ফুড ট্রাভেল I রোড টু রয়েল ফুড
নবাবি খাবারের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে শহরটির সবখানে। ঐতিহ্যের পরম্পরায়। যা রক্ষা করাই এখানকার প্রধান একটি ব্রত। ঘুরে এসে জানাচ্ছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর নূর
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্ণৌর দুর্ভিক্ষের সময় বড় ইমামবাড়া নির্মাণের বিনিময়ে প্রজাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন নবাব আসাফুদ্দৌল্লা। বড় বড় হাঁড়িতে চাল, মাংস, ঘি এবং মসলা একত্রে দিয়ে কাঠের আগুনের ডিমে আঁচে রান্না হয়। সৃষ্টি হলো দমপখ্ত আউধি বিরিয়ানি। বিশ্ব জয় করে নিল এই খাবার। ওয়াহিদ বিরিয়ানিতে এসেছি সেই দমপখ্ত আউধি খেতে। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম। এটি ছোট পরিসরের হলেও বিক্রিতে শীর্ষে। কাউন্টারে রেস্তোরাঁর মালিক বসে ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে কীভাবে বিরিয়ানি রান্না হয়, তা বললেন। তিনি জানালেন, চাল আধা সেদ্ধ করে, তার মধ্যে আলাদাভাবে রান্না মাংস পরতে পরতে সাজিয়ে, মসলা, ঘি, ইয়াখ্নী (ঝোল), জাফরান দিয়ে দমে বসানো হয়। বিরিয়ানি এককথায় অতুলনীয়। প্রতিটি চাল ঝরঝরে এবং ভেতরে মাংসের নির্যাস। পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে খাবার শেষ করলাম। আবদুল হালিম শরর তার ‘পুরোনো লক্ষ্ণৌ’ গ্রন্থে হাকিম সাহেব নামে একজন ধনী ও শৌখিন ব্যক্তির একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ওই ব্যক্তি হালিম শররের পিতাকে একদিন সকালে নাশতার নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সঙ্গে হালিম শররও গিয়েছিলেন। ‘একজন পালোয়ানকে নিমন্ত্রণ করেছি; আপনারাও আসুন, মজা দেখবেন।…ওখানে গিয়ে শুনলাম, পালোয়ানটি রোজ সকালে কুড়ি সের করে দুধ খান, তারপর আড়াই সের আটার রুটি এবং মাঝারি আকারের একটা পাঁঠা।…তিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন “নাশতা”-র জন্য।…হাকিম সাহেব তখন “এখুনি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি” বলে অন্দরে চলে গেলেন। সেখানে আরও দেরি করলেন। যখন দেখলেন, পালোয়ানটি আর খিদে সহ্য করতে পারছেন না, তখন দাসীর হাত দিয়ে একটা থালা পাঠিয়ে দিলেন। তাই দেখে পালোয়ান সাহেবের “জান মে জান” (ধড়ে প্রাণ) এল। কিন্তু যখন খুললেন, দেখলেন, একটি ছোট “তশ্তরী”, তাতে অল্প একটু পুলাও-এক ছটাকের বেশি হবে না বোধ হয়।…উঠে, চলে যাওয়াই স্থির করলেন। সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনোরকমে তা ঠেকানো হলো। বাধ্য হয়ে তিনি সেই রেকাবি উঠিয়ে মুখে ঢেলে দিলেন পুলাও, মুখ না চালিয়েই গিলে ফেললেন। পাঁচ মিনিট। জল চাইলেন। তার পাঁচ মিনিট পরে আবার জল খেলেন। ঢেঁকুর তুললেন।…খাবার পরিবেশিত হলো। হাকিম সাহেবের সামনে প্লেটে রাখা হলো দেড় পোয়া চালের সেই পুলাও, যার এক গ্রাস আগে পাঠানো হয়েছিল। হাকিম সাহেব প্লেটটা ধরে দিলেন পালোয়ানের সামনে, এবং বললেন, “দেখুন তো এটা কি ওই পুলাও, না আলাদা?” তিনি স্বীকার করলেন, “সেটাই।” হাকিম সাহেব বললেন, “তাহলে আরম্ভ করুন। আমার দুঃখ রইল, এটা তৈরি করতে দেরি হয়ে গেল, আপনাকে কষ্ট দিলাম।” পালোয়ান বললেন, “এবার তো আমাকে মাফ করতে হয়। ওই প্রথম গ্রাসেই আমি তৃপ্ত হয়ে গেছি। আর একটা চালও খেতে পারব না।” বারবার অনুরোধ করা হলো। প্রতিবারই তিনি হাত তুলে বাধা দেন আর বলেন, “খাব কী করে? পেটে জায়গা থাকলে তবে তো?” তখন হাকিম সাহেব নিজে সব টেনে নিলেন, এবং তাঁকে বললেন, “কুড়ি সের ত্রিশ সের খেয়ে যাওয়াটা মানুষের খাদ্য নয়, গরু-মোষের খোরাক। মানুষের খোরাক হলো, কয়েক গ্রাস খাবে, তা থেকেই এমন শক্তি-সামর্থ্য হবে, বিশ-ত্রিশ সের আনাজ খেয়েও যা হয় না। এর এক গ্রাসেই আপনি তৃপ্ত হয়ে গেলেন।’
এখনকার খাবারের পুষ্টি বিচারে সেই সময়ে খাদ্যাভ্যাস শরীরের পক্ষে হয়তো হিতকর ছিল না। তখন ভোজনরসিকদের কাছে ভালো খাবারের সংজ্ঞা ছিল ভিন্ন। তা হবে সুস্বাদু, তারপর পুষ্টিকর ও গরিষ্ঠ। কিন্তু খাদ্যের মসলা নির্বাচনের সময় তার অনুপাত সঠিকভাবে নির্ধারণ করাই ছিল ভালো বাবুর্চির পরিচয়। নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দরের শাসনামলে তার এক বাবুর্চি বাদাম ও পেস্তা দিয়ে খিচুড়ি রান্না করতেন। বাদামকে কেটে বানাত চাল, পেশতাকে করত ডাল। এমনভাবে এই খিচুড়ি রান্না হতো। সবাই ভাবত, এটি গোটা মাষকলাইয়ের খিচুড়ি। কেউ একবার খেলে সারা জীবনে ভুলতে পারত না।
ব্রিটিশরা লক্ষ্ণৌর স্থাপত্যকে ধ্বংস করে দিলেও সেখানকার রন্ধনপ্রণালির বিলুপ্তি ঘটাতে পারেনি। সেখানকার অধিবাসীরা এখনো তাদের ঐতিহ্য, বিশেষ করে সহবত ও খাদ্যকে যত্নের সঙ্গে লালন করছে। কলকাতা বা দিল্লির মতো মোড়ে মোড়ে চাউমিন, ফাস্ট ফুডের দোকানের আধিপত্য দেখিনি। বড় বড় শপিং মলে বিশ্বের বিখ্যাত ফাস্ট ফুড কর্নার থাকলেও একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত কাবাবের দোকানগুলো রয়েছে এবং সেগুলোতেই ভিড় বেশি।
ওয়াহিদ বিরিয়ানি থেকে বের হয়ে সামনে আমিনাবাদ চৌরাস্তার পাশেই বিখ্যাত ‘প্রকাশ কুলফি’র দোকান। এরা এখনো নবাবি ধারায় সেটি তৈরি করছে। কুলফির অর্ডার দিলাম। লালসালু মোড়া বড় মাটির মটকাতে টিনের ছাঁচে সেগুলো জমানো হয়েছে। একটি প্লেটে কুলফি কেটে কেটে তার ওপরে সেদ্ধ করা নুডলসের মতো সেমাই এবং রোজ সিরাপ দিয়ে পরিবেশন করল। মুখে দিতেই বুঝলাম, ঘন দুধের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার বাদাম ও জাফরানে এটি তৈরি।
আমিনাবাদ থেকে এবার যাত্রা হযরতগঞ্জের দিকে। লক্ষ্ণৌর অভিজাত এলাকা। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল পাঁচটা বাজল। এখানেই ছিল একসময়ের বিখ্যাত হযরতবাগ। এখন এই রাস্তার দুধারে রয়েছে লক্ষ্ণৌর অভিজাত শপিং মল, ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া সিনেমা হল, প্রধান পোস্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ সময়ের লক্ষ্ণৌকে যদি ভাগ করা হয় তবে একদিকে হযরতগঞ্জ, সাহেবপাড়া, আমিনাবাদ ও চক নবাবি ঐতিহ্যের এলাকা, অন্যদিকে গোমতী নগর আধুনিক শহর।
মহাত্মা গান্ধী মার্গের দুই রাস্তার দুপাশে রেস্টুরেন্ট, মার্কেটসহ চিকনকারীর বড় বড় শোরুম। বিকেল হলেই লোকজনের বেশ ভিড়। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ‘রয়েল ক্যাফেতে’। এটি মূলত একটি ভেজিটারিয়ান চাটের রেস্টুরেন্ট। পুরো ভারতেই এই ক্যাফের জনপ্রিয়তা রয়েছে। এখানে পালংচাট, বাস্কেট চাট, আলুটিক্কিসহ বিভিন্ন চাট রয়েছে। এদের বিখ্যাত বাস্কেট চাটের অর্ডার দিলাম। যিনি বানাচ্ছেন, তিনি চাট কিং নামেই খ্যাত। আলু দিয়ে বানানো, ডিপফ্রাইয়ের মাধ্যমে বাস্কেট তৈরি করা হয়েছে। বাস্কেটে টক দই, তেঁতুল, ঝুরি ভাজা, ছোলা, আনার দানাসহ বিভিন্ন প্রকার মসলা দিয়ে বানানো এই চাট। এত ভালো লাগল যে পুনরায় পালং চাট অর্ডার দিলাম। মচমচে বেসনে ভাজা পালংয়ের ওপর মসলা, টক দই, তেঁতুল, ঝুরি ভাজা দিয়ে পরিবেশন করা হলো। মনে হয়, এটাকেই বলে লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। ক্যামেরা দেখে শেফ জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এসেছি। বাংলাদেশ শুনে নিজে এসে ছবি তুললেন এবং চাট কেমন লেগেছে জানতে চাইলেন। একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—নবাবি রন্ধনশৈলীতে বিভিন্ন ধরনের চাটেরও বিশেষ একটি স্থান ছিল।
সিটি অব নবাবে তৃতীয় দিন। সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য, লালবাগের ত্রিলোকে ‘শর্মাজি টি স্টলে’ নাশতা খাওয়া। লক্ষ্ণৌর সবচেয়ে বিখ্যাত চায়ের দোকান এটি। ভোর হওয়াতে রাস্তা ফাঁকা, দ্রুতই পৌঁছে গেলাম। শর্মাজি টি স্টল বিখ্যাত সকালের চা এবং সঙ্গে বানমাস্কা ও সামুসের জন্য। এখানে ঘন দুধ দিয়ে চা তৈরি করা হয়। গরম বানের ভেতরে মাখন এবং চিনি মিশিয়ে বানমাস্কা। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সমগ্র ভারতে শিঙাড়াকে সামুসে বলা হয়। এখানে পদটি তৈরির প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন। আলু সেদ্ধ কুচি করে কেটে মসলা দিয়ে ভুনা হয়। শিঙাড়ার আকারও তিন কোনা নয়, গোল। নাশতা শেষ করে যাত্রা ক্যয়সরবাগ। সেখানকার স্থাপনা দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। দ্রুতই চলে এলাম চকে দুপুরের খাবারের জন্য। খাব লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত ‘গলৌতি কাবাব’। চকে ‘তুন্ডে কাবাবী’তে গিয়ে দেখলাম, কাবাব বিক্রিতে তখন বিরতি চলছে; পুনরায় সন্ধ্যায় খুলবে। দোকান থেকে বলল, ‘আপনারা আমাদের আমিনাবাদ শাখায় চলে যান, সেটি খোলা পাবেন।’ দ্রুতই বের হয়ে আমিনাবাদের উদ্দেশে যাত্রা করলাম।
দশম নবাব আমজাদ আলী শাহর প্রধানমন্ত্রী আমীনউদ্দৌলা নিজের নামে এই ‘আমিনাবাদ’ এলাকাটির সূচনা করেন। সেখানে ‘ওয়াহিদ বিরিয়ানী’র পাশেই ‘তুন্ডে কাবাবী’ রেস্টুরেন্ট। নিচতলায় রান্নাঘর এবং দোতলায় বসার ব্যবস্থা। সিঁড়িতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি টাঙানো, যারা এই রেস্টুরেন্টে এসে খেয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাসহ মুম্বাইয়ের ফিল্ম স্টার এবং খেলোয়াড়েরা রয়েছেন এই তালিকায়।
পার্সি শব্দ কাবব এসেছে ‘কম’ এবং ‘আব’ থেকে, অর্থাৎ যার অর্থ ‘কম’ এবং ‘পানি’। কাবাবে পানির ব্যবহার নেই। ভারতবর্ষে মুসলিমদের আগমনের আগে খাবারটির অস্তিত্ব ছিল রাজ-রাজড়াদের শিকারে গিয়ে মাংসে মসলা মেখে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার রীতিতে। এখন কাবাবের যে ধ্রুপদি ধরন, তার আগমন মুসলিমদের হাত ধরেই।
নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর মাংস খুব প্রিয় ছিল। অতিরিক্ত মাংসপ্রীতির কারণে তাকে দাঁত হারাতে হয়েছিল। নবাব ঘোষণা দিয়েছিলেন, যে এমন মাংস খাওয়াতে পারবে, যা খেতে দাঁতের প্রয়োজন হয় না, তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। এক হাতহীন হাজি মুরাদ আলি সেই পুরস্কার জেতেন। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে এই পাচক একটি হাত হারান। তিনি তুন্ডা (টুন্ডা) নামে পরিচিত ছিলেন। এক হাত নিয়ে হাজি মুরাদ এক শ ষাট প্রকারের মসলা ও শিকড় দিয়ে তৈরি করলেন নবাবের জন্য গলৌতি কাবাব। এটি তুন্ডে কাবাব নামেও পরিচিত। ‘গলৌত’ অর্থ গলে যাওয়া। মুখে দিলে আপনা-আপনি গলে যাবে, চিবাতে হবে না। হাজি মুরাদকে পুরস্কৃত করে বাবুর্চিখানার কাবাব বিভাগে নিয়োগ দিয়েছিলেন নবাব। মুরাদ আলির ছেলে ছিল আরও বেশি উদ্যমী। তিনি নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর পরামর্শ ও সহযোগিতায় চকে কাবাবের দোকান খোলেন। যেটি আজও চলমান ‘তুন্ডে কাবাবী’ নামে।
গলৌতি কাবাব ও মোগলাই পরোটা অর্ডার করলাম। ওয়েটারকে হিন্দিতে অর্ডার দিয়েছিলাম, ওয়েটার বলল, বাংলায়ও বলতে পারেন। অবাক হলাম, সে বলল, এই রেস্টুরেন্টের সব ওয়েটারই আসামের বাঙালি। এখানে দুধরনের গলৌতি কাবাব পাওয়া যায়—চিকেন ও মাটন। মোগলাই পরোটা আমাদের দেশের মতো নয়। লক্ষ্ণৌতে ময়দার সঙ্গে ডিম ও দুধ মিশিয়ে উল্টো কড়াইতে হালকাভাবে তেল দিয়ে চেপে চেপে ভেজে এই পরোটা তৈরি হয়।
নবাব গাজী উদ্দিন হায়দর অসম্ভব পরোটাভক্ত ছিলেন। বাবুর্চি প্রতিদিন তার জন্য ছয়টি পরোটার জন্য ত্রিশ সের ঘি ব্যবহার করতেন। প্রতিটি পরোটা পাঁচ সের করে ঘিতে ভাজতেন। প্রধানমন্ত্রী একদিন বাবুর্চিকে জিজ্ঞেস করল, ত্রিশ সের ঘি দিয়ে তুমি কী করো? বাবুর্চি উত্তর দিয়েছিল, পরোটা বানাই। তিনি তদারক করতে গিয়ে দেখলেন, পাঁচ সের ঘিতে প্রতিটি পরোটা ভাজার পরে তা ড্রেনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করাতে বাবুর্চি বলেছিল, এগুলোতে ঘি নেই, তেল হয়ে গেছে। বাবুর্চির ওপর বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী পরের দিন শুধু পাঁচ সের ঘি বরাদ্দ করলেন। সেই ঘি দিয়ে পরোটা তৈরি করা হলো। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পরে নবাব বাবুর্চিকে তলব করলেন। জানতে চাইলেন, পরোটা আগের মতো স্বাদের হচ্ছে না কেন? বাবুর্চি উত্তর দিল, প্রধানমন্ত্রীর হুকুম অনুসারেই পরোটা তৈরি হচ্ছে। সব ঘটনা জেনে নবাব প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করলেন। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী আর কখনো বাবুর্চির কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। নবাবরা তাদের বাবুর্চিকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করতেন। রাজকীয় হেঁসেলের দুজন বাবুর্চি আউধের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাদের একজন নবাব সুজাউদ্দৌল্লাহর বাবুর্চি হাসান রাজা খান, তিনি নবাব আসাফুদ্দৌল্লা কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। অপরজন আগা মীর, নবাব সাদত আলী খানের বাবুর্চি, তাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল নবাব গাজী উদ্দিন হায়দরের নির্দেশে।
পরোটা ও কাবাব এলো। তা যে এত নরম হতে পারে, ধারণায় ছিল না। মুখে দিলে মাংসের স্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু চিবাতে হয় না। খাবার শেষ করে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলাম কাবাব-রহস্য। ম্যানেজার বলল, মাংস ও মসলা তো আছে, ভাজা হয় বিশেষ প্রণালিতে। এটি ভাজতে যে তাওয়া ব্যবহৃত হয়, তা মোটা এবং পিতলের তৈরি। অন্যদিকে ব্যবহার করা হয় তেঁতুল কাঠের কয়লা। এই কয়লা শান্ত এবং ধারাবাহিকভাবে তাপ প্রদান করে। অন্যান্য কাঠের কয়লা স্ফুলিঙ্গ বেশি হয়। কাবাবে এত বেশি তৃপ্ত হলাম যে মিষ্টিজাতীয় কিছু আর খাওয়ার প্রতি আগ্রহী হলাম না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, দ্রুত ছুটলাম রেসিডেন্সির দিকে।
লক্ষ্ণৌ ভ্রমণ শেষে গেলাম আরেক নবাবি শহর মুর্শিদাবাদে। রাতের খাবার খেলাম রেলস্টেশনের পাশে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট ‘মোতি মহলে’। নবাবি ভেজ পুলাও ও কোর্মা। আমাদের দেশের কোর্মার মতো লক্ষ্ণৌরটি নয়। এদের কোর্মা অনেকটা আমাদের রেজালার মতো। খাবার শেষ করে একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম। শীতকাল বলে প্রতিটি মিষ্টির দোকান এবং রাস্তাতেও গাজরের হালুয়া বিক্রি হচ্ছিল। দোকানে লাড্ডুর রকম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এত রকমের হতে পারে? আমাদের দেশের মতো এখানে মিষ্টি তৈরি হয় না। বানানো হয় দুধকে ঘন করে ক্ষীর তৈরির মাধ্যমে। ঢাকায় লক্ষ্ণৌ থেকে মাদার বখশ এবং আলাউদ্দীন হালুয়াই (মিষ্টি প্রস্তুতকারক) চকে দোকান খোলেন। তারা লক্ষ্ণৌর হালুয়া, বালুশাহী, সোহান হালুয়া, হাবসী হালুয়া প্রভৃতি মিষ্টান্নের সঙ্গে ঢাকা শহরের মানুষদের পরিচয় করিয়েছিলেন।
ছবি: লেখক