skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ডায়েট যখন ক্রাশ

কখনো কখনো মেদ ঝরানো জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা এর ভালোমন্দ দিকের খেয়াল রাখেন না, তারা দীর্ঘদিন এ ধরনের ডায়েট চালিয়ে বিপাকে পড়েন। সেসব নিয়েই লিখেছেন নিশাত শারমিন নিশি

স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে ডায়েট খুবই জনপ্রিয় শব্দ। যারা সব সময় একটু হেলদি থাকতে চান, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। ডায়েট নিয়ে তাই অনেকের রয়েছে নানা ধ্যান-ধারণা। অনেককেই দেখা যায়, ওজন একটু বেড়ে গেলে হয়ে পড়েন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তখন তারা খোঁজ করেন ওজন কমানোর কৌশল। কেউ কেউ সারা দিন না খেয়ে থাকেন, কেউ আবার করেন কিটো ডায়েট, ভেগান ডায়েট, মেডিটেরিয়ান ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংসহ বিভিন্ন ডায়েট। অনেক সময় তারা একজন আরেকজনের কাছ থেকে শুনে বা ইন্টারনেট দেখে নিজেই নিজের ডায়েট চার্ট তৈরি করে নেন। ফলে সৃষ্টি হয় বিপত্তি।
ক্রাশ ডায়েটের পরিচয়
অনেকেই ক্রাশ ডায়েট তৈরি করেন নিজেদের মতো করে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। ক্রাশ ডায়েটেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম। এটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম ক্যালরি ও নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি একটি ডায়েট চার্ট, যা সাধারণত ৩-৭ দিন অথবা ১০-১৫ দিন পর্যন্ত ফলো করা যায়। ফলে ওজন দ্রুত কমে গিয়ে রোগীকে অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বস্তি দেয়। এটি সাধারণত ৬০০ থেকে ৮০০ ক্যালরির মধ্যে হয়ে থাকে। ওজন কত বেশি আছে, লাইফস্টাইল কী ধরনের, শারীরিক কোনো সমস্যা আছে কি না এবং কত দিনের মধ্যে কত ওজন কমাতে হবে—এসবের ওপরই নির্ভর করে ক্যালরি ক্যালকুলেশন।
ভালো নাকি
বিভিন্ন কারণে ক্রাশ ডায়েট করা প্রয়োজন হতে পারে। যেমন অনেকেরই ওজন বেশি থাকায় অতি প্রয়োজনীয় কোনো একটি অপারেশন হয়তো করা সম্ভব হয় না। এমন সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত ওজন কমানোর ব্যবস্থা নিতে হয়। এ ছাড়া মিডিয়াব্যক্তিত্ব যাদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে কাস্টিংয়ের প্রয়োজনে দ্রুত ওজন কমানো জরুরি হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রেও ক্রাশ ডায়েট ভূমিকা রাখে। এটি মূলত সাময়িক সময়ের জন্য ফলো করা হয়। সায়েন্টিফিক উপায়ে করা গেলে খুব একটা অসুবিধার কারণ হয় না। তবে অনেকেই না বুঝে যখন একই ডায়েট দীর্ঘ দিন ফলো করেন, তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। সে ক্ষেত্রে নিউট্রিশনাল ইমব্যালেন্স দেখা দিতে পারে। শারীরিক দুর্বলতা, স্কিন খারাপ হওয়া, চুল পড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কম্প্লিকেশন তৈরি হতে পারে। তাই অবশ্যই ক্রাশ ডায়েট ভালো কি না, তা নির্ভর করবে ডায়েট চার্ট সঠিক উপায়ে করা হয়েছে কিংবা সময় অতিক্রম করছে কি না, তার ওপর।
যা থাকে
ক্রাশ ডায়েট বিভিন্ন রকমের হয়। তবে ওজন কমানোর জন্য অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কিছু পুষ্টি উপাদানের দিকে। অনেক সময় সেগুলোর ঘাটতি হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নেওয়া যেতে পারে সাপ্লিমেন্ট। যেমন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট, বায়োটিন, আয়রনসহ ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। তবে কার কোনটি প্রয়োজন, সেটি অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।
ক্রাশ ডায়েট করতে চাইলে খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে এই উপাদানগুলো—
 গ্রিন টি: ওজন কমানোর জন্য গ্রিন টির ভূমিকা দারুণ। দ্রুত ওজন যারা কমাতে চান, তাদের খাদ্যতালিকায় দুই বেলা এটি রাখা যেতে পারে। এতে রয়েছে ক্যাটেচিন, যা শরীরে জমে থাকা মেদ ঝরাতে যথেষ্ট কার্যকর।
 অ্যালোভেরা: যারা ওয়েট রিডাকশনের প্রচেষ্টায় রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় পেট জ্বালা, অ্যাসিডিটি খুব কষ্ট দেয়। সে ক্ষেত্রে অ্যালোভেরা জেল গ্রহণে ওজন কমে, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও কাটে। তবে সরাসরি অ্যালোভেরা গ্রহণে অনেকের এলার্জি থাকতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত কমার্শিয়াল অ্যালোভেরা জেল উপকারী।
 মেথি: এটি বিভিন্ন গুণে ভরপুর। রয়েছে মিষ্টি ঘ্রাণ। অনেকেই মেথি দিয়ে সবজি বা চিকেন রান্না করেন, যা স্বাদে ভিন্নতা আনে। তবে ওজন কমানোর জন্য মেথি ভেজানো পানিই বিশেষভাবে কার্যকর। যারা ক্রাশ ডায়েটে আছেন, তারা এক গ্লাস পানিতে ২ টেবিল চামচ মেথি ভিজিয়ে সকালে খালি পেটে খেতে পারেন। ওজন কমাতে এটি ভালো কাজ করে।
উপায়
ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতার সঙ্গে দেখতে যেমন খারাপ লাগে, তেমনি স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও নষ্ট হয়। ফলে অনেক সময় তৈরি হয় ডিপ্রেশন। তাই ক্রাশ ডায়েট কেমন হবে, সে বিভ্রান্তির সমাধানের জন্য কিছু পরামর্শ রইল:
 খাদ্যতালিকা থেকে সব পুষ্টিকর উপাদান বাদ দেওয়া যাবে না। খাবারের তালিকায় কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলসহ রাখতে হবে ফাইবার ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
 প্রচুর পানি, জুস, সুপ ও তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর খাবার গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত। এ সময় খাওয়া যেতে পারে টমেটো সুপ, ক্লিয়ার ভেজিটেবল সুপ, ডাবের পানি ও অরেঞ্জ জুস। তবে এগুলো হতে হবে হোমমেড। আর অবশ্যই টেস্টিং সল্ট ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত।
 একই খাবার বারবার না খেয়ে ভিন্ন পুষ্টি উপাদানের খাদ্যগুলো তালিকায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে উপাদান একই রকম থাকলেও কুকিং প্রিপারেশন আলাদা করে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। যেমন দুপুরে চিকেন স্টেক খেলে রাতে আবার তা না খেয়ে চিকেন সুপ কিংবা চিকেন দিয়ে তৈরি ডাম্পলিং খাওয়া যেতে পারে।
 অতিরিক্ত চিনি বা লবণযুক্ত খাবার সরিয়ে ফেলতে হবে খাদ্যতালিকা থেকে। এগুলো কিডনির জটিলতাসহ শরীরে বিভিন্ন সমস্যা বাড়িয়ে বাড়তি চাপ তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে সবার আগে সরিয়ে ফেলতে হবে মিষ্টি, কেক, ডোনাট ও চানাচুর।
সাবধান
নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্রাশ ডায়েট অনুসরণের ফলে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা। যেমন:
 দীর্ঘদিন ওজন কমানোর চিন্তা করে যারা ক্রাশ ডায়েট ফলো করছেন, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যেতে দেখা যায়।
 হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
 ইরেগুলার পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
 রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সমস্যা ঘটতে পারে।
 ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালেন্সসহ কিডনি রোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে।
নো চিটিং
অনেকেই ‘চিট ডে’ নিজ থেকেই তৈরি করে নেন! চিট ডের ক্ষেত্রে কোনো ডায়েট রেসট্রিকশন থাকে না। নিজের ইচ্ছামতো যা খেতে মন চায়, খাওয়া যায়। এতে ক্যালরি ক্যালকুলেশন নষ্ট হয়। ক্রাশ ডায়েট চলাকালীন চিট ডে রাখা ঠিক নয়। কেননা, মাত্র কয়েক দিনের জন্যই এটি ফলো করতে হয়। তাই এসব ক্ষেত্রে রুলস ব্রেক না করাই ভালো।
সত্যি বলতে সুস্থ থাকাই বড় ব্যাপার। মনে রাখতে হবে, এমন কোনো ডায়েট চার্ট ফলো করা উচিত নয়, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজন ছাড়া ব্যালেন্স ডায়েট ফলো করাই শ্রেয়। এতে কমতে সময় নিলেও কোনো কম্প্লিকেশন ছাড়াই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, হার্ট ও লিভারের অসুখ রয়েছে—এমন রোগীর ক্ষেত্রে ক্রাশ ডায়েট অনুসরণ করা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে কোনো পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top