skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ঈদ-মধ্যবর্তী খাদ্যসংযম

দুটি ঈদের মাঝখানে সময় মাত্র ৭০ দিন। মানে এক ঈদের ভারী খাবারের রেশ শেষ না হতেই আরেক ঈদ উপস্থিত। তাই পাতে পরিমিতির পরিচয় না দেখালে পুরো বছরের ডায়েট কিংবা ওজন কমানোর চেষ্টা হয়ে যেতে পারে বৃথা। ঈদ ভোজনে কিছু স্বাস্থ্যসচেতনতা মেনে চলা জরুরি। সেগুলোই বাতলে দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

কোরবানির ঈদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ দিন। মুসলমানরা আল্লাহর খুশির জন্য এই উৎসবে পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। ফলে গরু, খাসি, দুম্বা, উট প্রভৃতি পশুর মাংস সহজলভ্য হয়ে যায়। কোরবানিতে মুসলমানের ঘরে ঘরে দেখা যায় মাংসের আইটেম। যাদের রেড মিট খাওয়া নিষেধ অথবা খেলে সমস্যা, তাদের ক্ষেত্রেও চারপাশ থেকে নিষেধাজ্ঞার বেড়িবাঁধ তুলে দেওয়া হয়। আবার অনেকেই বলেন, কোরবানির মাংস খেলে শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা হয় না। আসলে সমস্যা হয় কি না, সেটির ব্যাখ্যা ভিন্ন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তা করতে গেলে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন যার ফ্যাটি লিভার রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল হাই এমনকি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, এমন কেউ যদি কোরবানির ঈদে টানা কয়েক দিন গরু-খাসির মাংস খাদ্যতালিকায় রাখেন, তাহলে এক সপ্তাহ পরেই তার লিপিড প্রোফাইল বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির মাধ্যমে গায়ে ব্যথা, পায়ে ব্যথা অর্থাৎ বাতের রোগের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যাদের ওজন নিয়ে সমস্যা রয়েছে, অর্থাৎ ওবেসিটি বা ওজনাধিক্যে ভুগছেন, তাদের জন্য রেডমিট খাওয়ার লিমিটেশনস রয়েছে।
মূলত রোজার ঈদ শেষে মাত্র ৭০ দিন পরেই কোরবানি ঈদের আনন্দ শুরু হয়। রোজার ঈদে যারা ভারী খাওয়া-দাওয়া করেছিলেন, তাদের ওজন পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আগেই যেহেতু আরও একটি উৎসবের সূচনা হয়, সে ক্ষেত্রে কোরবানির ঈদের ডায়েট যেন ঠিক থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তবে ঈদের পরে যারা কয়েক কিলো ওজন বাড়িয়ে ফেলেছেন, তাদের দ্রুত ডায়েট মডিফিকেশন করে নেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু পরামর্শ:
i সকালে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করুন। কেননা সকালের মিষ্টি রোদ শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সকালে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট হাঁটা ও ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে আপনাকে সুস্থ রাখবে। এ ছাড়া যাদের ডায়াবেটিস ইতিমধ্যেই অনিয়ন্ত্রিত, তাদের ক্ষেত্রেও সকালের হাঁটা অর্থাৎ ফাস্টিংওয়াক খুব ভালো কাজ করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের খুব সকালে হাঁটতে না যাওয়াই ভালো। কেননা এমন রোগীদের ভোরবেলায় হাই ব্লাড প্রেশারের ঝুঁকি থাকে।
i কোরবানি ঈদের খাদ্যতালিকায় সাধারণত ফাইবার থাকে না বললেই চলে। যেহেতু এই ঈদে রেড মিট এবং মাংসের আইটেমগুলোই সবার বাড়িতে থাকে এবং অনেকে হয়তো শাকসবজি খাওয়ার কথা ভুলেই যান, তাই ঈদের পরে সবচেয়ে কষ্টকর সমস্যার মধ্যে আরও একটি হলো কনস্টিপেশন। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা যাদের আগে থেকেই ছিল, তাদের অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে এবং ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় পুনরায় নিয়ে আসতে হবে। নতুবা পাইলস, এনাল ফিশার ইত্যাদি রোগের আশঙ্কা তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় প্রচুর পানি ও তরল খাবার রাখা চাই। খালি পেটে প্রতিদিন এক গ্লাস পানি খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। যারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে ১ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে ইসবগুলের ভুসি, চিয়া সিড, তোকমা দানা ইত্যাদি বেশ কাজে দেয়।
i ওজন নিয়ে যারা অধিক চিন্তিত, তাদের দ্রুত বদলে ফেলতে হবে খাদ্যাভ্যাস। অনেকেই মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের প্রতি ভীষণ আসক্ত। কেক, মিষ্টি, পায়েস, আইসক্রিম গ্রহণের জন্য কোনো অকেশন প্রয়োজন হয় না তাদের। তারা হয়তো খাওয়ার পর একটু মিষ্টি দই, একটা মিষ্টি অথবা কোনো মিষ্টান্ন খেয়ে নেন। মনে রাখতে হবে, মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলো নিজেই একটি সম্পূর্ণ মিল। তাই ওজন যাদের অনেকটাই বাড়তি, তারা মেইন কোর্স হিসেবে অল্প পরিমাণ মিষ্টিজাতীয় খাবার মাঝেমধ্যে গ্রহণ করতে পারেন; তবে মেইন কোর্সের সঙ্গে বা পরে নয়।
সত্যি বলতে, কিছু কিছু অভ্যাস বদলে নিলেই অনেকটা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা যায়। ডিসিপ্লিনড লাইফ সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র। দেখা যায় চারপাশের অনেক বয়স্ক ব্যক্তি এখনকার ইয়াং জেনারেশনের চেয়ে অধিক সুস্থ ও শক্তিশালী। বিষয়টি হলো তারা তাদের কিশোর-কিশোরী অবস্থায় বর্তমানের ইয়াং জেনারেশনের মতো ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, স্ট্রিট ফুড ইত্যাদিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তাই তাদের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখা যথেষ্ট সম্ভব হয়েছিল।
কোরবানির ঈদের পরে তাই যারা আবার ডায়েট শুরু করবেন বলে ভাবছেন, তারা কিছু খাদ্য উপাদান সংযুক্ত করে নিতে পারেন তালিকায়—
i রসুন: এটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাওয়ারফুল একটি মেডিসিনাল ফুড। রসুনে রয়েছে ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই প্রতিদিন এক কোয়া রসুন আপনার খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন। তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ওবিসিটি নিয়ন্ত্রণসহ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
i মাশরুম: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ছাড়াও উৎকৃষ্ট প্রোটিন পাওয়া যায় মাশরুম থেকে। বলা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রোটিনের উৎস কমে যাওয়ায় তা খুঁজতেই মাশরুম খাওয়ার প্রচলন শুরু। মাশরুমে রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান। যেমন ভিটামিন বি, নায়াসিন, ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন। যারা ওজন বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, তারা প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় মাশরুম স্যুপ বা মাশরুমের কোনো আইটেম রাখতে পারেন। শহুরে অ্যাপার্টমেন্টে থাকা মানুষগুলোর প্রায়শই ভিটামিন ডি লেভেল কম থাকতে দেখা যায়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে মাশরুম হতে পারে বেস্ট চয়েস। এতে থাকা ভিটামিন ডি ওজন কমাতে অনেকটাই সাহায্য করবে।
i কাঠবাদাম: ওজন কমানো ও হার্ট সুস্থ রাখতে কাঠবাদাম একটি ভালো খাদ্য উৎস। এটি স্ন্যাকস হিসেবে উৎকৃষ্ট। এ ছাড়া মেইন কোর্স যেমন ওটস, ফিরনি বা পায়েসের সঙ্গে এমনকি পাতলা খিচুড়ির সঙ্গে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে। ৬-৭টি কাঠবাদাম সারা রাত ভিজিয়ে সকালে খোসা ছাড়িয়ে ব্লেন্ড করে নিন। এটি ছেঁকে নিলে সম্পূর্ণ সাদা দুধের ফর্মে পাওয়া যায়, যাকে বলে আমন্ড মিল্ক। প্রতিদিন ১ কাপ কাঠবাদামের দুধ গ্রহণে ওজন কমতে পারে।
ওজন কমানোর জন্য সব সময়ই লাইফস্টাইল ও খাদ্যাভ্যাস একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যারা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত, তাদের ক্ষেত্রে ওজন কমানো ভীষণ মুশকিল। তাই যাদের ওজন বেড়ে গেছে, তারা অবশ্যই প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন সবজি স্যুপ, ডিম সেদ্ধ বা ছোলা সেদ্ধ। আরও রাখতে পারেন গ্রিন টি এবং অ্যাপেল সিডার ভিনেগার। সকালে খালি পেটে এক কাপ পানিতে ২ চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে খেয়ে নিতে পারেন। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণ ও বেলি ফ্যাট কমাতে সাহায্য করবে। তবে শারীরিক কোনো জটিলতা ইতিমধ্যেই যদি থাকে, তাহলে যেকোনো খাদ্য উপাদান খাদ্যতালিকায় সংযুক্ত করার আগে পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা গাইডলাইন নেওয়া ভালো।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top