skip to Main Content

ফিচার I বাবল টি

জনপ্রিয় পানীয় বাবল টি অথবা বোবা টির কথা অনেকেই জানেন। আশির দশক থেকেই চা ঘরানার এই পানীয় পূর্ব এশিয়া ও আমেরিকার তরুণ সম্প্রদায়ের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে। তবে এই চায়ের উৎপত্তিস্থল কিংবা এর প্রচার-প্রসার সম্পর্কে হয়তো অনেকের জানা নেই। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

বাবল টির ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। ১৯৮৬ সালের দিকে তাইওয়ানিজ উদ্যোক্তা টু সং প্রথম নিজ দেশের চা-শিল্পের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেন। যদিও টু সং-এর সেই ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। প্রায় চল্লিশ লাখ তাইওয়ানিজ ডলার লোকসান হয় তার। তবে মননে যিনি শিল্পী, তাকে কি এত সহজে কাবু করা যায়? টু সংকেও টলানো যায়নি। দমে যাওয়ার পাত্র তিনি ছিলেন না।
অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়ে টু সং নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। বুঝতে পারেন, গতানুগতিক চায়ের ব্যবসা তাকে লাভের মুখ দেখাবে না। তাই ভিন্ন কিছু করার জন্য নতুন করে উদ্যোগী হন। এমন এক চা উদ্ভাবনে মনোযোগী হন, যা দেখতে ও পান করতে অন্যান্য চায়ের তুলনায় আলাদা হবে, স্বাদে-ঘ্রাণেও অনন্য। এই ভাবনা থেকেই টু সং দুধ চায়ের সঙ্গে যুক্ত করেন সাগু দানাজাতীয় ট্যাপিওকা বল ও বরফের টুকরা।
তবে সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়। ওই সময় এই চা পানের ক্ষেত্রে বরফের টুকরা ও ট্যাপিওকা বল মুখে পৌঁছানোর মতো কোনো স্ট্র ছিল না। তাই প্রথম দিকে ট্যাপিওকা বল মুখে নেওয়ার জন্য পানকারীরা প্লাস্টিকের চামচের সাহায্য নিতেন, যা ছিল খুব দৃষ্টিকটু। পরে এই সমস্যা সমাধানের জন্য টু সং স্ট্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে মোটা স্ট্র উৎপাদন ও ব্যবহারের ব্যবস্থা করেন।
সাধারণ চায়ের তুলনায় বাবল টি তৈরির পদ্ধতি আলাদা। এই চা তৈরির প্রক্রিয়ায় শুরুতেই দুধে চা-পাতা দিয়ে পাত্র চুলায় বসাতে হয়। এরপর চা হয়ে গেলে তাতে সাগু দানাজাতীয় খাবার ‘ট্যাপিওকা’ যোগ করা হয়। চুলায় দুধ ও চা-পাতা বসানোর আগেই সাগু দানাগুলো পানিতে সেদ্ধ করে নিয়ে ঠান্ডা করতে হয়। এরপর চিনির সিরায় আধা ঘণ্টার মতো ডুবিয়ে রাখা হয় সেগুলো। সাধারণত দুধে আগে থেকেই চিনি দেওয়া থাকে। এরপর কিছু বরফের টুকরা ঢেলে দিতে হয়। তবে এটা হচ্ছে সাধারণ বাবল টি তৈরির পদ্ধতি। এ ছাড়া আরও অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি এই চা তৈরিতে সংযুক্ত হয়েছে। প্রায় সময়ই বাবল টি তৈরিতে দুধের সঙ্গে বিভিন্ন ফলের রস বা ‘ফ্লেভার’ও যুক্ত করা হয়।
প্রথম বাবল টি প্রস্তুতকারী রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে। ‘হানলিন’ নামে ওই রেস্তোরাঁয় চায়ের এমন চমৎকার স্বাদের কথা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে শহরজুড়ে। এরপর তাইওয়ানের অন্য শহরগুলোতে অসংখ্য বাবল টি শপ গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে অভিজাত রেস্তোরাঁয় থাকলেও একসময় একেবারে সাধারণ স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোতেও বাবল টি জায়গা করে নেয়। রাতের তাইওয়ানে দল বেঁধে মানুষ ভিড় করেন বাবল টি-এর দোকানগুলোতে। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে রাতের বেলা বাবল টির দ্বারস্থ হন তাইওয়ানবাসী।
পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় ক্লান্তি কিংবা অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে যেখানে ধূমপান, অ্যালকোহল কিংবা অন্য অনেক রকম নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন, সেখানে তাইওয়ানের নাগরিকেরা ‘রিফ্রেশমেন্ট ড্রিংক’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাবল টি। দেশটির সর্বত্রই তাই বাবল টির দোকান সব সময় খোলা থাকে। আকাশচুম্বী চাহিদার কারণে তাইওয়ানের মোড়ে মোড়ে দেখা যায় এই বিশেষ চায়ের দোকান।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে বহির্বিশ্বের দিকে নজর দিতে শুরু করে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটায় তারা। এই ব্যবসায়ের সূত্র ধরেই অনেক তাইওয়ানিজ নাগরিক বাইরের দেশগুলোতে পাড়ি জমান। মূলত তাদের মাধ্যমে বাবল টি বাইরের দেশগুলোতেও পরিচিতি পায়।
নব্বইয়ের দশকেই আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বাবল টি শপ গড়ে উঠতে থাকে। ইতিহাসের প্রথম বাবল টি শপ হানলিনের শাখা বর্তমানে ৮০টি। আমেরিকা, কানাডা, এমনকি চীনের মূল ভূখণ্ডেও এই প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে। পরে বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাবল টি আরও বেশি পরিচিতি লাভে সমর্থ হয়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে বাবল টির জনপ্রিয়তা রয়েছে। এখন অধিকাংশ দেশেই রয়েছে এই পানীয় প্রস্তুতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দিনে দিনে এর চাহিদাও ব্যাপক বাড়ছে। হাজারো মানুষ এখন বাবল টি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া ম্যাকডোনাল্ড’স-এর মতো পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত খাবার তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের মেনুতেও স্থান পাচ্ছে এই চা। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে যখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, সিঙ্গাপুরের অধিবাসীরা হন্যে হয়ে শেষবারের মতো এই চায়ের স্বাদ নিতে হাজির হয়েছিলেন নিকটস্থ বাবল টি শপগুলোতে। অনেকে আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়েছিলেন।
জানা কথা, একেক দেশ একেক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জন্য পরিচিত হয়ে থাকে। বেলজিয়াম যেমন চকোলেটের জন্য পুরো বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে, পাস্তা কিংবা পিৎজার জন্য তেমন ইতালির রয়েছে আলাদা সুনাম। উচ্চমানের ওয়াইন প্রস্তুতের জন্য যেমন ফরাসিরা গর্ববোধ করেন, নিঃসন্দেহে তাইওয়ানের তেমন স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয়েছে বাবল টির মাধ্যমে। বিশ্বায়নের এই যুগে এর জনপ্রিয়তা যে আরও বাড়বে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তবে প্রতিটি জিনিসের ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু খারাপ দিকও থাকে। সে রকমই বাবল টি সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট অ্যালভার্নিয়া হাসপাতাল ২০১৯ সালে একটি সতর্কবার্তা জারি করে। এই পানীয়তে ব্যবহৃত উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত উপাদানে হৃদ্রোগ, স্ট্রোকসহ বেশ কিছু মারাত্মক রোগের ঝুঁকি আছে বলে হাসপাতালটির এক গবেষণায় জানা যায়। তাই ওই হাসপাতাল সতর্ক করে দেয়, চায়ে নন-ডেইরি ক্রিমার ও টপিংসের মতো অন্যান্য উপাদান শরীরে চর্বি বাড়াতে পারে এবং এই চায়ে যে চিনির উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁঁকিও বাড়ায়।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top