রসনাবিলাস I নিরামিষ ভোজ
আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্ট তাদের জন্য, যারা আমিষাশী নন। পুরান ঢাকার এই ভোজনালয়ে অনেকেই আসেন দূর-দূরান্ত থেকে চমকপ্রদ কিছু স্বাদ গ্রহণের জন্য। লিখেছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি হয় নানান পদের মুখরোচক খাবার, যাকে বলে নিরামিষ। বাংলাদেশে গত এক দশকে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি নিরামিষের হোটেল। ঢাকার তাঁতীবাজারে এই খাবারের পসরা নিয়ে বসে ইসকন ভক্তরা। ওই এলাকার শিবমন্দির থেকে ডান দিকে একটু এগোলোই ডান পাশে পড়বে ‘আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্টটি’। আট বছরের বেশি সময় ধরে সেটি পরিচালনা করেছেন ইসকন অনুসারীরা। প্রবেশমুখেই ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি মিলবে ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের। রেস্তোরাঁর আকৃতিটা একটা মাঝারি সাইজের বেডরুমের মতো বলা চলে। পাঁচটি টেবিল রয়েছে। প্রতিটিতে বসা যাবে চারজন করে। প্রতিদিন দুপুরে ৫০০-৭০০ মানুষের আনাগোনা ঘটে সেখানে। রেস্তোরাঁটিতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় দুপুরের খাবারের সময়েই। বিপুল ভোজনরসিকদের খাবার তৈরি করেন ৪ জন রসুইকর। প্রতিদিন ১৫-২০ পদের নিরামিষ রান্না হয়। সেগুলোতে সরিষার তেলের ব্যবহার বেশি। অতিথিদের সন্তুষ্টির কথা মাথায় রেখে প্রতিদিনই বিভিন্ন পদ তৈরি করেন রসুইকরেরা। রেস্তোরাঁর ভেতরেই ছোট রান্নাঘর। তবে বেশির ভাগ রান্নাই হয় বাইরের রসুইঘরে। ভেতরটি থেকে কেবল বাটিতে পরিবেশন করা হয় পদগুলো। হাত ধোয়ার জন্য এক কোণে রয়েছে ছোট একটি বেসিন।
সকালের নাশতাও মেলে আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্টে। সেখানে তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মহল্লার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। দূরদূরান্ত থেকে অতিথিরা আসে নিরামিষ চাখতে। কথা হলো একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে। জানা গেল পল্টন থেকে এসেছেন তিনি। ফি সপ্তাহেই একবার আসেন; নিরামিষের টানে। আসেন মুসলমানরাও। বিশ বছরের এক তরুণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো তিনি এখানে এসেছেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে। রেস্তোরাঁটির খোঁজ পেয়েছে অনলাইনে ঘেঁটে। দেখা মিলল এক পরিবারেরও। কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলেন তারা। কিন্তু দুপুরের খাবারটা সেরে নিয়েছেন এখানেই। যারা এখানে বসে খেতে নারাজ, তারা ভাতের সঙ্গে নিরামিষ পদ পার্সেল নিয়ে যাচ্ছেন। পলিব্যাগে করে দেওয়া হচ্ছে বাহারি পদগুলো। খাওয়া শেষে নিরামিষের স্বাদে মোহিত হয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য পার্সেলও নিয়ে যান অনেকে।
তবে নিজে থেকে চেখে না দেখলে তো আর স্বাদ অভিজ্ঞতা পাওয়া উপলব্ধি করা যাবে না। বসে পড়লাম মধ্যাহ্নের আহারে। প্রথমে টেবিলে এলো স্টিলের থালাভর্তি সাদা ভাত। সঙ্গে এক পিস লেবু আর লাল মরিচ। নিরামিষ পদগুলো এলো ট্রে-তে। ছোট ছোট বাটিতে ১০টি পদ। কাশ্মীরি পনির, ছানার ধোকা, সয়াবিন সবজি, ডালের বড়ার রসা, লালশাক, পুঁইশাক, মসুর ডাল, পাঁচমিশালি সবজিসহ নানান পদ। পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ট্রে থেকে ৬ পদের খাবার নিলাম। টক পদ হিসেবে নিলাম আমের চাটনি। মুখে দিতেই বুঝলাম, এই স্বাদ ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া লিখেই এই স্বাদের বয়ান কতটুকুই-বা আর করা যাবে! তবে এতটুকু বোঝা গেল, কেন আদি গোবিন্দের খাবারের এত কদর। কেনই-বা এত দূর থেকে লোকজন আসে এখানে।
এ রেস্তোরাঁর বিশেষ পদটি হলো ‘বাদাম পনির’। যদিও এটি মোটেও পনির নয়। ময়দা ও তেল দিয়ে তৈরি। রসুইকরদের কাছ থেকে জানা গেল, এটি রান্না করতে নাকি খুবই ধকল। আরেকটি স্পেশাল আইটেম হলো সয়াবিনের তরকারি। স্বাদ মাংসের মতোই।
সকালের পর বেলা বাড়লে আদি গোবিন্দে মেলে সবজি বান, শিঙাড়া, পুরি ও আলুচপ। মৌসুমে যে শাকসবজি সহজলভ্য, সেগুলোর তরকারি রান্না হয় দুপুর ও রাতে। যে পদগুলো নিয়মিতই মিলবে সেগুলো হলো, সয়াবিন, ছানা, ডাল, কচুর সবজি, আলু পটোল, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও কচুর শাক, রসুন-পেঁয়াজমুক্ত কাশ্মীরি পনির, ছানারসা তরকারি, ফুলকপি, পটোল ভাপা, মুগ ডাল, বুট ডাল, কচুশাক, টক ডাল, লাউয়ের ডগা, বাঁধাকপি, জলপাইয়ের চাটনি, বেগুনি, সাম্বার, ম্যাকারনি, শিমের বিচি, ডালের বড়া, সয়াবিন সবজি, পাতলা ডাল, কচুর লতি ও করলা ভাজা, ভর্তা, লাউ ভাজি, পুঁইশাক, লালশাক, কোমরশাকসহ বিভিন্ন ভর্তা। খাবারের শেষে মিষ্টান্ন সচরাচর পাওয়া যায় না। তবে বিশেষ উৎসবে মেলে। পূজা কিংবা অন্যান্য হিন্দু উৎসবের গুড়ের সন্দেশ, চিনির সন্দেশ, রসগোল্লা, লালমোহন, রসমালাই, টক-মিষ্টি দইসহ নানান স্বাদের মিষ্টি পাওয়া যায়। সব খাবারের দাম ১৫ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। এখানে একজনের পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে ১০০ টাকার কমে। রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে রেস্তোরাঁটি।
আদি গোবিন্দ রেস্তোরাঁটি সাধারণ দিনেই অনেক ব্যস্ত থাকে। পূজাপার্বণে এখানে কী পরিমাণ ভিড় হয়, সেটি আন্দাজ করাও কঠিন। মূলত তাঁতীবাজারে কেনাকাটা করতে আসা মানুষেরাই এই রেস্তোরাঁর মূল অতিথি। বাইরে থেকে যারা সেখানে যান, তাদের জন্য রেস্তোরাঁটি খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিন হতে পারে। প্রথমবারে বাহির থেকে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই এটা আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্ট। কেননা ওপরে নেই কোনো ব্যানার। গলির মুখে রয়েছে ছোট্ট একটা বিলবোর্ড। তাতে বড় করে লেখা ‘আদি গোবিন্দ রেস্টুরেন্ট এদিকে’। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে চড়ে বংশাল মোড়ে নেমে রাস্তা পার হয়ে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। এ ছাড়া গুলিস্তান থেকে রিকশায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। গুলিস্তান থেকে হেঁটে যেতে সময় লাগবে ২০ মিনিট।
ছবি: শাহরিয়ার তামিম