ফিচার I বিষণ্নবিনাশী খাদ্যসম্ভার
ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যা! মোটেও কাম্য নয়। মানসিক চাপ সইবার ক্ষমতা সবার সমান নয়। এর ওপর আছে ‘সিজনাল ইফেক্টিভ ডিজঅর্ডার’। বৃষ্টির দিনে বাড়ে এই ব্যাধি। তবে মানুষ চাইলেই স্ট্রেস প্রতিরোধ করতে পারে। নানান পদ্ধতি আছে তো বটেই, মনের ওপর খাবারের প্রভাবও অনেক। কিছু খাদ্য বিষণ্নবিনাশী হিসেবেও কাজ করে
ব্যস্ততা। ঘড়ির কাঁটায় মুখ গুঁজে চলা নাগরিক জীবন। নিজেকে দেওয়ার মতো সময়টুকু যেন কারও নেই। কিন্তু মানুষের ভেতরে রয়েছে আরও একজন একাকী মানুষ। যদিও সে নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে না। এসব নাগরিক চাপ এবং মানসিক দ্বন্দ্ব বহন করার শক্তি তার নেই। ফলে একটু একটু করে জমতে থাকে একাকিত্ব। ব্যস্ততা ও মানসিক যন্ত্রণার চাপে একদিন সে হয়ে পড়ে বেসামাল। চূড়ান্ত বিষণ্নতা ঘিরে ধরে তাকে। অথচ প্রতিদিনের একটু একটু পরিচর্যায় মনকে ফিরিয়ে রাখা যায় ডিপ্রেশন থেকে।
আবহাওয়ার কারণেও মন বিষণ্ন হতে পারে। একে বলে ‘সিজনাল ইফেক্টিভ ডিজঅর্ডার’। জার্মানির একদল গবেষক মনের অবস্থার ওপর আবহাওয়ার প্রভাববিষয়ক গবেষণা করেছেন। তাতে মিলেছিল বিষণ্নতার সঙ্গে আবহাওয়ার যোগসূত্র। ১৯৮৫ সালে বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। গবেষণামতে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে মানুষের মন চাঙা থাকে। কিন্তু সূর্যের আলোর কম প্রাপ্তি মানুষকে বিষণ্ন করে তোলে। বৃষ্টিমুখর দিনে সূর্যের আলোর অপ্রতুলতা মানুষের মনকে নিস্তেজ করে দিতে পারে। ফলে বিষণ্নতা জেঁকে ধরার আশঙ্কা থাকে। এই বিষণ্নতাকে হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। মরণঘাতী রোগের মতো এটিও মানুষকে ঠেলে দিতে পারে মৃত্যুর দুয়ারে। আজকাল পত্রিকার পাতা ওলটালে হতাশাজনিত মৃত্যুর সংবাদ হরহামেশা দেখা যায়।
নানাভাবে কাটানো যায় ডিপ্রেশন। এই নিবন্ধে শুধু বিষণ্নবিনাশী খাবার নিয়েই আলাপ হবে। বেশ কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওটেগোতে একটি গবেষণা হয়েছিল। ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী মোট ১৭১ জনের ওপর চালানো হয়েছিল সেই গবেষণা। সবাই ছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক। গবেষণায় তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার সঙ্গে মানসিক বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্ক নিরূপণ করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের তিনটি দলে ভাগ করে একটি দলকে স্বাভাবিক খাবার খেতে বলা হয়; আরেকটিকে ফল ও সবজি এবং শেষেরটিকে অতিরিক্ত ফলমূল ও সবজি খেতে দেওয়া হয়। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পর তাদের মানসিক অবস্থা নির্ণয় করে দেখা যায়, যারা ফল ও সবজি খেয়েছেন, তাদের মানসিক অবস্থা বেশ উন্নত। আগের তুলনায় তাদের মুডের ঘটেছে উন্নতি।
শরীরে ফিরোটোনিনের অভাবে মানুষ বিষণ্ন হয়ে পড়ে। এমনটাই মত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা আলগিন। তাই বিষণ্নতাকালে সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুধ, কলিজা, পালংশাক ও পুঁইশাক খেলে সুফল মিলতে পারে। কেননা এসবে মেলে ফিরোটোনিন, যা বিষণ্নতা দূর করতে সাহায্য করে।
ডিপ্রেশন এড়াতে কিছু খাবার যেমন খেতে হয়, তেমনি কিছু এড়িয়েও যেতে হয়। যেমন বিষণ্নতাকালে ক্যাফেইন ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বাদ দিতে বলেন বিজ্ঞরা। চা-কফি এসব পানীয়ে থাকা ক্যাফেইন মস্তিষ্ককে আরও বিষণ্ন করে তুলতে পারে। অনেক সময় হজমের সমস্যার কারণেও বিষণ্নতা গ্রাস করতে পারে। তেল-চর্বি জাতীয় খাবার হজম হতে সময় বেশি লাগে। এ সময় শরীরে রক্তসঞ্চালনে সাময়িক বাধা পড়তে পারে। ফলে অবসাদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কিছু খাবার ধীরে ধীরে মানুষের বিষণ্নতা কাটায়। যেমন:
তৈলাক্ত মাছ: টুনা, স্যামন কিংবা এজাতীয় মাছে প্রচুর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড মেলে। এই উপাদান মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, মাছ খেলে অবসাদজনিত সমস্যা কমে। এ ক্ষেত্রে সপ্তাহে দু-তিনবার তৈলাক্ত মাছ খাওয়া চাই। দেশি কিংবা সামুদ্রিক মাছ খেলেও বিষণ্নতা থেকে মুক্তি মেলার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাদাম: ওমেগা থ্রি মিলবে বিভিন্ন বাদামেও। তাই মাছ খাওয়া ব্যয়বহুল মনে হলে বাদাম খেয়ে বিষণ্নতা কাটানো যেতে পারে। এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ আখরোট নিয়মিত খেলে অবসাদপ্রবণতা পালায়। উপকার মিলবে কাজুবাদামেও। এটি জিঙ্কের আধার। শরীরে জিঙ্কের অভাবে হতাশা ও উদ্বেগ বাড়ে। তাই দৈনন্দিন খাবারে কাজুবাদাম রাখা ভালো।
মটরশুঁটি: রক্তে শর্করার মাত্রা হেরফের হলেও মনমেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। তাই তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাওয়া যেতে পারে মটরশুঁটি। এতে রয়েছে প্রচুর ফাইবার। তা ছাড়া মেলে প্রয়োজনীয় প্রোটিন।
শস্যজাতীয় খাবার: হতাশা ও মানসিক চাপ কাটাতে এগুলো পথ্যস্বরূপ। বিশেষ করে মিষ্টি আলু, বাদামি চালের ভাত, অপরিশোধিত আটার রুটি ইত্যাদি।
মাশরুম: এটি দুভাবে বিষণ্নতা প্রতিরোধে সহায়তা করে। যেমন রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে আনে। ফলে মানসিক অবস্থা শিথিল হয়। তা ছাড়া এটি সেরোটোনিন হরমোন তৈরি করে, যা মনকে চাঙা করতে সক্ষম। তা ছাড়া মাশরুম পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে। ফলে হজমজনিত বিষণ্নতা থাকলে সেটাও কাটে।
দুগ্ধজাত খাবার: কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খেলে মন ভালো থাকে। কেননা সেগুলোতে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি থাকে। এই দুই উপাদানই বিষণ্নতা কাটাতে সক্ষম।
সবুজ চা: বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ—দুটিই সারায় গ্রিন টি। এতে থাকা থিয়ানিন উপাদান কাজটি করে, যা মূলত একধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড।
হলুদযুক্ত তরকারি: হলুদে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। ফলে তরকারির পাশাপাশি চায়ে যোগ করে খেলে মনের লাগাম নিজের হাতেই থাকবে।
ওটমিল: এর কার্বোহাইড্রেট শরীরে সেরোটিন উৎপন্ন করে, যা মনে প্রশান্তি এনে দিতে সক্ষম।
চকোলেট: ডার্ক চকোলেটে থাকা ফিনাইলেথাইলামাইন মগজকে শান্ত রাখতে পারে। তা ছাড়া এই চকোলেটে থাকা পলিফেনল মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। স্ট্রেসের সময় ডার্ক চকোলেট খাওয়া যেতে পারে, মন নিমেষেই ভালো হবে।
পেঁয়াজ: এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মন ভালো করতে কার্যকর। তা মুড পরিবর্তনে সাহায্য করে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পেঁয়াজ রাখলে বিষণ্নতা থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
টমেটো: এতে থাকা ফলিক অ্যাসিড এবং আলফা লিপোক অ্যাসিড হতাশা দূর করতে পারে। গবেষণায় মিলেছে, যারা হতাশায় ভুগছেন, তারা নিয়মিত টমেটো খেলে উপকার মেলে।
টক দই: এটি খেলে শরীরে ‘ফিল-গুড নিউরোট্রান্সমিটার’ বের হয়। ফলে বিষণ্নতা ভাব কাটে। এটি মানুষের মগজে ডোপামিন ও নোরিপাইনেফ্রিন নিঃসরণ করে। এতে মানসিক অবস্থা ভালো হয়। তা ছাড়া দইয়ে থাকে অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রিপ্টোফ্যান, যা সেরোটোনিন উৎপাদনের মাধ্যমে মন ও শরীর শান্ত রাখে।
পালংশাক: এতে থাকে উচ্চ মাত্রার ম্যাগনেশিয়াম, যা বিষণ্নতা দূর করতে সক্ষম।
মানুষের শরীর ছাড়াও মনের ওপর খাদ্যের প্রভাব অনেক। খাদ্য গ্রহণ মানুষের দৈনন্দিন একটি বিষয়। ফলে এ বিষয়ে সচেতন থাকলে ডিপ্রেশন অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট