skip to Main Content

ফিচার I হেঁশেল অহং

হেঁশেলের অভ্যন্তরও এক বর্ণময় আর বিচিত্র জগৎ। সেখানে রয়েছে একক কৃতিত্বের পাশাপাশি টিমওয়ার্কের সৌন্দর্য। কিন্তু যারা নিজেদের শ্লাঘা আর অহং ত্যাগ করে দলের হয়ে উঠতে পারবেন, তারাই হন ঋদ্ধ ও সফল। এই উপলব্ধি নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন সেলিব্রিটি শেফ শুভব্রত মৈত্র

আমরা সবাই এক। তবে আমাদের সবারই একটি বিষয় আছে। এর মধ্যে কেউ হয়তো কারও থেকে একটু এগিয়ে। কেউবা বাস্তবমুখী। অবশ্য আমরা সবাই একইভাবে জন্মাই। আমরা অনেক কিছু জন্মসূত্রে পাই না, কিন্তু বেড়ে ওঠার সময় বেশ কিছু বিষয় দ্রুততার সঙ্গে আমাদের সঙ্গী করে নিই। আমরা চাই অন্যদের পিছে ফেলে এগিয়ে যেতে। অথচ প্রত্যাশা করি, অন্যরা যেন আমাকে ফেলে না যায়। এতেই আমরা এগিয়ে যাই; অনিশ্চয়তায় পাই আত্মবিশ্বাস, এমনকি সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর ভিত গড়ে তুলি।
আমি একটি ছোট পরিবারে বড় হয়েছি। মা-বাবা-ছেলে। দেশভাগের সময় আমার দাদু-ঠাকুমা এবং অন্যদের সঙ্গে এপার বাংলা ছেড়ে ওপারে থিতু হতে হয়েছে বাবা ও মাকে। নতুন জায়গায় গিয়ে তাদের ভাগ্যকে ধাপে ধাপে গড়ে নিতে হয়েছে। আমার বাবা-মা উভয়েই কর্মজীবী। ফলে সেই সব প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের আমার ভীষণ হিংসে হতো, যাদের মাকে তারা সব সময় কাছে পেত। সেই সব মা তাদের অবসরে আচার বানাতেন, মিষ্টি বানাতেন। উৎসবের দিনগুলোতে। আমি দেখেছি, আচারের বয়াম সারি করে রোদে দেয়া থাকতো। এসব দেখে আমার মন প্রচণ্ড খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমার বুঝতে সময় লাগেনি। কারণ, আমি বুঝে গেছি একজন কর্মজীবী মায়ের কষ্ট। তার সীমাবদ্ধতা। যেখানে তার কেউই নেই যে সহায়তা করবে। সেই বোধই আমাকে তাড়িত করেছে মায়ের সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে। আমি শিখে নিয়েছি কাটাকুটি, মেরিনেট করা। এভাবেই আমি আচার, মিষ্টি, পিঠা, পাটিসাপটা, তালের বড়ার যাবতীয় উপকরণ জোগাড়যন্তর করে গুছিয়ে রাখতাম। আমাদের একমাত্র রন্ধনশিল্পী মা সেসব হাতের কাছে পেতেন। আর তা দিয়েই তৈরি হতে থাকল আমাদের বাড়ির আচার, মিষ্টি ইত্যাদি। সেই বোধই আমার হেঁশেলজীবনের ভিত। আজ আমি বিলক্ষণ অনুভব করি, কর্মজীবী বাবা-মায়েরাও সুস্থ এবং সুখী পরিবার গড়ে তুলতে পারেন।
কিন্তু এই বোধ কখনো কখনো আমাদের দিক্ভ্রান্ত করে। তাতেই ঘটে বিপত্তি। নষ্ট হয় জীবনের ভারসাম্য। ফলে এই বোধের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকাটাও জরুরি।
আমি হেঁশেলে ঢুকেছি ১৬ বছর আগে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করে। নিজেকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। কারণ, আমি চাকরি পেয়েছিলাম ক্যাম্পাস থেকেই। তা-ও আবার ভারতের সবচেয়ে পুরোনো আর ঐতিহ্যবাহী হোটেল তাজমহল, মুম্বাইয়ের রেস্তোরাঁয়। সেখানে আমি যাদের সঙ্গে কিচেন শেয়ার করেছি, তাদের গড় বয়স ৪২; আর আমি নেহাতই পুঁচকে। মাত্র ২১। এমন ২০ জনের সিনিয়র দলকে সামলানো ছিল দুঃস্বপ্নের মতোই। কারণ, তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন অভিজ্ঞ আর দক্ষ। ফলে প্রায়শই আমাকে বিড়ম্বিত হতে হয়েছে। অনেকে আমার অনভিজ্ঞতাকে তারুণ্যের ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখেছেন। তবে এর মধ্য দিয়েই আমার ছোট ছোট পরিবর্তন এসেছে। একদিন সবচেয়ে সিনিয়র শেফ আমাকে বলেছিলেন, শেফ রিল্যাক্স, নতুন টয়লেট কিন্তু বেশি চকচক করে। সেকথা আমি আজও ভুলিনি। কারণ, তিনি আমাকে আমার পরিবর্তনকে নতুন টয়লেটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। নতুন টয়লেট আসলেই তো চকচক করে। তবে সঠিক পরিচর্যার অভাবে তার রঙ মøান হতে শুরু করে। সেই মন্তব্যে আমি নিজের বোধকে প্রভাবিত হতে দিইনি। ভেতরে ভেতরে আমি ভীষণ ধাক্কা খেলেও নিজেকে মানসিকভাবে আরও দৃঢ় করেছি। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ওই রেস্তোরাঁকে উন্নীত করেছি এক নতুনতর উচ্চতায়। নানা উদ্ভাবন আর সংযোজনে অর্জন করেছি বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা। এভাবেই আস্তে আস্তে আমার হেঁশেলজীবনের গতি ক্রমেই ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। পরে আমি ওমানে একাধিক বড় হোটেলে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সেই সময়েরই একদিন হঠাৎ মনে পড়ে সেই সিনিয়র শেফের কথা; যিনি আমাকে বলতে গেলে প্রচন্ড ধাক্কা দিয়েছিলেন। আমার অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিলেন। তাকে ফোন করে কথা বলি। তার ওই উক্তি আমার উন্নতির অনুঘটক হয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতা নয়, ধন্যবাদ জানিয়েছি। অনেকক্ষণ কথা হয়। সেই ঘটনা নিয়ে আমরা হাসাহাসিও করি। ভাগ করে নিই কিছু মধুর স্মৃতিও। আসলে অহংকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা খুব জরুরি; এটা আমাদের জন্য কল্যাণকর।
একটি অপ্রিয় সত্য এই অবকাশে শেয়ার করে নিতে চাই আপনাদের সঙ্গে। আমরা প্রায়শই নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। এটাও একধরনের মানসিক অবস্থা। যার মধ্য দিয়ে আমরা কখনো না কখনো যাই। বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। অর্থাৎ আমরা নিজেকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ততটা নই। আসলে আমরা যখন কাজ করি, তখন কাজের জন্যই আমাদের

প্রয়োজন হয়। ভালো করলে অবশ্যই প্রশংসা মেলে। কিন্তু আমি সেখানে না থাকলে কিংবা অনুপস্থিত থাকলে সেই শূন্যস্থান অন্য কেউ পূরণ করে ফেলে। স্টিভ জবসকে ছাড়াই কিন্তু অ্যাপল এখনো দারুণ সফল।
কাজ করতে গিয়ে আমি আমার অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা সহকর্মীকে দেখেছি নানান দায়িত্ব সামলাতে। তারা দারুণ মুনশিয়ানাও দেখিয়েছেন। অথচ তাদের ছাড়া যে প্রতিষ্ঠান অচল, এমন অহংবোধ তাদের প্রকাশ করতে দেখেছি। বলতে দ্বিধা নেই, হেড শেফের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে আমারও এটা কখনো কখনো মনে হয়েছে যে এখানে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অপরিহার্য। তবে এই বোধে ভেসে না যাওয়াটাই শ্রেয়। বরং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমাদের উচিত অন্য একজনকে গড়ে তোলা, যে আমার জায়গাটা নিতে পারবে। তাহলেই কিন্তু সম্ভব অন্য আর একটা দায়িত্ব নিয়ে সেটাতে মনোনিবেশ করা।
ভালোর জন্য আমাদের পরবর্তী দায়িত্বে যারা আসবে, তাদেরকে তৈরি করা এবং নিজেদের পরবর্তী দায়িত্বে মন দেয়ার লক্ষ্যে সরে যাওয়া উচিত। অনেকে বলবেন, এই দ্বিতীয় কাজটি তোমাকে বিচলিত করে তুলবে; কিন্তু একটি সুশীল সমাজে, যেখানে কার্যস্থলের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে এমনটি ঘটার কথা নয়। অনেকেই বলে থাকেন, আপনার পরে যিনি আছেন তিনি কোনো না কোনোভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে পারেন। তা আমি অন্তত মনে করি না। কারণ, প্রতিষ্ঠান পেশাদার আর সঠিকভাবে গোছানো হলে সেখানে কর্মসংস্কৃতি ও মূল্যবোধ থাকে।
আর একটা বাস্তবতাকে আমি সব সময়ই গুরুত্ব দিই। সেটা হলো, কর্মক্ষেত্রে আরেকজন আপনার মতো স্মার্টার না হলেও সে কিন্তু যথেষ্ট স্মার্ট। মাথায় রাখতে হবে, সব মুশকিলের আসান


আপনি করতে পারবেন না। সব সময় সব সেরা প্রডাক্ট যেমন আপনার পক্ষে উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়, তেমনি মিটিংয়ে সব সময় সব সেরা আইডিয়াও আপনার মাথা থেকে আসবে না। ফলে অন্যদের ভূমিকা রাখার সুযোগ যত বেশি দেয়া যাবে, তত বেশি কাজ সুসম্পন্ন হবে। কাজের সময় সব নিয়ন্ত্রণ এ জন্যই নিজের হাতে রাখা উচিত নয়। আর আপনিই একমাত্র নিখুঁতভাবে সব কাজ করতে পারেন- এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সঠিক হবে না। কারণ, অন্যরাও ভালো করতে সক্ষম। আর মনে রাখা দরকার, নতুন দায়িত্ব কিন্তু আপনার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। ফলে আপনার আত্মমর্যাদাবোধকে কখনোই বল্গাহীন হতে দেয়া ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আমি অন্তত দুজন কিচেন পারসোনালিটিকে জানি, যারা নিজেদের অপরিহার্য ভেবে এসেছেন সব সময়েই। তারা ভুলে গেছেন প্রতিষ্ঠান তাদের চেয়ে বড়। ফলে, যা হবার তাই হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে।
জীবন সম্পর্কে সবশেষ আত্মোপলব্ধি এবং সেই বোধ নিয়ে প্রতিক্রিয়ার শুরু চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হতে গিয়ে। কারণ, তখন তো আমিই সর্বেসর্বা।
তবে, বস বা ক্লায়েন্ট কিন্তু কোনো জবাবদিহি করে না; বরং জবাবদিহির জন্য কেউ না কেউ থাকে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্লায়েন্টের প্রশ্ন নেয়া এবং এর সঠিক উত্তর দেয়া। কোনো সমস্যা হলে সমাধান দেয়া। এটা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। এ জন্য অবশ্য সমস্যাও হয়েছে। আমার অতি উৎসাহে আমার শেফ আমাকে সব দায়িত্ব দিতে চেয়েছে। আমি চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়েছি। তাদের প্রত্যাশা ক্রমেই বেড়েছে। কখনো কখনো অসফল হইনি, তা নয়। সে ক্ষেত্রে আমি অজুহাত খুঁজিনি; তবে কারণ খুঁজেছি। অনুধাবন করেছি আসলে অন্য কারও সাহায্য নিয়ে করাটাই উচিত ছিল। কারণ, আমার বসের কাছে সমাধানই মুখ্য। অথচ আমি ভেবেছি অন্যভাবে। সমাধান করা মানেই আমাদের জয়। আমার একার নয়।
শেষের এই শিক্ষা আমার জীবনবোধকে প্রভাবিত করেছে। কারণ, হেঁশেল-আবেগও জীবনের আরও একটি বড় শিক্ষা বৈকি। যে কাজ আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়, তা অন্যকে করতে বলা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং যে কাজ আপনি ভালো পারেন, সেটাও অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিজে আরেকটি কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন। দুটো গুরুদায়িত্ব আপনি সে ক্ষেত্রে সামলাতে পারেন। একটা নিজে করে আরেকটা অন্যকে দিয়ে করিয়ে, নিজে নজরদারি করে। প্রকৃতপক্ষে তিনিই তো যথার্থ দলনেতা, যিনি সীমাবদ্ধতা, কাজের পরিমাণ আর নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
অথচ পেশাগত জীবনে অনেককেই দেখেছি ব্যক্তিগত অহং নিয়ে থাকতে। তারা আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। নিজেকে অপরিহার্য ভেবেছেন সব সময়ই। আসলে জীবন সবকিছু ঠিক করে দেয়- তা সে সৃষ্টির মাধ্যমেই হোক বা ধ্বংসের।
ফলে আমি মনে করি, এটাই সঠিক সময় নিজেকে সেরা না ভেবে অন্যকে স্বাগত জানানো। কারণ, আপনাকে সার্থক ও সফল হতে হবে। যদি তা হতে পারেন, জগৎ আপনাকে ঠিকই স্বীকৃতি জানাবে।

লেখক: সাবেক শেফ তাজ মুম্বাই ও ওয়েস্টিন, ঢাকা
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top