ফিচার I লোকজ নকশায় বৈশাখী সম্ভার
বৈশাখের প্রথম দিনে যে বাঙালিয়ানার প্রকাশ ঘটে পোশাকে, তার সৌন্দর্য ও নতুনত্ব মূলত ডিজাইনারদেরই অবদান। লিখেছেন চন্দ্রশেখর সাহাবাংলাদেশ ও বাঙালিয়ানা তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে, যখন বৈশাখের সূচনালগ্নে নববর্ষের আবাহনে মুখর হয় বাঙালি। শিল্পসংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাকচর্চা, আপ্যায়নে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য তুলে ধরে। নিজেদের ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে উদ্বুদ্ধ হয় সর্বজনীন শুভবোধে। এই উদ্যাপন চলে নববর্ষের প্রথম প্রভাতের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
কীভাবে আত্মপরিচয়ের গৌরবকে ঘষে-মেজে আরও উজ্জ্বল করা যায়, সেই প্রয়াস পয়লা বৈশাখের মর্মে বিরাজমান। রাজধানী, মফস্বল কি গ্রাম- সব জায়গায় উৎসবমুখর উদ্যাপনের এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। নিজের অজান্তে বাঙালি মেতে ওঠে আপন সংস্কৃতির জানান দেয়ার উৎসবে। দেশীয় পোশাকশিল্পে যারা কাজ করছেন নববর্ষের পোশাকসম্ভার ক্রেতার হাতে তুলে দিতে, সবার লক্ষ্য একটাই- পোশাকে বৈশাখের প্রতিচ্ছবি। প্রায় ছয় মাস ধরে তারা এর থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করে থাকেন। যাতে পোশাক সংগ্রহকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। ডিজাইন স্টুডিওর সৃজনশীল ও মেধাবী পেশাজীবীরা গবেষণায় লব্ধ নতুন ভাবনাকে সুতা, কাপড় ও রঙের মাধ্যমে উপস্থাপনে মেতে ওঠেন।
বিগত ২০ বছরে বৈশাখী পোশাক ভাবনায় নতুনধারার চর্চা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। ক্রেতার মনোবাসনা পূরণে উদ্যোগী হয়েছে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো।
ডিজাইনাররা অনুপ্রাণিত হয়েছেন লোকজ ধারাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে পোশাকের নকশায় অন্তর্ভুক্ত করতে। ক্রেতাদের আস্থায় গুরুত্ব দিয়ে ফ্যাশন হাউজগুলো তাই সচেষ্ট থেকেছে সব সময়। তাতে কখনো উপেক্ষিত হয়নি সময়ের দাবি ও পরিবর্তনের ধারা।
শাড়ি, পাঞ্জাবি, অন্যান্য পোশাক, এমনকি গ্লোবাল ফ্যাশনের প্রতীক টি-শার্টও লোকজ মোটিফে দৃষ্টিনন্দনভাবে অলংকৃত হয়েছে। চিত্রিত পুতুল, নকশি পিঠা, আলপনা, হাতপাখা, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, লোকজধারার চিত্রকলা, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীসরা, মন্দিরের টেরাকোটা নকশা, সাঁওতালদের দেয়ালচিত্র ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পোশাকের সৌন্দর্যে। প্রতিবছরই সব প্রতিষ্ঠান সচেষ্ট থেকেছে গবেষণার গভীরে গিয়ে ঐতিহ্যের প্রাণভোমরাকে সযত্নে পোশাক নকশার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে।
নতুন পোশাকে নিজেকে নবরূপে আবিষ্কারের প্রয়াস বাঙালি নববর্ষ উদ্যাপনের প্রধান একটি দিক। কোলের শিশুও শাড়ি বা পায়জামা-পাঞ্জাবি অথবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। বাঙালিয়ানা, বৈশাখের বর্ণময়তা ও লোকজ মোটিফের অলংকরণ তাতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
পাশ্চাত্য প্রভাবের পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আকর্ষণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ডিজাইনাররা নিজ নিজ হাউজের বৈশাখী কালেকশনে প্রকাশ করেন বাংলার সংস্কৃতির চিরায়ত অনুষঙ্গরাশির সৌন্দর্য। বছরে অন্তত এই একটা সময় তাদের সৃজনশীলতা আকাশসংস্কৃতি ও পাশ্চাত্য সিনেমার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে।
দেশজ ও লোকজ এবং কারুশিল্পজাত অলংকরণের বৈশিষ্ট্যগুলো পোশাকের জমিনে সুবিন্যস্তভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়ে যায় নকশা। সেখানে কাপড়, রঙ আর মোটিফের সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থানে সৃষ্টি হয় নান্দনিক কোলাজ। দেয় আত্মপ্রকাশের সেই সুযোগ, যাতে ঐতিহ্যগত স্বকীয়তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বাঙালিয়ানার এই প্রকাশ ক্রেতাকে আকর্ষণ করে।
নববর্ষের পোশাকে ডিজাইনাররা একদিকে সুচারুভাবে ঐতিহ্যের মূল বিষয়টির শুদ্ধতা বজায় রাখতে পারেন, অন্যদিকে নতুনত্বও সৃষ্টি করেন। প্রতিবার, প্রতি বৈশাখে। দেশ, কাল, পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল পোশাকের ধারায় শাড়ি ও পাঞ্জাবি এখনো সগৌরবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এতে ভূমিকা রেখেছে উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান, ডিজাইনার ও ক্রেতাদের দেশপ্রেম আর বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
যুগ যুগ ধরে চর্চিত লোকশিল্পের ধারা অমলিন থাকবে আবহমান বাংলায়। বিশ্বের সব দেশের মানুষ নিজের মতো করে, নিজস্ব সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করে থাকে। অনুপ্রাণিত হয় আপন জাতিসত্তার ঐতিহ্যে।
নববর্ষের পোশাকের নকশাশৈলীতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায় অসাধারণ নৈপুণ্য। লক্ষণীয় যে, ডিজাইনাররা কীভাবে বিনির্মাণ এবং রূপান্তরের কাজটি সম্পন্ন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরাচিত্রের মধ্যে রঙের বিন্যাস, রেখার ধরন, তুলির টান ও মোটিফের বৈশিষ্ট্য- সবই কারুশিল্পীর সৃজনশীল মনের ক্যানভাসে আঁকা শিল্পকর্ম। সাম্প্রতিক সময়ের একজন চিত্রশিল্পী বিষয়টিকে মনোজগতে ধারণ করে, নতুন সরার গল্পকেই চিত্রায়িত করে গেছেন। সেই সরার বিষয়বস্তু অনুসরণ করে প্রেরণার উৎস থেকে আবার রচিত হয়ে যায় বৈশাখের পোশাকের বর্ণময় সম্ভার। বেশ কয়েক বছর আগে, রঙ-এর বৈশাখ কালেকশনের প্রেরণা হয়েছিল চিত্রশিল্পী সুকুমার পালের সরাচিত্র। সেই নকশাকে রূপান্তরিত করা হয় পোশাকের মোটিফে। এই থিম সেবার বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
লেখক : গবেষক ও নকশাবিদ, ডিজাইনার
ছবি: রঙ বাংলাদেশ আর্কাইভ