এডিটর’স কলাম I বৃষ্টি: আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ
তাতে ভিজে যায় আদিগন্ত প্রান্তর; সিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের মন
‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘর-ফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়ে/ যারা ছিলো তন্দ্রালস দিগি¦দিক ছুটলো, চৌদিকে/ ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মত যেনবা মড়কে/ শহর উজাড় হবে,—বলে গেল কেউ—শহরের/ পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়…’—বৃষ্টির এমন ভয় ধরানো চিত্রকল্প শিল্প-সাহিত্যে সচরাচর দেখা যায় না; তবু শহীদ কাদরীর এ কবিতার মতোই বৃষ্টি যে ‘সহসা সন্ত্রাস’ হয়ে উঠতে পারে, তা অস্বীকারেরও নেই উপায়। তবে সার্বিকভাবে বৃষ্টি আমাদের মনে প্রকৃতির এক দারুণ আশীর্বাদ, এক শৈল্পিক সৌন্দর্য হয়েই সাধারণত ধরা দেয়। তাই গান, কবিতা, চিত্রকর্ম, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র…বিবিধ শিল্প-সাহিত্য মাধ্যমে বৃষ্টিবন্দনার নেই শেষ। এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য চাতকের মতো আমরাও দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকি। যদিও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য দেখি আমরা, তাই বৃষ্টিও আমাদের চিরচেনা। কিন্তু এ বৃষ্টি আদতেই আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ—সেই প্রশ্ন ক্ষণে ক্ষণে ভাবনাজগতে দিতে পারে উঁকি; দেয়ও।
দুই
বিজ্ঞান বলে, মাধ্যাকর্ষণের কারণেই পৃথিবীতে ঘটে বৃষ্টিপাত। নদী, খাল, বিল, সমুদ্র, মহাসমুদ্র থেকে সূর্যের উত্তাপের কারণে পানি বাষ্প হয়ে ধীরে ধীরে উঠে যায় আকাশে। সঙ্গে ধুলাবালিসহ ছোট ছোট বিভিন্ন পদার্থের কণাও উঠে পড়ে। আর আকাশে জলকণাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই জমাট বাঁধে। ফলে সৃষ্টি হয় মেঘ। আর সেই মেঘই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে নিচে। তাতে ভিজে যায় আদিগন্ত প্রান্তর; সিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের মন।
তিন
খুব সাধারণ বিবেচনাবোধেই আমাদের জানা আছে, অনাবৃষ্টির রূপ কত ভয়ঙ্কর হতে পারে। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বৃক্ষরাজি নেতিয়ে পড়ে। গণমানুষেরও তখন ওষ্ঠাগত প্রাণ। তাই বৃষ্টির জন্য বিশেষ প্রার্থনার রেওয়াজ বহুকাল ধরেই রয়েছে। একেক সমাজে তা একেক রকম। আমাদের তল্লাটেও বিশেষ প্রার্থনার নজির অনেক। সাম্প্রতিক এক উদাহরণ টানা যাক গণমাধ্যম থেকে। কদিন আগেই, জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আষাঢ় এলেও বাগেরহাটের মোংলা অঞ্চলে দেখা মিলছিল না বৃষ্টির। প্রায় দুই মাস বৃষ্টি না হওয়ায় প্রচণ্ড দাবদাহে গ্রামীণ জনপদের পুকুর ও ডোবা গিয়েছিল শুকিয়ে। সুপেয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল ফসল। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ জুন সকাল ৮টায় মোংলা উপজেলা ইমাম পরিষদের আয়োজনে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেন হাজারো মুসল্লি।
চার
চার্লি চ্যাপলিন বলতেন, ‘বৃষ্টিতে হাঁটতে আমি ভালোবাসি, যেন আমার কান্না কারও নজরে না পড়ে।’ এমন নিগূঢ় জীবনবোধকে সঙ্গী করে সৃষ্টির ভাণ্ডারে নজর বোলালে আমরা দেখতে পাব, কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’তে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দুই একদিনে ঘনীভূত বর্ষা নামিল। হু-হু পুবে হাওয়া—খানাডোবা সব থৈ-থৈ করিতেছে—পথেঘাটে এক হাঁটু জল, দিনরাত সোঁ সোঁ, বাঁশ বনে ঝড় বাধে—বাঁশের মাথা মাটিতে লুটাইয়া পড়ে…।’ চিরন্তন বাংলার পল্লি প্রকৃতিতে বরিষণের এমন সাহিত্য-বর্ণনার যথাযথ দৃশ্যচিত্রের দেখা আমরা পাই সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রেও। অন্যদিকে, পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রাচ্যের যে চলচ্চিত্র প্রথমবার জিতে নিয়েছিল বড় কোনো পুরস্কার, পশ্চিমা দর্শকদের মনে প্রাচ্যের চলচ্চিত্রের প্রতি প্রথমবার জাগিয়ে তুলেছিল বড় ধরনের কৌতূহল, জাপানি কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়ার সেই অমর সৃষ্টি ‘রসোমন’-এ অবিরাম বৃষ্টির যে মহাকাব্যিক দৃশ্য রয়েছে, তা অতুলনীয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যকর্মের মতো বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে বৃষ্টির আরাধনা। বলা হয়ে থাকে, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কবিই বৃষ্টি নিয়ে অন্তত একটি কবিতা হলেও লিখেছেন। এর পাশাপাশি চিত্রকর্ম, গান, নাটক…কোথায় নেই বৃষ্টির উচ্ছ্বাস? তাই যেকোনো সৃজনশীল মাধ্যমে বৃষ্টি একটি ‘উর্বর বিষয়বস্তু’—এমন দাবি করা যেতেই পারে!
পাঁচ
বৃষ্টি শুধু আশীর্বাদ নয়, অভিশাপও হয়ে ওঠে কখনো কখনো। অতিবৃষ্টির কারণে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত তো হয়ই, বন্যা, পাহাড়ধসের মতো ভয়াবহ দুর্যোগও ঘটে। বর্ষার এ মৌসুমে সম্প্রতি এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের নারকীয় রূপ আমরা দেখেছি। বানভাসি মানুষের হাহাকারে ভারী হয়ে আছে আকাশ। এই বন্যার পেছনে বৃষ্টিরও যে ভূমিকা রয়েছে, সে কথা বলা বাহুল্য। তবে বৃষ্টিই একমাত্র কারণ নিশ্চিতভাবে নয়। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এবং প্রকৃতির হেঁয়ালিও এতে যুক্ত। অন্যদিকে, যাদের জীবন প্রতিনিয়ত কাটে দুমুঠো অন্ন জোগানের লড়াইয়ে, যাদের মাথার ওপরে নেই টেকসই কোনো ছাদ, বৃষ্টি তাদের মনে কবিতা হয়ে দোলা দেয় না! বরং একে বিড়ম্বনা হিসেবে গণ্য করতে পারেন তারা। নিজেদের অভিশপ্তও ভাবেন কেউ কেউ, হয়তো!
ছয়
বৃষ্টির মর্মবার্তা আসলে কী? আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ—এ নিয়ে রোমান্টিক কোনো তর্ক হতেই পারে। আর তা যদি হয় কোনো বৃষ্টিমুখর দিনে, তাহলে বোধ করি জমবে বেশ। তাই বলে বৃষ্টির বিরোধিতা? কোনো যুক্তিতেই তা করা সমীচীন মনে হয় না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি জলধর মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি, যাতে তা দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য, উদ্ভিদ ও পাতাঘন উদ্যান’ [সুরা আন নাবা; আয়াত ১৪-১৬]। বস্তুতই পৃথিবীর বুকে প্রাণের সতেজতা ধরে রাখতে বৃষ্টি এক দারুণ নিয়ামক। যদিও কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি উৎপন্নের কিছু উদাহরণ ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন, তবু প্রাকৃতিক বৃষ্টির বিকল্প কিছু হতে পারে না। আমরা যদি নিজেদের জায়গা থেকে পৃথিবীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতি সচেতন ও দায়িত্ববান হই, তাহলে কোনো ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে নয়, বরং আনন্দের অনুরণন হয়েই ধরা দেবে বৃষ্টি।
ঘোর বরিষণের এই মৌসুমে সবার জীবন নিরাপদ হোক।