স্বাদশেকড় I দই
বুলগেরিয়া ও ইরান খাবারটির আদি ভূমি। দুধ থেকে এটি কেমন করে তৈরি হয়েছিল?…
দুগ্ধজাত এই খাবারের উদ্ভব কৃষিবিপ্লবের কিছুকাল পরেই। মানে হাজার দশেক বছর আগে। গবাদির দুধ সংগ্রহের জন্য মানুষ জাবর কাটা প্রাণীর পাকস্থলী দিয়ে এক প্রকার থলে তৈরি করত। কিন্তু তা থেকে রেনেট নামের একটি রাসায়নিক নির্গত হতো। ফলে দুধ ফেটে বা কেটে যেত। এখন যেমন দুধে লেবুর রস পড়লে হয়, সে রকম। মূলত সেটিই ছিল দুগ্ধজাত প্রথম খাদ্য। দইয়ের উৎপত্তিটা সেখান থেকেই ধরা চলে। যদিও রেনেটের মাধ্যমে দুধের আণবিক গঠন ভেঙে নতুন খাদ্য তৈরি হওয়ার ঘটনা ছিল আকস্মিক। মানুষ ইচ্ছা করে তা করেনি। কিন্তু স্বেচ্ছায় দুধের আণবিক গঠন ভেঙে দই তৈরি শুরু হয় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে। খাওয়ার উদ্দেশ্যে তা বানানো হতো। বেদ ও উপনিষদেও এই খাদ্যের বর্ণনা আছে। বর্ণপ্রথায় উত্তম-সংকর পর্যায়ে যে ২০টি উপবর্ণ রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি হলো মোদক। তাদের কাজ ছিল দুধ দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করা। এই বর্ণের লোকেরা ময়রা নামেও পরিচিত। সনাতন রীতিনীতির সঙ্গে দুধের যোগ থাকায় এই পেশাকে পবিত্র ভাবা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মতে, রাধাকৃষ্ণের জন্মের পর তারা দুগ্ধজাত এক প্রকার খাবার খেতেন। সে সময় খাদ্যটিকে দধি বলত। সেটিই কালক্রমে দই নামে পরিচিত হয়েছে বলে পৌরাণিক ধারণা রয়েছে।
দইয়ের উৎপত্তি বিষয়ে আরেকটি মত প্রচলিত আছে। জানা যায়, খ্রিস্টের জন্মের ৬ হাজার বছর আগে নিওলিথিক গোষ্ঠীর লোকেরা দই তৈরি করতে জানত। তাদের খাদ্যতালিকায় ছিল এটি। তাদের বসবাস ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। কারও কারও মতে ৪ হাজার বছর আগে যাযাবর গোষ্ঠী লোকেরাই পৃথিবীতে দইয়ের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। তারা প্রাণীর চামড়ায় দুধ বহন করত। কিন্তু সেই থলের ব্যাকটেরিয়ার কারণে দুধের আণবিক গঠন ভেঙে দই তৈরি হতো। এই ধারণা ১০ হাজার বছর আগের সেই ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন প্রাণীর পাকস্থলীতে দুধ বয়ে নিতে নিতে আকস্মিকভাবেই তৈরি হয়েছিল দুগ্ধজাত এই খাবার। প্রাচীন রোম, গ্রিস ও মিসরেও দইয়ের ব্যবহার ছিল। ভারত উপমহাদেশে দই প্রবেশ করেছে পারস্য থেকে। এমনটাই ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশের বগুড়ার দই বিখ্যাত। এর উৎপত্তি শেরপুরে। প্রচলিত আছে, প্রায় দেড় শ বছর আগে সনাতন ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে দই তৈরি করত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তা বানাত চেলোপাড়ার কুড়ানু ঘোষ এবং শুটকা ঘোষ। তারা সপরিবারে দই তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই খাবারটি তৈরির হাতেখড়ি হয় বাঘোপাড়ার রফাত ও খান্দারের মহররমের। তা ছাড়া বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় শেরপুরের ঘোষ পরিবারের সদস্য গৌর গোপাল বগুড়া শহরে দই উৎপাদন শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। কালক্রমে এটি মুসলমানসহ অন্যান্য বণিক গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়।
কেউ কেউ বলেন, বগুড়ার দইয়ের উৎপত্তি ২৫০ বছর আগে। তখন এটি টক দই ছিল। পরে বংশপরম্পরায় এটি চিনিপাতা তথা মিষ্টি দইয়ে রূপান্তর হয়। খাওয়া ছাড়াও বগুড়ার টক দই মেজবানের রান্না ও ঘোল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বগুড়ায় এসে দই খাওয়ার পর এর স্বাদকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগান। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাদের মন ভোলাতে তিনি তা উপহার পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি ইংল্যান্ডে প্রথম ছড়ায় ১৯৩৮ সালে। সে বছর তৎকালীন বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়া নওয়াববাড়ি বেড়াতে এসে দই খেয়েছিলেন। সুস্বাদু হওয়ার কারণে তিনি তা ইংল্যান্ডে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক স্থানেই দই উৎপন্ন হয়। এমনকি সেগুলোর বেশির ভাগ বগুড়ার বলে দাবি করা হলেও আসলে তা নয়। বগুড়ার দই বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয়। এর কারিগরেরাও বিশেষ প্রশিক্ষিত।
বগুড়ার দইয়ের মতো ভোলার মহিষের দইয়েরও রয়েছে কদর। এটির উৎপত্তি অবশ্য ২০০ বছর আগে।
দইয়ের সঙ্গে আরেকটি দেশের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, সেটা হলো বুলগেরিয়া। বলা হয়, পৃথিবীকে দই চিনিয়েছে এই দেশ। খাবারটির বীজাণুর নাম থেকে এ বিষয়ে কিছুটা আঁচ করা যায়। যেটির নাম ‘ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’। বুলগেরিয়ার লোকেরা মোটামুটি সব খাবারেই দই ব্যবহার করে। দইয়ের প্রকরণের জন্য দেশটি প্রসিদ্ধ। দেশটির ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ট্যারাটর’। যা মূলত ঠান্ডা স্যুপ। এটি তৈরির মূল উপাদান দই। বলা হয়ে থাকে, বুলগেরিয়াই বাণিজ্যিকভাবে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে দই খাইয়েছে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট