বিশেষ ফিচার I ঢাকা থেকে কান: এক পথিকের বয়ান
১৭ থেকে ২৮ মে। ফ্রান্সে বসেছিল মর্যাদাপূর্ণ কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের এবারের আসর। সেখানে চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপরেসির বিচারক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু। তার লেখা থেকে জানা যাক সেই জার্নি
কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বাধীন বিচারক হিসেবে যাওয়ায় অনেক সুহৃদ যেমন অভিনন্দন জানিয়েছেন, তেমনি অনেক পরিচিত ও আধা পরিচিত মানুষ বিস্মিতও হয়েছেন, তাদের প্রশ্ন, আমি কী করে ওই পর্যন্ত চলে গেলাম? তাদের প্রতি আমার উত্তর, এই অভিযাত্রায় আমি আগন্তুক নই, কমপক্ষে সতেরো বছর চলচ্চিত্র লেখক হিসেবে হাঁটতে হাঁটতে এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। যাদের পড়ার কথা, তারা আমার লেখাপত্র পড়েছেন। দেশে-বিদেশে আমার প্রবন্ধ ও বই প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। বলা যেতে পারে, কাজ করতে করতেই কানে পৌঁছেছি। চলচ্চিত্র লেখক বলেই চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপরেসি (FIPRESCI) আমাকে বিচারক হিসেবে তাদের সভ্য করে নেয় ২০২১ সালে। চলতি বছর জুরি হিসেবে প্রথম দায়িত্ব পালন করি ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। দ্বিতীয়বার আমার ওপর আস্থা রেখে, এ বছরই পাঠানো হয় ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে।
আমার এই কথাগুলোকে কৈফিয়ত মনে হতে পারে, আমি বলব, এগুলো আমার বিনীত উত্তর। এক প্রভাবশালী দৈনিকের সাংবাদিক বন্ধু তো কান যাওয়ার আগে ফোন করে বলেই বসলেন, আমাকে আর আটকে রাখা গেল না! উনি মজা করেই বলেছেন। আমিও হেসেছি। ভাষা হলো মানুষের অচেতনে প্রবেশের সদর দরজা।
সক্রিয়তার হিসেবে, সতেরো বছর ধরে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করলেও, মনোজগতে চলচ্চিত্র বৃক্ষের বীজ বপন হয়েছিল সেদিনই, যেদিন নীল-সাদা একটা বাক্স ঢুকেছিল আমাদের ঘরে। সন্ধ্যাবেলায় সেই বাক্স খুলে দেখি কালো রঙের একটা চৌকোণা যন্ত্র। বাবা কিনে এনেছেন, সেকেন্ড হ্যান্ড ভিসিআর। সালটা সম্ভবত একানব্বই, বয়স দশ। তখন পাড়া-মহল্লায় ভিএইচএস ক্যাসেটের ক্লাব ছিল, দশ টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত দেশি-বিদেশি ছবির ক্যাসেট। বাংলাদেশের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ থেকে শুরু করে কলকাতার ‘ছোট বউ’, ‘আক্রোশ’, বলিউডের ‘সোলে’, ‘কুলি’, হলিউডের ‘র্যাম্বো’, ‘টার্মিনেটর-টু’…কত যে সিনেমা দেখেছি সে সময়! আমার ছোট মামা মধ্যপ্রাচ্যে থাকতেন, তিনি ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসতেন বলিউড সিনেমার অরিজিনাল ভিএইচএস ক্যাসেট। এখনো সেসবের কয়েকটি সংগ্রহে আছে। মনে আছে, দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ খুব সমালোচিত হচ্ছিল মুক্তির পরপর। তো বাসায় ক্যাসেটটি এসেছে, কিন্তু আমাকে দেখতে দেওয়া হচ্ছিল না। চুরি করে ঠিকই দেখে নিয়েছিলাম।
ভিসিআর যুগের সঙ্গে সঙ্গত করেছে বিটিভির ‘মুভি অব দ্য উইক’। ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ দেখার জন্য হাইস্কুল পালিয়ে তড়িঘড়ি বাসায়, পরেরদিন খেয়েছি স্যারের জালিবেতের মিষ্টি! মাধ্যমিক পাস করে একদিন নটর ডেম কলেজে ঢুকে যাই। পাশেই মধুমিতা সিনেমা হল। বুঝতেই পারছেন! আমাদের আমলেই নটর ডেম পঞ্চাশ বছরে পড়ে। আর এই উপলক্ষে বানানো প্রামাণ্যচিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করি শিক্ষক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। গবেষণার কাজ করে দিই এবং নেপথ্যকণ্ঠও দিই। পাকাপাকিভাবে সিনেমার পোকা এ সময়েই প্রবেশ করে মাথায়। বনে যাই সিনেফিল। তারপর স্নাতকে পড়ার সময় গোগ্রাসে গিলেছি মানোত্তীর্ণ ছবি। এক রাতে তিনটি পর্যন্ত ছবি দেখেছি। মান যাচাইয়ের কাজটি করে দিতেন সিডির দোকানের সেই নাম ভুলে যাওয়া ভাইটি। তিনি আমার রুচি ধরতে পেরেছিলেন। তাই ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ থেকে ‘দ্য গড ফাদার’, এসব ছবি তিনি আমাকে দিতে থাকেন। এরপর চলচ্চিত্রের ওপর স্নাতকোত্তর পড়ার সময় ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের এক বিশাল দুনিয়া আমার সামনে খুলে যায়। ছবি দেখা আর বই পড়া চলতে থাকে। বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্রবিষয়ক সিরিয়াস লেখা পাঠের ক্ষুধা অনুভব করি তখন। ২০০৬ সালের কথা। অভাববোধ থেকেই লেখালেখি শুরু, অতঃপর বই প্রকাশ। চলচ্চিত্র নিয়ে দু-একখানা বক্তৃতা দিয়েছি মাঝে এবং বিচারকাজ করেছি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। তারপর একদিন পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে যাওয়া, ওখানকার চলচ্চিত্রের পরিবেশে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা।
আরও বড় পরিসরে সিনেমাকে বোঝাপড়ার সুযোগ আসে ২০২২ সালে। যে মানুষ এত দিন ভালো ছবি, পুরস্কার পাওয়া ছবি দেখত, সেটি নিয়ে লিখত, বিশ্লেষণ করত, সেই মানুষটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার দেওয়ার কাজটি পেল। খুব একটা চিন্তায় পড়তে হয়নি; কারণ, এর আগেই কয়েকটি আয়োজনে যেহেতু বিচারকাজ করার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। ভাবনার জায়গা ছিল কান উৎসবের ব্যাপ্তি নিয়ে। ওটাকে আয়ত্তে আনতে বাড়ির কাজ করেই ১৩ মে চড়ে বসি ফ্রান্সের নিসগামী উড়োজাহাজে। নিসে নেমে সোজা গল্ফ-জুয়ান-ভ্যালুরিতে, কানের পাশের শহর। চমৎকার আড়াই কামরার অ্যাপার্টমেন্টে শুরু হয় আমার কান অধ্যায়। দুশো নাম্বার বাসে চড়ে, দেড় ইউরোতে কানে যাওয়া প্রতিদিন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে রাত আটটা কি নয়টা পর্যন্ত দেখতে থাকা বিচিত্র সব নির্মাণ। এর ফাঁকেই সংবাদ প্রকাশের জন্য লিখতে হয়েছে দিনলিপি ‘কানান্তর’।
১১ দিনের উৎসবে চলচ্চিত্র দেখেছি ৩৭টি। এর ভেতর প্যারালাল সেকশনের জন্য প্রতিযোগিতা করছিল ২৮টি ছবি। ভৌতিক থেকে রোমাঞ্চকর, নাটকীয় থেকে দার্শনিক, রাজনৈতিক থেকে ব্যঙ্গাত্মক, কত রকম ছবি যে দেখা হয়েছে। সব কটি ছবির আধেয় নিয়েই আমরা জুরিরা কথা বলেছি, আধার নিয়ে নয়। কারণ, এসব ছবির কারিগরি নির্মাণ এতটাই নিখুঁত যে সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। উৎসবে অংশগ্রহণের প্রথম ধাপেই আসলে এসব ছবির দৃশ্য-পরম্পরা, সম্পাদনা, আলোকসম্পাত, সিনেমাটোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা হয়ে যায়। চূড়ান্ত বিচারের জন্য যা বাকি থাকে তা হলো একটি বিষয়কে কীভাবে বয়ান করছেন পরিচালক, সেটি। আমার দিনলিপি পড়লেই বোঝা যাবে কী বিস্তৃত পরিসরে, কত পুরাণ ও ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে, কত রকম বিষয় নিয়ে ছবিগুলো উৎসবে নিয়ে এসেছেন নির্মাতারা। ভাষা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। চলচ্চিত্র তো মূলত দৃশ্যের ভাষা। চেইন অব সিগনিফায়ার। দৃশ্যই সেখানে কথা বলে। সেই দৃশ্যমালার পাশাপাশি অনূদিত সংলাপ তো ছিলই। কাজেই আমরা জুরি সদস্যরা আলাপ করেছি, কে কত সাহসী ও ভিন্ন ধরনের বিষয়কে তুলে ধরেছেন এবং কীভাবে তুলে ধরেছেন।
একেক নির্মাতার বয়ানরীতি একেক রকম। সেই বয়ানরীতির ভেতর আবার মিশে থাকে নিজস্ব সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি। তাই একেকটি ছবি নিয়ে ভাবা মানে ওই ছবির ভূগোলকে সঙ্গে নিয়ে ভাবা। একা একা ভাবলে তো চলে না, অন্য বিচারকদের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে হয়। সেটাই করেছি যখন সুযোগ পেয়েছি। চিন্তার ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রাখার এমন সুযোগ সব সময় আসে না। কখনো কখনো আমার কো-জুরি অবাক হয়েছেন কোনো ছবি সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা শুনে। কখনো বা আমি ওদের তরজমা শুনে ভেবেছি, বাহ্, এভাবেও তো ছবিটিকে ব্যাখ্যা করা যায়! চলচ্চিত্র নিয়ে চিন্তার এই চলাচলই আমাকে উজ্জীবিত করে রেখেছিল।
কান চলচ্চিত্র উৎসব দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব। এখানে বিচারক হিসেবে যাওয়া খুবই আনন্দের। তবে কানের এই আয়োজনে যাওয়া বা সেখানে লালগালিচায় হাঁটার চেয়েও আমি বেশি উপভোগ করেছি আমার চলচ্চিত্র-বন্ধুদের সাহচর্য। এটা ঠিক বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র লেখক হিসেবে কানের রেড কার্পেটে হেঁটে আনন্দ লেগেছে, যুগপৎ কষ্টও পেয়েছি। আনন্দ পেয়েছি কান কর্তৃপক্ষ আমাদের যে সম্মান দেখিয়েছে সে জন্য, আর কষ্ট পেয়েছি আমাদের দেশে চলচ্চিত্র সমালোচক, লেখক ও গবেষকদের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে। যে দেশে বাণিজ্যিক ছবির শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজকেরা বছরের অধিকাংশ সময় নির্বাচন আর বনভোজন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান, সে দেশে চলচ্চিত্র সমালোচকেরা আর কতটুকু শ্রদ্ধা পাবেন? আগে তো চলচ্চিত্র! সেটাই ঠিকঠাক হচ্ছে না দেশে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিন্তা ও পরিকল্পনার স্বচ্ছতা, আমরা আসলে কী চাই এবং যা চাই সেটা কোন পথে অর্জন করা সম্ভব। আমরা যদি জাতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হই, সেটার একধরনের কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। আবার যদি হলিউড-বলিউড মার্কা চলচ্চিত্র বানিয়ে চলচ্চিত্র কারখানাকে আর্থিকভাবে চাঙা করতে চাই, সেটার জন্য ভিন্ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। তবে কানের মতো উৎসবগুলোতে মুনাফাভিত্তিক, বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির চেয়ে শৈল্পিক ছবির কদর বেশি।
এটা ঠিক, একেক উৎসবের মেজাজ একেক রকম। সেটাই তো হওয়ার কথা। নয়তো স্বাতন্ত্র্য রচিত হতো না। তবে উৎসবের জন্য চলচ্চিত্র, না চলচ্চিত্রের জন্য উৎসব—এ ধরনের মুরগি ও ডিমের ধাঁধা দূরে সরিয়ে রেখে বলা যেতে পারে, ভালো ছবি দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সমাদৃত হবেই। আমাদের ভালো ছবি বানানোর দিকেই আগে মনোযোগ দিতে হবে, উৎসবের বিবেচনা পরে। উৎসব যা করে, তা হলো দৃষ্টিকে প্রসারিত করে। সংস্কৃতির বিনিময় ঘটায়। নতুন ভাবনার জারণ ঘটায়।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে