্লির বিপুল হীরা-জহরতের তথ্যও জেনেছিল নাদির। এ সময় ইস্পাহানের ভান্ডার থেকে বেশ কয়েকটি দামি রত্ন খোয়া যায়। যে কারণেই হোক, ১৭৩৯-এ নাদিরের আক্রমণে দিল্লির পতন ঘটে। কিন্তু কোহিনূর পেতে ব্যর্থ হন তিনি। শেষ পর্যন্ত মোগল সম্রাটের হারেমের একজন রূপসীর বিশ্বাসঘাতকতায় হীরাটির গোপন তথ্য নাদিরের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। প্রাচীন ভারতীয় কায়দায় তিনি পরাজিত মোগল সম্রাটকে এক ভোজে আপ্যায়িত করেন, রীতি অনুযায়ী তাকে পাগড়ি বিনিময়ের অনুরোধ জানান। মোগল সম্রাট কোহিনূরকে লুকিয়ে রেখেছিলেন তার পাগড়ির ভেতর; সেটি বিনিময়ের সময়ই লুকোনো রত্নটি মেঝেতে পড়ে যায়। এভাবেই কোহিনূর নাদিরের সঙ্গে পারস্যে চলে যায়। দিল্লির প্রাসাদ থেকে আরও হীরা-জহরত লুট করে ইস্পাহানে স্তূপাকার করা হয়। যেমন আকবর শাহ-জলরঙের হীরা, বাহাত্তর ক্যারেটের মতো ওজন; দরিয়া-ই-নূর-হালকা লাল রঙের হীরা, ওজনে ১৮৫ ক্যারেট; গোলকুন্ডা-দ্য-অর-প্রায় সাড়ে পঁচানব্বই ক্যারেট। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম এমারেল্ডকাট হীরা; গ্রেট মোগল-২৮০ ক্যারেট ওজনের জলরং হীরা; গ্রেট টেবল্-হালকা লাল রঙের টেবিলকাট হীরার জোড়া, একটির ওজন ১৮৫ ক্যারেট, অপরটির ৬০ ক্যারেট-উল্লেখযোগ্য।
শুধু এগুলো নয়, মোগল সম্রাটের মহামূল্যবান মণিমুক্তাখচিত ময়ূর সিংহাসনটিও নাদির পারস্যে নিয়ে যান। অসংখ্য হীরা-জহরতের মধ্যে ‘শাহ্’, ‘আকবর শাহ্’ কিংবা ৮৩ ক্যারেট ওজনের হীরা ‘জাহাঙ্গীর’ বা ৯০ ক্যারেট ওজনের জলরং হীরা ‘থোর্ন’ সবই ছিল তাতে। কেবল এ থেকেই ধরে নেওয়া যায়, ময়ূর সিংহাসনের দাম কারও পক্ষেই কখনো কষে দেখা খুব সহজ হবে না।
নাদির উপঢৌকন হিসেবে কিছু কিছু মণিমুক্তা পাঠাতে শুরু করলেন বিভিন্ন দেশের অধিপতি কিংবা সম্রাটদের নামে। এদের মধ্যে রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথরিন আর তুরস্কের সুলতান মাহমুদও ছিলেন।
কয়েক বছর পর নির্মমভাবে খুন হলেন নাদির শা। আহমেদ শাহ আবদালি ক্ষমতা দখল করলেও শাসনকাজ চালাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে পালানোর সময় বেশ কিছু হীরা-জহরতের সঙ্গে কোহিনূরও নিয়ে যান। শিখযুদ্ধের কিছুকাল পরে আংশিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটিকে হস্তগত করে। কার্ল মার্ক্স ভারতবর্ষের ইতিহাসের যে কালপঞ্জি লিখে গেছেন, তাতেও উল্লেখ আছে এই ঘটনার।
১৮৫০-এর দিকে রানি ভিক্টোরিয়াকে উপহার দেওয়া হয় কোহিনূর। তিনি হীরাটিকে নতুন করে কাটাতে পাঠালেন আমস্টারডামে। পরে এর ওজন হয় ১০৯ ক্যারেট। ৭৭ ক্যারেট ছেঁটে ফেলার পর চতুর্গুণ বেড়ে যায় কোহিনূরের দ্যুতি। হীরাটিকে ভারতবর্ষের উপহার হিসেবে ভিক্টোরিয়া ব্যক্তিগত অলংকার সামগ্রীর মধ্যে রাখেন। তিনি এটিকে উইল করে যান তার ছেলের ভাবী-বধূর নামে। ১৯০২-এ রানি আলেকজান্দ্রা তার অভিষেকের সময় উইল অনুসারে কোহিনূর লাভ করেন। ১৯১১-তে রানি মেরির অভিষেকে একটা নতুন মুকুট তৈরি করানো হয়, যার মধ্যমণি হিসেবে জায়গা দখল করে কোহিনূর। ১৯৩৭-এ সেটি চলে আসে রানি এলিজাবেথের মুকুটে। এখন লন্ডন টাওয়ারে রানির মুকুটের অন্য সব হীরা-জহরতের সঙ্গে কোহিনূরও নিয়মিত দেখানো হচ্ছে।
সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময় থেকেই নাকি পারস্য এবং ভারতবর্ষে হীরা-জহরতের বিনিময় শুরু হয়। এলেনর অব এ্যাকাইতান তার প্রথম স্বামী ফ্রান্সের সপ্তম লুইকে নিয়ে যখন দ্বিতীয় ক্রুসেডের নেতৃত্ব দেন, তখন তার গলায় শোভা পেত বড় একটা হীরা। এটির ওজন ছিল ৯০ ক্যারেটের কিছু বেশি, জলরঙের, ‘ব্রিয়োলেটে অব ইন্ডিয়া’-পরে তিনি তার ছেলে রিচার্ডকে এটি দিয়ে দেন। তৃতীয় ক্রুসেডে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় মাকে অনুসরণ করে রিচার্ডও এটিকে গলায় ঝুলিয়ে রাখেন। তবে শেষ পর্যন্ত ‘ব্রিয়োলেটে অব ইন্ডিয়া’ তার হাতছাড়া হয়ে যায়। অস্ট্রিয়ার চতুর্থ হেনরির হাতে বন্দি হবার পর মুক্তিপণ হিসেবে হীরাটিকে দিয়ে দিতে হয় তাকে।
ষোড়শ শতাব্দীতে নতুন করে আবার আবির্ভাব ঘটে হীরাটির। ফ্রান্সের দ্বিতীয় হেনরি সেটি উপহার দেন দিয়ান-দ্যু-প্যতিয়াকে। দিয়ান ছিলেন হেনরির রক্ষিতা। হীরাটি হেনরির হাতে কীভাবে আসে, তা জানা না গেলেও দিয়ান সেটি লাভ করার পর যথেষ্ট খ্যাতি কুড়িয়েছেন ইতিহাসে: তার প্রোর্ট্রেটে এই রত্নটির সঙ্গেই তিনি জ্যোতির্ময়ী হয়ে আছেন।
তারপর আবার চার শ বছর। এই সময় ‘ব্রিয়োলেটে অব ইন্ডিয়া’ শেষবারের মতো নতুন করে হারিয়ে যায়। ১৯৫০-এ হীরাটির সন্ধান পাওয়া যায় এক ভারতীয় মহারাজার কাছে। নিউইয়র্কের প্রখ্যাত জুয়েলার ‘হ্যারি উইনস্টন’ বিপুল মূল্যে হীরাটি কিনে নেয়।
তাভার্নিয়ের সতেরো শতকে বিস্ময়কর হীরা-জহরতের বিবরণ লিখে গেছেন। তার বৃত্তান্তের সূত্র ধরে কিছু কিছু শনাক্ত করা গেলেও এখন পর্যন্ত হদিস মেলেনি বহু রত্নের। ‘আহমেদাবাদ’, ‘বেনিয়ান’ ১০৪ ক্যারেটের ‘বাজু’, ৬৩ ক্যারেটের ‘কোলার’-সবই লাপাত্তা হয়ে গেছে। ‘বেন্তাম’ নামের আরও একটি হীরার কথা বলে গেছেন তাভার্নিয়ে, একজন দেশীয় রাজার তলোয়ারের বাঁটে এই বড়সড় পাথরটি শোভা বিকিরণ করত। আওরঙ্গজেবের কোষাগারে গচ্ছিত ছিল জলরঙের হীরা-‘হাট’। বলা হয়েছে, স্বচ্ছতার দিক থেকে এটি ছিল তুলনাহীন। আরও দুটি কুশনাকৃতির ভারতবর্ষীয় হীরার কথা জানা যায়। জলরঙের ‘ম্যাসকারেনহাস’। মালিক ছিলেন তখনকার গোয়ার পতুর্গিজ শাসনকর্তা। ‘অরলফ’-এরও যথেষ্ট স্তুতি গেয়েছেন তাভার্নিয়ে; ত্রিচিনাপলীর কাছে শ্রীরঙ্গমের মন্দিরে শ্রীরঙ্গ দেবতার উজ্জ্বল চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হতো এটি। পরে কর্ণাটক যুদ্ধের সময় এক ফরাসি যোদ্ধা তা নিয়ে যায়। প্রায় এক শ বছর পরে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটকে হীরাটি উপহার দেওয়া হয়। তিনি সেটি রাজকীয় প্রতীক জোড়া ঈগলের মাথায় বসানোর ব্যবস্থা করান। তাভার্নিয়ের বিবরণে পাওয়া যায়, ‘স্যাভয়’ হীরাটি মুকুটমণি হিসেবে এখনো স্যাভয় হাউসে রাখা আছে, ৫৪ ক্যারেট এর ওজন। ৪৩ ক্যারেটের ‘রৌলকুন্ডা’ হীরাটিও ভারতবর্ষীয়; নামকরণও হয়েছিল দেশের মাটিতে। ১০৩ ক্যারেটের খন্ড থেকে ছাঁটকাটের পর বের করা হয় রৌলকুন্ডার ভুবনজয়ী রূপ। ‘গ্রেট মোগল’ হীরাটি পাওয়া গিয়েছিল গানি খনিতে। দিল্লি লুটের পর সেটিও পারস্যে নিয়ে যান নাদির শাহ। রোজকাটের এই অবিশ্বাস্য হীরাটি গোল ধরনের হলেও এর একটা দিক ছিল আধখানা ডিমের মতো কিছুটা লম্বাটে। গ্রেট মোগল রাখা ছিল আওরঙ্গজেবের কোষাগারে। তাভার্নিয়ের নিজেরও ছিল প্রগাঢ় নেশা মণিমুক্তা সংগ্রহের, ব্যবসা তো ছিলই। ১৬৬৯-এর দিকে ভারতবর্ষে থাকার সময় তার চোখে পড়ে অদ্ভুত এক হীরা। রং ছিল অপরাজিতার মতো গভীর নীল, ওজনে এক শ সাড়ে বারো ক্যারেট। তাভার্নিয়ে প্রেমে পড়ে যান এই হীরাটির। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি এটিকে কিনে ফেলেন। হীরাটির নীল রং যতই শান্ত আর মোহময়ই হোক না কেন, কিছুদিনের মধ্যেই এর ডাকিনীমূর্তি বেরিয়ে পড়ে। একের পর এক অদ্ভুত সব বিপর্যয়ের মুখে পড়তে থাকেন তাভার্নিয়ে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যত শিগগির সম্ভব, এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ততই ভালো। বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে এই নীল রত্নটি তিনি ফ্রান্সের ষোড়শ লুইয়ের কাছে গছিয়ে দেন। তখন এর নাম রাখা হয় ‘ব্লু, ডায়মন্ড অব দ্য ক্রাউন’। লুই এক শ সাড়ে বারো ক্যারেট ওজনের এই হীরাটিকে নতুন করে কাটার নির্দেশ দেন। তিন টুকরোয় কেটে ফেলে জহুরিরা। নতুন করে তিন ভাগের তিনটি নাম রাখা হয়-‘বার্নসউইক ব্লু’, ‘পিরে’ আর ‘হোপ’। ‘বার্নসউইক ব্লু’ হীরাটি বার্নসউইকের এক ডিউকের হাতে থাকলেও ‘পিরে’-এর মতো এটিও হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। ‘হোপে’র ওজন ছিল সাড়ে চুয়াল্লিশ ক্যারেট। কোহিনূর-এর পর এই হীরাটিই বারবার পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছে।
শুরু থেকেই হোপের কুহকী চরিত্রের কথা সবার জানা। অনুমান করা হয়, ভারতবর্ষের একটি মন্দিরের দেবমূর্তি থেকে এটিকে সরানো হয়, হোপ ছিল দেবতার চোখ; মন্দিরের সম্ভ্রম নষ্ট করার জন্যই এই কালরোষের জন্ম বলে ধারণা করা হয়। হোপের চরিত্রের সঙ্গে এলান পোর গল্পের অসাধারণ মিল আছে, কিংবা সাদ থেকে যে নতুন রোমান্টিসিজমের জন্ম, তার সঙ্গেও এর চরিত্রগত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
ষোড়শ লুই অসুখী রানি ম্যারি আন্তোনিয়েত্তিকে এই নীল হীরাটি উপহার দেন। সেটি হাতে আসার পর থেকেই শতেক রাজকীয় গোলমালের মধ্যে পড়তে থাকেন আন্তোনিয়েত্তি; তার জীবন বলতে গেলে বিষময় হয়ে ওঠে। একের পর এক জটিল সব চক্রান্তের শিকার হন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাকে প্রাণ দিতে হয় গিলোটিনে।
১৭৯২-এর দিকে এক ডাকাতিতে আরও সব রাজকীয় মণিমুক্তার মতো হোপও দীর্ঘদিনের অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। সেটি আবার আবির্ভূত হয় ১৮৩০-এ, লন্ডনে। এ সময় আরেকবার একে কাটা হয়-কুশনাকৃতির। হেনরি ফিলিপ নব্বই হাজার ডলারের বিনিময়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য এটি কিনে নেন।
১৮৩০-এ হেনরি ফিলিপ মারা যাওয়ার পর তার ভাইপো টমাস হোপ এটির মালিক হন। তার হাত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আসে ফ্রান্সিস হোপের হাতে। একেবারে সর্বস্বান্ত হবার ঠিক আগের মুহূর্তে, ১৯০৬-এর দিকে, হীরাটিকে বেচে দিয়ে এর কালদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করেন ফ্রান্সিস।
এই সময় পূর্ব ইউরোপের একজন যুবরাজ হীরাটিকে লুফে নেন। অভিনেত্রী বাঁর্জের সঙ্গে তখন তার পুরোদস্তুর দহরম-মহরম। যুবরাজ তাকে রত্নটি উপহার দিলেন। লোরকার সেই ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতাটির কথা তোলা যেতে পারে, কর্দোভায় কখনোই পৌঁছানো যাবে না, বড় নিঃসঙ্গ কর্দোভা; কে জানত, এই চোখ-ভোলানো হীরাটিই হবে সুন্দরী বাঁর্জের মর্মান্তিক অপঘাতে মৃত্যুর একমাত্র কারণ। কিছুদিনের মধ্যেই সন্দেহকাতর যুবরাজ নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করে বাঁর্জেকে। পরে তিনিও এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় সপরিবার নিহত হন।
তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল জামিদ জেদ করে ১৯০৮-এ হীরাটিকে কিনে নেন। কিন্তু বিপর্যয় ঠেকানো তার পক্ষেও সম্ভব হলো না। কিছুদিনের মধেই দেশে এক ভয়াবহ বিপ্লব ঘটে; ফলে সিংহাসন হারালেন জামিদ।
হোপ আবার ফিরে আসে প্যারিসে। আনেন পিয়েরে কার্টিয়ার। ১৯১১-তে ওয়াশিংটন ডিসির মিসেস ম্যাকলিনের কাছে হোপকে গছিয়ে দেন কার্টিয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই যথারীতি নৃশংস খুনখারাবিতে মেতে ওঠে কুহকী হোপ। এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে একই সঙ্গে তার দুটি সন্তান পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। মৃত্যু ঘটে স্বামীরও; বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাগলা গারদে।
মিসেস ম্যাকলিন ছিলেন ভীষণ জেদি প্রকৃতির, তিনি চেয়েছিলেন হোপের কীর্তিকলাপের শেষ দেখতে। তার মৃত্যুর পর, ১৯৪৭-এ এটি হাতে পাবার জন্য অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন, কিন্তু এর সর্বনাশা মেজাজের কথা ভেবে গড়িমসি করতে থাকেন সকলেই। শেষ পর্যন্ত, ১৯৪৮-এর দিকে হ্যারি উইনস্টন ১৭ হাজার ৯২০ ডলারের বিনিময়ে হীরাটি কিনে নেন। কিন্তু ভরসা পেলেন না নিজের কাছে রাখার; তিনি এটিকে স্মিথসোনিয়াম ইনস্টিটিউটে উপহার হিসেবে দিলেন। দশ লাখ ডলার বিমার বিনিময়ে এখনো সেটি দেখানো হচ্ছে।
গোলকুন্ডার খনি থেকে বড় রকমের হীরা তোলার শেষ সংবাদ পাওয়া যায় ১৮৩৫-এর দিকে; হীরাটির ওজন ছিল ১৭৭ ক্যারেট; জলরঙের। হায়দরাবাদের নিজাম রত্নটি কিনে নেন। তার নামানুসারেই হীরাটি ‘নিজাম’ বলে পরিচিত হয়। মোট কথা, উনিশ শতকের মধ্যেই নিঃশেষিত গোলকুন্ডার গৌরব ম্লান হয়ে আসে; দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ব্রাজিল এখন গোলকুন্ডার সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম হীরার সন্ধান মেলে ১৮৬৬-র দিকে। এ নিয়ে একটা গল্প আছে। এরামুস জ্যাকব নামে কৃষক পরিবারের একটি ছেলে হোপটাউনে তাদের বাড়ির কাছাকাছি অরেঞ্জ নদীর ধারে হঠাৎ একদিন একখন্ড পাথর কুড়িয়ে পায়। সেটা ছিল দ্যুতিময়। সে তার মাকে এনে দেয় পাথরখন্ডটি। সরলমতি চাষি মা তুলে রাখার খাতিরেই এটি এক পাশে ফেলে রাখে। মাসখানেক পরে, এরামুসের মা সেটি এক প্রতিবেশীর হাতে তুলে দেয়, উদ্দেশ্য ছিল বিক্রি করা। প্রতিবেশী শ্যাক-ভ্যান-নেকার্ক নামমাত্র দামে কিনে নেয়। নুড়িটি আসলে ছিল একটা হলুদ রঙের অমসৃণ হীরা, তখন তার ওজন সাড়ে একুশ ক্যারেটের মতো। এরামুসের পাওয়া এই হীরাটিই এখন ‘ইউরেকা’ নামে সারা দুনিয়ায় পরিচিত।
১৮৬৯-এর দিকে অরেঞ্জ নদীর কোলের খামারের এক রাখাল ছেলের কাছে এরামুসের মতোই আরও একটি উজ্জ্বল নুড়ির সন্ধান পায় নেকার্ক। পাঁচ শ ভেড়া দশটা ষাঁড় আর একটা ঘোড়ার বদলে নেকার্ক শেষ পর্যন্ত নুড়িটি কবজা করে। পাথরটি ছিল জলরঙের, ওজনে সাড়ে তিরাশি ক্যারেট। ওস্তাদ কাটার লুই হোন্ড ৫৬ হাজার ডলারের বিনিময়ে হীরাটি নেকার্কের কাছ থেকে কিনে নেন। শেষ পর্যন্ত এর ওজন দাঁড়ায় সাড়ে সাতচল্লিশ ক্যারেট। ছাঁটকাট করে এর অপরূপ মহিমাকে জগতের সামনে তুলে ধরেন হোল্ড; নাম রাখা হয় ‘স্টার অব সাউথ আফ্রিকা’।
হীরাটির রূপে মুগ্ধ হন ডাডেলের কাউন্টেস। এক লাখ পঁচিশ হাজার ডলারে হোন্ডের কাছ থেকে সেটিকে কিনে নেন তিনি। মাথার চুলের গয়নায় আরও গুঁড়া গুঁড়া পঁচানব্বইটি মণিমুক্তার মাঝখানে হীরাটি বসিয়ে একে ব্যবহার করতে থাকেন কাউন্টেস।
এই কেনাবেচার খবর খুব অল্প দিনের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হীরা অনুসন্ধানীদের দল ছুটে আসতে থাকে অরেঞ্জ নদীর দিকে। শুরু হয় তন্নতন্ন করে খোঁজা। তারপর ১৮৭০-এ আগ্নেয়গিরির নালার ওপর প্রথম সন্ধান মিলল একখন্ড হীরার। সেই হচ্ছে শুরু। এখন পর্যন্ত একটার পর একটা উন্নত মানের হীরা তোলা হচ্ছে সেখান থেকে।
সেখানে খুব অল্প দিনের মধ্যে আরও কয়েকটি হীরার খনি খুঁজে পাওয়া যায়। ‘দ্য-বিয়ারস’, ‘কিম্বার্লি’, ‘কোফিফোনটেন’, ‘ওয়েজেলটন’ খনিগুলোর সব কটিই আবিষ্কৃত হয়ে যায় ১৮৯০-এর মধ্যেই। গত শতাব্দী শুরু হবার আগেই ট্রান্সভালে প্রিটোরিয়ার খুব কাছে বিশ্ববিখ্যাত ‘প্রিমিয়ার’ সুড়ঙ্গও সন্ধানীদের আয়ত্তে চলে আসে।
‘কিম্বার্লি’ খনি এগারোটি কোম্পানি আর আটজন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যায়। একইভাবে গড়ে ওঠে একাধিক প্রতিষ্ঠান। পরে নানা রকমের স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে কোম্পানিগুলো চালানোর ব্যাপারে জটিলতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ‘দ্য-বিয়ারস’-এর সর্বময় কর্তৃত্বাধীনে ছেড়ে দেওয়া হয় হীরার সব খনিকে। এরাই এখন পৃথিবীর বাজারে শতকরা পঁচাশি ভাগ হীরার বিক্রেতা।
এসব খনির মধ্যে ‘প্রিমিয়ারে’র মতো বিস্তৃত সুড়ঙ্গও রয়েছে। এর ওপরের ব্যাস আধা মাইলের বেশি। উন্নত মানের হীরার উৎসমুখ হিসেবে কোনো জুড়ি নেই প্রিমিয়ারের; ঔজ্জ্বল্য আর স্বচ্ছতার দিক থেকে এখানকার হীরাগুলো শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। ইদানীং হীরার ব্যবসা লন্ডন থেকে সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশন [সংক্ষেপে সিএসও] মারফত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়; আজেবাজে লোকের হাতে নুড়িগুলো যাতে না পড়ে, সেদিকে এদের তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে, একমাত্র রেজিস্ট্রি করা কাটাররাই রাফস্টোনস কিনতে পারেন। দক্ষতার অভাবে অনেক হীরা নানা সময় গোঁজামিল দিয়ে কাটাই করা হয়েছে; গোড়ায় উন্নত জাতের হলেও কাটাই-এর ব্যাপারে শিল্পদৃষ্টির অভাবে সেগুলো চলে গেছে পেছনের সারিতে।
এখন খ্যাতির চূড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ‘টিফেনি’, ‘একসেলয়ির’, ‘কুলিনান’- সবই পাওয়া গেছে এখানে। ‘টিফেনি’ পাওয়া যায় কিম্বার্লি খনিতে, ১৮৭৮-এ ওজনে সাড়ে এক শ ক্যারেট। এখনো এটাই পৃথিবীর বৃহত্তম সোনালি হীরা হিসেবে বিখ্যাত। এর কাটাই হয়েছিল প্যারিসে, কুশনাকারে। ‘টিফেনি’র এখনকার দাম বিশ লাখ ডলারের মতো।
১৯০৫-এ আবিষ্কৃত হয় ‘কুলিনান’। এটির আগ পর্যন্ত ৯৯৫ ক্যারেট ওজনের ‘একসেলয়ির’কেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা বলে ধরা হতো। কুলিনান আবিষ্কৃত হবার পর সবার মাথা ঘুরে যায়, এ এক অবিশ্বাস্য হীরা। রাফ খন্ড থাকতে যার ওজন ছিল ৩১০৬ ক্যারেট। জলরঙের এই হীরাকে পাওয়া গিয়েছিল প্রিমিয়ার খনিতে। কুলিনান উপহার দেওয়া হয় ইংল্যান্ডের সপ্তম এডওয়ার্ডকে।
জোহানেসবার্গ হীরার আধুনিক ইতিহাসের সর্বোচ্চ মূল্যে জনৈক কাটারের কাছে ‘প্রিমিয়ার রোজ’ বিক্রি হয়ে গেছে বলে ‘দ্য-বিয়ার্স’-এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। গলফ বলের মতো বড় এবং ৩৫৩.৯ ক্যারেট ওজনের এই অতুলনীয় হীরাটি গত শতকের সত্তরের দশকে পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিমিয়ার খনিতে।

মডেল: অভিনেত্রী তানজিন তিশা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব ও জুয়েলারি: যাভ্রী
ছবি: জিয়া উদ্দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top