ফিচার I সুবাসিত মসলা
বাড়িতে মাংস বা পোলাও রান্না হচ্ছে, অথচ দশ বাড়িতে সুবাস ছড়াচ্ছে না, তা কি হয়! এই সুবাস ছড়ায় মূলত কিছু মসলার গুণে
মসলা শব্দটি এসেছে আরবি ‘মশালহ’ থেকে। খাবারকে সুবাসিত করার জন্য রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ বা উদ্ভিদের অংশ থেকে নেওয়া উপাদানই মসলা। বিভিন্ন মসলার ব্যবহারে খাবারের স্বাদে ও ঘ্রাণে আসে ভিন্নতা। খাবার যত শাহিই হোক, মসলা ঠিকঠাকমতো দেওয়া না হলে সুস্বাদু হবে না।
কোরবানির ঈদে বাড়িতে বাড়িতে জমে মাংস, পোলাও ও বিরিয়ানির পসরা। তাতে দেওয়া হয় নানান সুবাসের মসলা। ওসবের অধিকাংশ চিনলেও এর সম্পর্কে হয়তো যথাযথ খোঁজ রাখেন না অনেকে।
i জাফরান: আরবি ‘জা-আফরান’ থেকে এসেছে জাফরান শব্দটি। তবে অনেকেই বলেন, ১২ শতকের প্রাচীন ফার্সি শব্দ ‘সাফরান’ থেকে এর উৎপত্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান মসলা হিসেবে জাফরান বিবেচিত হয়। অনেক জায়গায় একে ‘কুমকুম’ বা ‘কেশর’ নামেও ডাকা হয়। সবচেয়ে ভালো মানের জাফরান তৈরি হয় কাশ্মীরে। বলা হয়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসে প্রথম এই মসলা ব্যবহৃত হয়। বিরিয়ানি এবং পোলাও জাতীয় খাবার রান্নার সময় রং ও সুগন্ধির জন্য জাফরান দেওয়া হয়। অনেকেই শরবতে এবং মিষ্টান্নেও এটি ব্যবহার করে থাকেন।
i জয়ত্রী: এটি হলো গাছের শুকনো ছাল। ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপের চিরসবুজ গাছ থেকে এই মসলার উৎপত্তি। বিরিয়ানির মসলা হিসেবে জয়ত্রী ব্যবহৃত হয়।
i জায়ফল: জয়ত্রীগাছের রসাল ফলের খোসার ভেতর থেকে যে বাদামি পাপড়ির বীজ সংগ্রহ করা হয়, তা-ই জায়ফল। এর উৎপত্তিস্থলও ইন্দোনেশিয়ায়। সংস্কৃত ‘জাতিপত্রী’ থেকে জায়ফল শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। বিরিয়ানি রান্নায় জয়ত্রী ও জায়ফল—দুটিই বাটা মসলা হিসেবে ব্যবহার রয়েছে এর।
i তেজপাতা: এটি এক প্রকার উদ্ভিদ, যার পাতা মসলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। ফারসি শব্দ ‘তেজ’ থেকে এসেছে শব্দটি। এর অর্থ হলো তীব্র গন্ধ। তেজপাতা গাছ মূলত ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনে জন্মে। রান্নায় সুগন্ধি বাড়াতে এই শুকনো পাতা ব্যবহার করা হয়। পোলাও, মাংস ও বিরিয়ানি রান্না তেজপাতা ছাড়া ভাবাই যায় না।
i হিং: একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ থেকে আগত মসলা। অঞ্চলভেদে ‘হিঙ্গু’, ‘হিংগার’, ‘কায়াম’, ‘ইঙ্গার’ বিভিন্ন নামে পরিচিত। সংস্কৃত ভাষায় একে হিঙ্গু ও ফারসি ভাষায় আঞ্জাদান নামে ডাকা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে হিঙ্গুর ব্যবহারের প্রচলন অনেক প্রাচীনকাল থেকে। হিংয়ের কথা ভগবদগীতা এবং পুরাণেও উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগেও হিমাচল প্রদেশে হিংয়ের আবাদ হতো। শুধু ভারতেই ৭০ শতাংশ হিং ব্যবহৃত হয়। আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালারা হিং ব্যবসা করতেন। বাংলাদেশেও তারা যেসব ব্যবসা করতে এসেছিলেন, এগুলোর মধ্যে হিং ছিল অন্যতম। বাংলার প্রতিটি রান্নাঘরে তখন এই মসলা পাওয়া যেত। মাছ-মাংস রান্নায় স্বাদ ও গন্ধ বাড়ানোর জন্য এই মসলার সুনাম রয়েছে।
i দারুচিনি: গরুর কালাভুনা থেকে খাসির রেজালা, পোলাও থেকে বিরিয়ানি—সবকিছুতেই ব্যবহৃত হয় দারুচিনি। একে অতি প্রাচীন একটি মসলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, প্রায় দুই হাজার বছর খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসরীয়রা দারুচিনি ব্যবহার করেছেন। তবে তখন এটি মসলা হিসেবে নয়, মৃতদেহ মমি করার কাজে ব্যবহৃত হতো। দারুচিনির উৎপত্তি শ্রীলঙ্কায়। এই গাছ আবিষ্কার করেছিলেন একজন পর্তুগিজ। দারুচিনিগাছের ভেতরের ছাল থেকে দারুচিনি মসলা তৈরি করা হয়। এটি একটি চিরসবুজ উদ্ভিদ, যা প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি মসলার মধ্যে একসময় দারুচিনিকে গণ্য করা হতো। এর মূল্য এতই বেশি ছিল, সাধারণ মানুষ তা ভোগ করা দূরে থাক, ব্যবহারের কথাও ভাবতে পারতেন না।
i এলাচি: অ্যামোমাম ও ইলেটেরিয়া গোষ্ঠীর কাছ থেকে আগমন ঘটেছে এলাচির। এই মসলা আদাজাতীয় বংশের একটি ফলন। অর্থাৎ আদা ও এলাচি একই বংশজাত। পৃথিবীর তৃতীয় মূল্যবান মসলা হিসেবে একে গণ্য করা হয়। দামের দিক দিয়ে জাফরান ও ভ্যানিলার পরেই এর অবস্থান। ভারতের উত্তর প্রদেশে, মহীশুর, তামিলনাড়ু, গুজরাট, অন্ধ্র প্রদেশ ও কেরালার পাহাড়ি অঞ্চলে এলাচি চাষ করা হয়। এ ছাড়া গুয়াতেমালা, সিকিম ও শ্রীলঙ্কাতেও এর চাষ হয়। পোলাও, বিরিয়ানি এবং সব ধরনের মাংস রান্নাতেই রয়েছে এলাচির ব্যবহার। রান্নায় সুবাস ছড়াতে এটি বেশ কার্যকর মসলা।
i লবঙ্গ: লবঙ্গ শব্দের অর্থ হলো ছেদন। গাছের অংশ থেকে উৎপত্তি বলে একে লবঙ্গ বলা হয়। এই মসলার উৎপত্তিস্থল ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জে। বহু শতাব্দী ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রামায়ণ, চরকসংহিতা, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থে। কালিদাসের রঘুবংশ এবং জয়দেবের গীতিগোবিন্দ কাব্যেও লবঙ্গের উল্লেখ আছে। আস্ত অথবা গুঁড়া অবস্থায় লবঙ্গকে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এর গন্ধ কড়া বলে অল্প দিলেই রান্নায় সুবাস ছড়ায়। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের প্রায় সব দেশেই এর ব্যবহার বিদ্যমান।
i মেথি: মেথি একটি মৌসুমি গাছ। এই গাছের পাতাকে শুকিয়ে সুগন্ধি মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়াকে মেথির উৎপত্তিস্থল ধরা হয়। মেথি পাতাজাতীয় সবজি, মসলা অথবা ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাষ হয়ে থাকে। পাঁচফোড়নের অন্যতম উপাদান হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। মাংস রান্নায় মেথির ব্যবহারে অন্য রকম এক স্বাদ-গন্ধ আসে।
i কেওড়া: পোলাও, বিরিয়ানি অথবা বিয়েবাড়ির খাবার মানেই কেওড়ার ঘ্রাণ! কেওড়ার জল আসে প্যান্ডানাস গাছের কাণ্ড থেকে। রসগোল্লা, রসমালাই, গোলাপজামে যেমন কেওড়া জল ব্যবহৃত হয়, বিরিয়ানির স্বাদ বৃদ্ধিতেও তা দারুণ জনপ্রিয়।
i পোস্ত: এ এমন একধরনের তেলবীজ, যা আফিম থেকে পাওয়া যায়। হাজারো বছর ধরে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ এই ছোট বৃক্ষের মতো দেখতে বীজটি চাষ করে আসছেন। এই বীজগুলো আস্ত অথবা গুঁড়া অবস্থায় বিভিন্ন খাদ্যে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি পিষে পোস্তদানার তেলও তৈরি হয়। সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলায় পোস্ত চাষ বেড়েছিল। মোগল খাবারের রান্নায় স্বাদ বাড়াতে বা ঝোল ঘন করতে পোস্তর অনেক কদর ছিল। মাংস রান্নাতেও পোস্ত ব্যবহার করা হয়।
i জিরা: বাঙালির প্রতিদিনের রান্নায় জিরার ব্যবহার অপরিসীম। মাছ, মাংস ও সবজি বা ভাজি রান্নায় এ মসলা ছাড়া চলে না। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লেভান্তে জিরা উৎপত্তি লাভ করেছিল। হাজার বছর ধরে জিরা মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সিরিয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের জিরার বীজ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিসরের নব্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানেও এর নমুনা পাওয়া গেছে। রান্নায় এর গুঁড়া ব্যবহারে সুন্দর সুবাস ছড়ায়।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতন অনেক মানুষই রান্নায় মসলা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই শরীরের জন্য ভালো নয়। তবে কিছু মসলার ঔষধি গুণও রয়েছে। জেনে পরিমাণমতো খেলে তা শরীরের উপকারই মিলবে।
i সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ছবি: ইন্টারনেট