ফিচার I স্বর্ণ আহার
বিরিয়ানিতে স্বর্ণ। রাখা যাবে বার্গার কিংবা পিৎজাতেও। ঈদ উৎসব মাতাতে পারে স্বর্ণের একটি আহার্য। স্বাস্থ্যগুণেও অনন্য। যদিও খরচটা একটু বেশি। সব স্থানে মেলেও না…
মাস ছয়েক আগের ঘটনা। ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নীতা আম্বানির পানি পানবিষয়ক একটি সংবাদ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুলুস্থুল লেগে গেল। বিষয় ছিল, নীতা আম্বানি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের পানি পান করেন। ৭৫০ মিলিলিটার বোতলের দাম ৬০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। পানির এত দামের কারণ জানা গিয়েছিল তখনই। তাতে ৫ গ্রাম স্বর্ণের ছাই মেশানো থাকে।
স্বর্ণের ছাই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপাদেয়। মানে ধাতুটির অলংকারমূল্য ছাড়াও খাদ্যমূল্য আছে। যদিও বিষয়টি নতুন নয়। ওষুধ হিসেবে এই ধাতু খাওয়ার ইতিহাস প্রাচীন। ঔষধি হিসেবেই উঠে এসেছে পাতে। তারপর নানান পদের সঙ্গে যুগল বেঁধেছে। বর্তমানে গোল্ড সুশি, গোল্ড বার্গার, গোল্ড পিৎজা, গোল্ড ফ্রাইড চিকেন ও গোল্ড বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়। এই খাবারগুলো তুলনামূলকভাবে বেশ দামি।
দুবাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যানশিয়াল সেন্টারে অবস্থিত একটি রেস্তোরাঁ বোম্বে ব্রো। সেখানে মেলে ‘রয়্যাল গোল্ড বিরিয়ানি’। দাম ২০ হাজার টাকা। এটিই পুরো দুবাইয়ের সবচেয়ে দামি বিরিয়ানি। বড় একটি স্বর্ণের থালায় পরিবেশিত হয় এই খাবার। সঙ্গে থাকে ২৩ ক্যারেট স্বর্ণের পাতা, যা খাওয়া যায়। রাইসগুলোতে থাকে কেশর দেওয়া। ওপরে টপিং হিসেবে দেয় গোল্ড লিফ কাবাব। এ ধরনের বিরিয়ানিতে মোট ৩ ধরনের ভাত থাকে: কিমা রাইস, বিরিয়ানি রাইস এবং হোয়াইট স্যাফরন রাইস। সঙ্গে সেদ্ধ ডিম, বেবি পটেটো, ভাজা কাজুবাদাম, মিন্ট, ভাজা পেঁয়াজ ও বেদানা। থাকে রায়তা ও চাটনিও। ডালিমের তৈরি একটি বিশেষ আইটেমও থাকে। কখনো কখনো আরও কিছু উপকরণ যোগ হয় বিরিয়ানির এই ডিশে। ওসব উপকরণ সজ্জায় পুরো বিরিয়ানির ডিশের ওজন দাঁড়ায় ৩ কেজি। খাওয়া যায় ৬-৭ জন মিলে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৫ হাজার বছর আগে মিসরে খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ব্যবহৃত হতো। সেকালের মিসরীয় চিকিৎসকেরা বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে এই ধাতু ব্যবহার করতেন। আত্মার শুদ্ধির জন্য স্বর্ণ খুব উপযোগী বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বর্ণ খাওয়া শুরু হয় মধ্যযুগ থেকে। প্রথম দিকে ভারত, জাপান ও চীনে। সে সময় খাবারের ওপর স্বর্ণের প্রলেপ দিয়ে খাদ্যবস্তুকে আরও মূল্যবান করে তোলা হতো। একুশ শতকে ভোজ্যস্বর্ণ আরও জনপ্রিয়তা পায়। দুবাই, সিঙ্গাপুর, নিউইয়র্ক, আবুধাবি, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে পর্যটকেরা খাবারের সঙ্গে এটি খেতে পছন্দ করেন।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে স্বর্ণচূর্ণ দিয়ে ওষুধ তৈরি হয়। প্রাচীন চীনের রসায়নবিদদের ধারণা ছিল, স্বর্ণ পান করলে দীর্ঘায়ু লাভ হয়। বিংশ শতাব্দীতে গুটিবসন্ত, সিফিলিস ও হৃদ্রোগ সারাইয়ে ধাতুটি ব্যবহৃত হতো। ভোজ্যস্বর্ণ খেলে রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়। এতে শরীরের সব জায়গায় ভালোভাবে অক্সিজেন পৌঁছায়। ফলে মানুষ রোগমুক্ত থাকে। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে ধাতুটি। এটি খেলে বার্ধক্যের ছাপ রোধ হয়—এই বিশ্বাস থেকেই রানি ক্লিওপেট্রা নিজের ত্বকের যৌবন ধরে রাখতে স্বর্ণের তৈরি ওষুধ সেবন করতেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, স্বর্ণ দেহকোষের পুনর্গঠন ও কোলাজেনের ক্ষয়রোধ করে। ক্যানসারের চিকিৎসায়ও রেডিওঅ্যাকটিভ গোল্ড আইসোটোপ প্রয়োগ হচ্ছে আজকাল। দেহের সারাই ছাড়াও মনের ওপর ভালো প্রভাব ফেলতে সক্ষম এই ধাতু। খাঁটি সোনা কোমল ও মসৃণ অনুভূতি দেয়, যা মন শিথিল করে। প্রাচীনকাল মানসিক চাপ দূরীকরণে খাঁটি সোনার ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়।
গোল্ড বিরিয়ানি বা স্বর্ণ ব্যবহার করে তৈরি যেকোনো খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণ প্রশ্নটি হলো, এটি শরীরে কোনো ক্ষতি করে কি না। স্বর্ণ খাওয়ার ক্ষতি নির্ভর করে ধাতুটির বিশুদ্ধতার ওপর। খাবারে ২৩ কিংবা ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই বলে জানা গেছে। তবে এর কম ক্যারেট হলে বিপদ হতে পারে। খাঁটি সোনা শরীরে বিষক্রিয়া করে না। কিন্তু ভেজাল স্বর্ণ ফেলে বাজে প্রভাব। তা ছাড়া বেশি খেয়ে ফেললেও বিপদের শঙ্কা থাকে। মানুষের শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য দৈনিক ১ দশমিক ৩২ মাইক্রোগ্রাম স্বর্ণ খাওয়া নিরাপদ বলে জানা যায়। সব প্রতিষ্ঠান ভোজ্য সোনা তৈরি করে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কর্নাকঅপিয়া এবং এশিয়ার বাজারে জাপানের হরিকিন লিমিটেড তা করে। এ ছাড়া ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাবারের উপযোগী স্বর্ণ তৈরি হয়।
গোল্ড বিরিয়ানি আমাদের দেশে ততটা প্রচলিত নয়। তবে ঈদ উৎসবে অবস্থাপন্ন পরিবারে শখের বশে এটি তৈরি হতে পারে। স্বাস্থ্যগুণের পাশাপাশি স্বর্ণের ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। তাই এটি খাওয়া অনেকটাই আভিজাত্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন, স্বর্ণের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত। বেলজিয়ামের একদল গবেষক বলেছেন, ‘স্বর্ণের প্রতি মানুষের আকর্ষণের রহস্য লুকিয়ে আছে দেহে প্রাণ টিকিয়ে রাখার আদি ও মৌলিক নিয়মের মাঝে।’
স্বর্ণের সঙ্গে মানুষ যুগে যুগে মিশিয়েছে পবিত্রতার ধারণা। যেমন অ্যাজটেকরা স্বর্ণকে মনে করত দেবতাদের বিষ্ঠা। ইনকা সভ্যতায় বিশ্বাস করা হতো, স্বর্ণ হচ্ছে সূর্যের ঘাম বা কান্না। প্রাচীন মিসরে এটিকে দেবতার মাংস ভাবা হতো। মোটকথা, স্বর্ণ শুরুর দিকে ছিল পবিত্র বস্তু। পরে মানুষ এর ঔষধি গুণের হদিস পায়। পথ্য হিসেবে খেতে খেতেই এটি উঠে আসে সাধারণ খাবারের সহপদ হিসেবে। এখন বিশেষ উৎসব-পার্বণে বিরিয়ানিতেও ঠাঁই পাচ্ছে। তবে নিবন্ধ পড়ে নয়, স্বর্ণ খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বিশুদ্ধটিই খাওয়াই ভালো।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট