ফিচার I শেফ রাশেদুল হাসানের গল্প
শেফ রাশেদুল হাসান। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রথম বাংলাদেশি। নবম আসরে শীর্ষ ২৪-এ ছিলেন এই রন্ধনশিল্পী। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায়। করপোরেট জব করছেন; তবে রান্না ছাড়েননি
ছোটবেলায় মা নাফিসা আহমেদ এবং নানু হালিমা খাতুনকে দেখে রান্নার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রাশেদুল হাসান। বিশেষ করে মা ও নানু যখন পিঠা বানাতেন, ক্ষুদ্র্র চালের গুঁড়ি কীভাবে পিঠার আকার ধারণ করে, ভাপা পিঠা তৈরির সেই প্রক্রিয়া মুগ্ধ করত ছোট রাশেদুলকে। তিনি নিজেও বানাতে চাইতেন। তার বাবা বাহাউদ্দিন আহমেদও ভালো রাঁধতেন। খাবার নিয়ে ভিন্ন কিছু করতে পছন্দ করতেন বাবা। রাশেদুলের ভাষ্যে, ‘রন্ধনশিল্পের বিষয়টা আমার ডিএনএতেই রয়েছে।’
বিভিন্ন ধরনের রান্না করতে পছন্দ করলেও সেই দক্ষতা নিয়ে মাস্টারশেফে চলে যাবেন, তা কখনো ভাবেননি শেফ রাশেদুল হাসান। তার করপোরেট জীবনযাপন খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ। সেখানে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের গুরুত্ব অনেক। যদিও নিজের কাজ খুব ভালোবাসেন তিনি। তবে ওসব ছাপিয়ে নিজের জন্য একটি সৃজনশীল স্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন খুব। তিনি মূলত দেখতে চেয়েছিলেন, তার তৈরি খাবারে অন্যেরা কেমন প্রতিক্রিয়া জানায়। তা ছাড়া রাশেদুল হাসানের আগে মাস্টারশেফ শোতে অংশ নেওয়া শেফদের বৈচিত্র্যময় গল্পগুলো তাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। সেই অনুপ্রেরণাতেই তিনি অংশ নিয়েছিলেন মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায়।
সালটা ছিল ২০১৬। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে রাশেদুল হাসান সম্প্রতি এক ভার্চ্যুয়াল আলাপে বললেন, ‘কী মনে করেই যেন মাস্টারশেফের আবেদনপত্রের দু-তিন পাতা অনলাইনে পূরণ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এরপর দ্বিধায় পড়ে আর আগাইনি। এর বেশ কিছুদিন পর মাস্টারশেফ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানানো হয়, তারা আবেদনপত্র জমা নেওয়ার শেষ তারিখ বাড়িয়েছে। আমি যেহেতু কয়েক পাতা পূরণ করেছি, চাইলে বাকিটা পূরণ করে জমা দিতে পারি। এতে এগোবার সাহস পেলাম। ভাবলাম, নিশ্চয়ই আমার কোনো দিক ভালো লেগেছে তাদের। তাই আবেদনপত্রের বাকিটা পূরণ করে জমা দিই।’
মূলত মাস্টারশেফ প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ার সব রাজ্য থেকেই প্রতিযোগীরা আবেদন করেন। প্রতি রাজ্য থেকে ১০-১২ হাজার আবেদন জমা পড়ে। এরপর গোটা দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার নির্বাচিত ব্যক্তিকে ডেকে কয়েক দফায় রান্নার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করানো হয়। প্রতি চ্যালেঞ্জেই অর্ধেক করে প্রতিযোগী কমে যান। প্রতিযোগীর সংখ্যা ৫০ জনে নেমে এলে শুটিং শুরু হয়। সিডনি থেকে অংশ নিয়েছিলেন রাশেদুল হাসান। সব মিলিয়ে ২ হাজার আবেদনকারী ও চ্যালেঞ্জ-জয়ী থেকে নিউ সাউথওয়েলস রাজ্যের ৮ জন সেরা ২৪ জনের মধ্যে নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে রাশেদুল হাসানও ছিলেন।
২০১৭ সালে প্রচারিত মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার নবম আসরে অংশ নিয়েছিলেন রাশেদুল হাসান। তখন জাজ ছিলেন ম্যাট প্রেস্টন, জর্জ ক্যালোম্বারিস ও গ্যারি মেহিগান। মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার প্রথম রান্নায় জাফরান দিয়ে পোচড পেয়ার এবং স্মোকড ভ্যানিলা আইসক্রিম তৈরি করেছিলেন রাশেদুল। বিচারকেরা চেখে বলেছিলেন, এটা তাদের খাওয়া অন্যতম সেরা আইসক্রিম। রাশেদুল হাসানকে মাস্টারশেফ অ্যাপ্রোন পরিয়ে দিয়েছিল ছেলে আয়মান। রাশেদুলের ভাষ্যে, ‘এটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত’।
রন্ধনক্ষেত্রে রাশেদুল হাসানের পছন্দের দুজন শেফ হলেন গগন আনন্দ ও এলেক্স আটালা। তারা ভারতীয় ও ব্রাজিলিয়ান কুজিন নিয়ে এমন নতুন কিছু করেছেন, যা আগে কেউ করতে পারেনি। বিশ্বের শীর্ষ ১০ রেস্তোরাঁয় লিস্টে জায়গা করে নিয়েছেন তারা, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে খাবার রান্না করে; একটু ভিন্নভাবে। তাদের মতোই বাঙালির খাবার নিয়ে এগিয়ে যেতে চান রাশেদুল। বললেন, ‘এটা আমার স্বপ্ন, যদি আমি এ রকম কিছু করতে পারি বাঙালি খাবার নিয়ে।’
বর্তমানে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ‘এক্সপ্লোরিং বেঙ্গলি কুজিন’ নামের একটি লাইভ রান্নার সিরিজ চালাচ্ছেন। সেখানে তিনি অতিথিদের তাদের পারিবারিক সিক্রেট রেসিপি শেয়ারের আমন্ত্রণ জানান। কিশোয়ার চৌধুরী ও সোবিয়া আমিন অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রথম দুটি এপিসোডে। তা ছাড়া বাকি বিশ্বের সঙ্গে বাঙালি খাবার শেয়ার করার উদ্দেশ্যে তিনি তার বাড়ি থেকে কিছু সুপার ক্লাব চালানোর পরিকল্পনা করছেন। পাশাপাশি তার ব্যবসায়িক পার্টনারের সঙ্গে বাংলাদেশি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খাবারের স্বতন্ত্রতা প্রদর্শন করে একটি রেস্তোরাঁ খোলার কাজ করছেন সিডনিতে।
শেফ হয়ে অনেককে রান্না করে খাওয়ালেও ভোজনরসিক রাশেদুল হাসান পছন্দ করেন দেশি খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি, খিচুড়ি, গরুর মাংস ও ডালের রুটি। বিদেশি খাবারের মধ্যে তার পছন্দ হলো নানান রকমের ডেজার্ট, সেভিচে, ডাম্পলিং ও পাস্তা। প্রিয়জনসহ অন্যরা তার তৈরি ডেজার্টগুলোই বেশি পছন্দ করেন। কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য অনেক অনুরোধ পান তিনি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায় হলেও বাবার চাকরির সুবাদে রাশেদুল হাসানের পড়াশোনার শুরু চট্টগ্রামে। প্রথমে চট্টগ্রামের ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে, এরপর ঢাকায় এসে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এরিকসনে কিছুদিন কাজ করার পর ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমান।
শেফ না হলে হয়তো ক্রিকেটার হতেন রাশেদুল হাসান। জানালেন, তার জীবনের শুরুতে স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। লেগ স্পিনার ছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগে। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলার স্বপ্নও ছিল। পরে তা আর হয়ে ওঠেনি পরিবারিক কারণে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: শেফ রাশেদুল হাসান