ফিচার I বরিষণে স্বজন-সঙ্গ
ঘোর বর্ষণমুখর দিনে পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে পারলে নিজেকে অনেকটাই চাঙা করা যায়। জীবন হয়ে ওঠে শুভ্র-সুন্দর
মেঘলা দিনে বৃষ্টির হিমেল পরশে বাঙালি মন হয়ে ওঠে কাব্যিক। খিচুড়ি ইলিশে ভূরিভোজ অথবা নিছক আড্ডায় হাসির ফোয়ারা কিংবা পছন্দের গানে বা সিনেমায় একান্ত সময়—প্রতিদিনের রুটিন থেকে মনটা পালাই পালাই করে! গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেই নাকে আসে মাটির সোঁদা গন্ধ, মন পাড়ি দেয় তেপান্তরে। তবে এই কেজো জীবনে নস্টালজিয়াও এক ফ্যান্টাসির নাম। সময় কোথায়! জীবন ও জীবিকার তাগিদে কিংবা প্রতিষ্ঠালাভের আশায় ব্যস্ততার বেগে আমরা আবেগহীন মেশিন যেন—কেবল ছুটে চলি নিরন্তর। ছুটতে ছুটতে ভুলে যাই অনেক সম্পর্ক, ভুলে যাই সম্পর্কগুলো সুন্দর রাখার মূল চাবিকাঠি—সময়।
যে পরিবারের জন্যই এই ছুটে চলা, পরিবারের মানুষের সঙ্গে কতটুকু সময় কাটাই আমরা? কতটুকু মনোযোগ দিয়ে ভাগ করে নিই সবার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার ছোট বড় অনুভূতিগুলো? কাজের ব্যস্ততায় উপেক্ষিত পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় না চাইতেই। নিয়ত ঠিক থাকলেও অযাচিত দূরত্ব ঘোচানো যায় না ছুটির দিনের আলস্যেও। তবে ব্যস্ততা আর ব্যক্তিত্বের মুখোশ খুলে পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ আয়োজনে নিজেকে আবারও ফিরে পেতে বর্ষণমুখর দিন এক দারুণ সুযোগ এনে দেয়।
ভোরে ঘুমভাঙা চোখ খুলতেই কাজের চিন্তা। রাতে বিছানা-বালিশের আদরে ঘুমে চোখ ভেঙে এলেও কমে না তার রেশ। কাজের জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছানোর চাপ, রাস্তায় ট্রাফিকের চাপ, ঘর্মাক্ত শরীর আর বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কাজে গিয়ে বসের চাপ, ব্যক্তিগত চাপ এবং পরিবার-পরিজনের এক্সপেকটেশনের চাপ আর হেরে যাওয়া অথবা পিছিয়ে পড়ার চাপ—সবকিছু ধুয়েমুছে নিয়ে যেতে পারে বৃষ্টিমুখর একটি সুন্দর দিন। যদিও শহুরে জীবনে ব্যস্ততার মাঝে বৃষ্টির আমেজ খুব একটা পাওয়া যায় না, উল্টো যাত্রাপথে বাড়তি যানজট, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি সমস্যা আনন্দের জায়গায় খানিকটা বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেই বৃষ্টি যদি হয় কোনো ছুটির দিনে? তাহলে তো সোনায় সোহাগা। না হলেও নিজেকে ফিরে পেতে জমিয়ে রাখা ছুটি তো একটা খরচ করাই যায়! বাইরে যাওয়ার তাড়া নেই, নেই কাজের চাপ; আছে শুধু অবসর, তবে আর বৃষ্টিবিলাসে বাধা কোথায়?
ঘোর বর্ষায় গৃহবন্দী জীবনে পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটানোর জন্য কী কী করা যায়? প্রথমেই প্রাধান্য পাক পরিবারের সদস্যদের চাওয়া। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা বাবা-মায়ের ইচ্ছেপূরণের মাধ্যমেই না হয় শুরু হোক এমন ‘আদর্শ’ দিনের পরিকল্পনা। একসঙ্গে সময় কাটানোই যেখানে মুখ্য, সেখানে রান্নাবান্নার কথাই প্রথমে মাথায় আসে ভোজনরসিক বাঙালির। চালে-ডালে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা হলে তো কথাই নেই! ফ্রিজে থাকা সবজি মিশিয়ে হতে পারে সবজি খিচুড়ি, ভুনা কিংবা ল্যাটা—যেটাই হোক না কেন; সঙ্গে গরু কিংবা মুরগির মাংস, ডিম ভাজা বা বেগুন ভাজা। কাজ যত ছোটই হোক, রান্না ও পরিবেশনে পরিবারের সবার এমনকি শিশুদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম।
কাজ ভাগ করে নিয়ে বা রান্নাবান্নার পাশাপাশি চলতে পারে পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং শখের জিনিসপত্রের যত্নআত্তি। ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ফ্রিজ, বাইক, গাড়ি, বুকশেলফ, শোকেস কিংবা অবহেলিত গৃহকোণ ঝকঝকে হয়ে উঠবে ঠিকই, তবে গল্পে গল্পে। শিশুদের ছোটখাটো দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়েই পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ইনডোর প্ল্যান্টস, বারান্দার গাছ বা পোষা প্রাণীর যত্ন দিনটাকে আরেকটু বিশেষ করে তুলতে পারে। টবের মাটি আলগা করে সার দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছ প্রোপোগেইট করা কিংবা আদরের বিড়ালকে গোসল করানো—সবাই মিলে একসঙ্গে করলে কোনটাকে কাজ বলে মনে হবে?
এমন দিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে হিট আইটেম যেকোনো ধরনের ইনডোর গেমস। লুডু বা ক্যারম—জনপ্রিয় ছোট-বড় সবার কাছেই। তা ছাড়া কার্ড গেম, যেমন তাসের নানা খেলায় সময় কাটুক অবলীলায়। মনোপলির বোর্ডে একটু একটু করে শেখা যায় হিসেবের নানা প্যাঁচঘোচ আর খেলার ছলে ভাষা শিক্ষার ভার নিয়ে নেয় স্ক্রাবল। জেংগা, জিগস পাজল, লেগো—ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটানো সম্ভব খেলায় খেলায়। তা ছাড়া পরিবারের সদস্যরা দুই দলে ভাগ হয়ে গানের খেলা বা পিকশনারি জমবে দারুণ!
যদিও বর্ষণমুখর বিশেষ দিন, তবু বুদ্ধিবৃত্তি ও শরীরচর্চা ভুলে গেলে চলে? খেলায় খেলায় অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাটা সহজ। তাই ইনডোর গেমস হিসেবে স্মৃতি পরীক্ষা, সুডোকু, ওয়ার্ড পাজল, দাবার মতো খেলা শিশুদের পাশাপাশি বড়দের মস্তিষ্কেও আলোড়ন তোলে। আর শরীরচর্চার ক্ষেত্রে হালকা ব্যায়াম, যোগাসন ও শারীরিক কসরত হতে পারে সুস্বাস্থ্য রক্ষার সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এতে বড়দের দেখাদেখি শিশুদের মধ্যেও গড়ে উঠবে স্বাস্থ্যসচেতনতা। তবে শুধু ছুটির দিন বা বিশেষ দিন নয়, শরীরচর্চাকে প্রাত্যহিক রুটিনের অংশ হিসেবেই ধরে নেওয়া উত্তম।
বৃষ্টির দিনগুলো শিশুদের জন্য রীতিমতো কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, বন্ধুদের সঙ্গে খেলার উপায় নেই। তবে আরকি, ঘরের কোণে মোবাইল ফোনে! মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপে আসক্তি কমিয়ে শিশুমনে সৃষ্টিশীলতার বীজ বোনা যায় কিন্তু এমন বৃষ্টির দিনে। আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস, সহজ কথায় ছবি আঁকা, রং করা, হাতের কাছে যা কিছু আছে, তা দিয়ে কিছু না কিছু তৈরি করা। তা হতে পারে কাপড়ের পুতুল, কাগজের পাখি, দইয়ের ভাঁড়ের ফুলের টব কিংবা প্যাকেটের রোবট। অপ্রয়োজনীয়, ভাঙা বা ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার মাধ্যমে শিশুর কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়ে, আবার রিসাইকেল ও রিইউজের অভ্যাসটাও গড়ে ওঠে। আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে বড়রা বাদ যাবেন কেন? রংতুলির সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কটা ঝালিয়ে নিলেই হয়। আর আগের অভিজ্ঞতা না থাকলেই কি, রঙের খেলায় মন রাঙাতে বয়স তো বাধা হতে পারে না!
চায়ের কাপে ঝড় তোলা বঙ্গমন এমন ঘন বরিষণে মেতে উঠবে না আড্ডায়, তা কি হয়? পরিবার তো বটেই, বাস্তবতার শত ব্যস্ততায় মাঝেমধ্যে ফোনকল বা সময়ে-অসময়ে ভিডিও কলের বন্ধুদের নিয়ে তেলে মাখা মুড়ি চানাচুর চিবিয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে আড্ডা দিতে এর চেয়ে ভালো দিন আর হয় না! এ-গল্প সে-গল্প আর লাগামহীন আড্ডায় গলা ছেড়ে গান, গিটারের টুংটাং, স্বরচিত কবিতা পড়া কিংবা প্রিয় কবিতা আবৃত্তি এমনকি স্থান সংকুলান হলে নৃত্যশৈলী—আনন্দ বিনোদনে আর কী চাই? সঙ্গে যখন স্বজন, নৈঃশব্দ্যটুকুও তো উপভোগ্য। দেখা হয়ে ওঠেনি এমন কোনো সিনেমা সবার সঙ্গে দেখার ভালো লাগাটুকুও কিন্তু অনন্য।
লক্ষ্যে পৌঁছানোর অতিরিক্ত ব্যস্ততাও লক্ষ্যের পথে বাধা হতে পারে, যদি পরিবার ও কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যায়। কথায় আছে, বৃষ্টি প্রকৃতির আশীর্বাদ। বৃষ্টির এমন এক দিনে দূর হোক সকল অনাহূত দূরত্ব, প্রকাশিত হোক জমে থাকা অনুভূতি। ঠোঁটে উচ্চারিত হোক বহুদিন না বলা ভালোবাসার কথা।
দীপান্বিতা ইতি
ছবি: ইন্টারনেট