স্বাদশেকড় I পপকর্নের সুলুকসন্ধান
বেশ প্রাচীন খাবার। আদিকালের গুহায়ও মিলেছে এর অস্তিত্ব। তখনকার সংস্কৃতিতেও ভূমিকা রেখেছিল ভুট্টাজাতীয় তৃণ থেকে আসা এ খাদ্য। একসময় থিয়েটারে নিষিদ্ধ থাকা পপকর্ন বর্তমান সিনেমা হলের অবিচ্ছেদ্য এক রসদ
ধারণা করা হয়, পপকর্নের আঁতুড়ঘর মেক্সিকো। অবশ্য আমেরিকা আবিষ্কারের শত বছর আগেও চীন ও ভারত অঞ্চলের পপকর্নের হদিস মিলেছে। নিউ মেক্সিকোতে একটি বাদুড়ের গুহা আছে। ‘ব্যাট কেভ’ নামে পরিচিত। বেশ পুরোনো। সেখানেই প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বছর আগের পপকর্ন খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তা ছাড়া সে দেশে ১ হাজার ৭০০ বছর আগের হাতে আঁকা একটি ছবিতে পপকর্নের অস্তিত্ব মিলেছে। ছবিটি শস্যদেবতার। যার মাথায় থাকা মুকুটটি তৈরি হয়েছে পপকর্ন দিয়ে।
মেক্সিকো সিটিতেও ৮০ হাজার বছর পুরোনো পপকর্নের সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তা দেখে তারা অনুমান করেছেন, পপকর্ন আদি আমেরিকানদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সেখানকার আদিবাসীরা মুকুট ছাড়াও নাকফুল হিসেবে ব্যবহার করতেন পপকর্ন। এমনকি ধন্যবাদ জ্ঞাপনকালে উপঢৌকন হিসেবে তা একে অপরকে দিতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পপকর্ন বোর্ডের এক তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ভুট্টার চাষ শুরু হয়েছিল মেক্সিকোতে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন, ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে পপকর্ন সম্পর্কে জানেন। তা ছাড়া পেরুর জীবাশ্ম দেখে বিজ্ঞদের ধারণা, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ভুট্টা থেকে প্রথম পপকর্ন তৈরি করা হয়েছিল ওই অঞ্চলে।
পপকর্ন যে ভুট্টা ভেজেই হতো, এমনটা না-ও হতে পারে। প্রাচীনকালের তথা ৮ হাজার বছর আগের পপকর্ন হয়তো ভুট্টা থেকে আসত না। তা মিলত টিওসিন্টে নামের শস্য থেকে। যা এক প্রকার বন্য ঘাস। অনেকটা ভুট্টার মতোই দেখতে।
সমকালীন আমেরিকানদের কাছে উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পপকর্ন। সেই শতকে অবশ্য তা বিক্রি হতো পার্লস কিংবা ননপারিল নামে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের মানুষ এ নামেই চিনতেন খাবারটি। ‘পপড কর্ন’ নামটি সম্ভবত চালু হয় ১৮৪৮ সালের আগে আগে। ডিকশনারি অব আমেরিকানিজমে শব্দটি যুক্ত করা হয় সেই সালে। খাবারটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছায় বিংশ শতকে। সে সময় ওই অঞ্চলের পথখাবার হয়ে ওঠে এটি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে উত্তর আমেরিকার কিছু লোক চিলিতে গিয়েছিলেন। মূলত তিমি শিকার করতে। সেখানে তারা নানান ধরনের পপকর্ন দেখতে পান। শিকারিরা পপকর্নের স্বাদে মজে যান। ফলে তা নিজেদের সঙ্গে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। এভাবেই পপকর্ন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লোকে নিজের গরজেই বাড়িতে পপকর্ন তৈরি করে খেতে থাকেন।
সে সময় তারের ঝুড়িতে ভুট্টা ভেজে তৈরি করা হতো পপকর্ন। পরে ১৮৮৫ সালে পকপর্ন মেশিন আবিষ্কার করেন শিকাগোর চার্লস ক্রেটর্স। ফলে খাবারটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাজারে আসতে থাকে ব্র্যান্ডের পপকর্ন।
এখন সিনেমা দেখার সঙ্গে পপকর্ন খাওয়া জুড়ে গেলেও একশ বছর আগে বিষয়টি এমন ছিল না। সিনেমার সঙ্গে পপকর্ন জুড়ে যাওয়ার ঘটনা বেশ চমকপ্রদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকানদের অন্যতম পছন্দের বিনোদন ছিল নির্বাক সিনেমা। অভিজাত শ্রেণির জন্য তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু থিয়েটার বা সিনেমা হল। সেগুলোর মেঝেতে থাকত পরিষ্কার কার্পেট। কম্বলেরও ব্যবস্থা থাকত। খাদ্যবস্তু নিয়ে ঢুকলে থিয়েটার হল নষ্ট হয়ে যাবে, এ জন্য কোনো প্রকার খাবার নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তা ছাড়া নির্বাক সিনেমা হওয়ার কারণে মচমচ করে পপকর্ন খেলে অন্যের অসুবিধা হতে পারে, তাই এ খাবার আনাও ছিল বারণ। নির্বাক সিনেমাগুলোতে সাবটাইটেল কিংবা ইন্টারটাইটেল থাকত। ওসব সিনেমা নিরক্ষরদের বোধগম্য ছিল না।
১৯২৭ সালে চালু হয় সবাক সিনেমা। এতে থিয়েটারগুলোতে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। মাত্র তিন বছরের মাথায় দেখা যায়, প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৯০ মিলিয়ন দর্শক জড়ো হন সিনেমা দেখতে। ফলে সেখানে খাদ্য ব্যবসার সম্ভাবনা জেগে ওঠে। বিশেষ করে স্ন্যাক্সজাতীয় খাবারের। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য তখনো থিয়েটার মালিকেরা ভেতরে খাবার নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেননি। এরপর শুরু হয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, যা পপকর্নের প্রসারের জন্য ছিল এক প্রকার আশীর্বাদ। সিনেমাকেন্দ্রিক বিনোদন ছিল সস্তা। তাই মন্দার মধ্যেও মানুষের সিনেমা দেখার ঝোঁক কমেনি। তা ছাড়া পপকর্নের দাম ছিল সাধ্যের মধ্যেই। সুযোগ বুঝে খুদে উদ্যোক্তারা মেশিন কিনে পথেঘাটে পপকর্ন তৈরি করতে থাকেন। সেগুলো বিক্রি করতে থাকেন থিয়েটারগুলোর দুয়ারের সামনে। কিন্তু তখনো থিয়েটার মালিকেরা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন। তাই দর্শকেরা পকেটে লুকিয়ে ভেতরে নিয়ে যেতেন পপকর্ন। এই ঘটনা দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। ফলে সিনেমা হল মালিকেরা পপকর্নকে উপেক্ষা করে আর বেশি দিন থাকতে পারেননি। এতে পপকর্নের বিক্রি আরও বেড়ে যায় এবং সিনেমার সঙ্গে এই খাবারের মিতালি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু পপকর্ন ব্যবসায়ীদের লাভ ও উন্নতি দেখে থিয়েটার মালিকদের চোখ ছানাবড়া হতে শুরু করে! সেই অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে এমন কিছু ব্যবসায়ীর সন্ধান মেলে, যারা শুধু পপকর্ন বিক্রি করেই বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেন। তাই সিনেমা হল ম্যানেজাররা ভাবলেন, এই ব্যবসা নিজেরা করলেই তো হয়! এতে নিজেদের পাশাপাশি সিনেমা হল ব্যবসাও আরেকটু পয়সার মুখ দেখবে। ফলে একসময় ব্যবসাটি লুফে নেয় সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ। এভাবে পপকর্নই হয়ে উঠেছিল সে সময়ের সিনেমা হল রক্ষার অন্যতম অবলম্বন।
বর্তমানে পপকর্ন ছাড়া সিনেমা দেখার কথা যেন ভাবাই যায় না! আমাদের দেশে শুধু সিনেমা দেখতে দেখতে পপকর্ন খাওয়ার চল থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে এ খাবার আরও বড় পরিসরে বিস্তৃত। সেখানকার ছয়টি অঞ্চলের মানুষ নিজেদের এলাকাকে ‘পপকর্ন ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঞ্চলের সরকারি নাশতা হচ্ছে পপকর্ন। সে দেশে রয়েছে পপকর্ন বোর্ডও। এখন সিনেমা হলে তো বটেই, বাসায় বসে ঘরোয়া পরিবেশে সিনেমা উপভোগ করার সময়েও অনেকে পপকর্নকে সঙ্গী করেন।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট