ফিচার I ঢাকায় চট্টলার স্বাদ
চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবানি খাবার। এখন তা ঢাকায় খাদ্যসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। লিখেছেন সামীউর রহমান
বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির এই ঢাকা শহরের রসনাবিলাসের মূল সুরের নাম মোগলাই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়কার উত্তর ভারতীয় সিপাহি, ইরানি ব্যবসাদার, মোগল রাজবংশের মনোনীত সুবাদার এবং পরবর্তীকালে ঢাকার নবাবদের হেঁশেলের রান্নার ধাঁচ মিলেমিশে আদি ঢাকার মুসলিমদের যে খাদ্যরীতি তৈরি হয়েছিল তাতে বিরিয়ানি, বাকরখানি, ফালুদারই প্রাধান্য। এখনো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসবে যে খাবার পরিবেশিত হয়, তাতে সেই মোগলাই মৌতাত। বিয়ে মানেই কাচ্চি বিরিয়ানি কিংবা রোস্ট পোলাও রেজালা। ঈদে সেমাই ফিরনি জর্দা। বাঙালিয়ানা শুধু রোজকার ডাল-ভাতে আর পয়লা বৈশাখে। রেস্তোরাঁর খাওয়া বলতে আশি-নব্বইয়ের দশকে ছিল চায়নিজ। এরপর ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির প্রভাবে বার্গার পিৎজাও গুলশান-বনানীর কিছু বিদেশি রেস্তোরাঁর গন্ডি ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। কিন্তু বছর দুয়েক ধরে ঢাকার রেস্তোরাঁ সংস্কৃতিতে দেখা যাচ্ছে এক অদ্ভুত ছবি! স্রেফ সাদা ভাত ও গরুর মাংস খেতেই লোকজন দল বেঁধে যাচ্ছে রেস্তোরাঁয়। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচেও গজিয়ে উঠছে ‘মেজবানি’ খাবারের রেস্তোরাঁ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই রন্ধনশৈলীর স্বাদ নিতে রাজধানীবাসীও বারবার ছুটে যাচ্ছেন চিটাগং এক্সপ্রেস, দাওয়াত-এ-মেজবান, নওয়াব চাটগাঁর মতো মেজবানি খাবারের রেস্তোরাঁয়।
বছর পাঁচেক আগেও বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়ে ভোজনরসিকদের আকর্ষণ ছিল সামুদ্রিক মাছের প্রতি। লইট্টা ফ্রাই, রূপচাঁদা ফ্রাই, কোরাল ফ্রাই, শুঁটকি ভুনা কিংবা তাই-ওয়া হোটেলের ভিনেগার ফিশ। কিন্তু এখন চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলে ‘মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’ কিংবা জামান হোটেলের মেজবানি আয়োজনের স্বাদ না নিয়ে কেউ ফিরতে চান না। অথচ মেজবান বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মেজ্জান’ কখনোই রেস্তোরাঁর খাবার ছিল না। বরং রেস্তোরাঁর যে প্রধান বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ খাবারের বিনিময় মূল্য প্রদান করা, মেজবানে সেটাই সর্বাত্মকভাবে অনুপস্থিত। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রীতিতে মেজবান বা মেজ্জান আয়োজন করা হয় মৃত্যুবার্ষিকী, মিলাদ, কোনো প্রতিষ্ঠানের অভিষেক, পুনর্মিলনী, আত্মীয়স্বজনের বিদেশ থেকে আগমন উপলক্ষে পারিবারিক সম্মিলনসহ নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে। মেজবানে ধনী-গরিবনির্বিশেষে আত্মীয়স্বজন, আশপাশের চেনা সবাই নিমন্ত্রিত হতেন। আমন্ত্রণকারীকে বলা হয় মেজবান, ফারসি যে শব্দটির অর্থ হচ্ছে নিমন্ত্রণকর্তা। বিয়েশাদিতে পোলাও বিরিয়ানি পরিবেশনের চল থাকলেও মেজবানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে পরিবেশিত হবে সাদা ভাত। সঙ্গে গরুর মাংসের হরেক পদ। কালাভুনা, লালভুনা, গরুর নলা হাড় দিয়ে নলার ঝোল, কলিজা, মাথাসহ অন্যান্য অংশ মিশিয়ে রান্না করা বুটের ডাল- এসব খাবার পরিবেশন করা হয় মেজবানে। নিমন্ত্রিতরা খান ইচ্ছেমতো, কবজি ডুবিয়ে। তবে রাজধানীর মেজবান রেস্তোরাঁগুলো অবশ্য প্রকৃত মেজবানদের মতো উদার নয়, এখানে ফেলো কড়ি মাখো তেল! তবে মেজবানের আদলে ইচ্ছেমতো খাওয়ার সুযোগ করে দিতে মেজবানি বুফে আয়োজনের চল হয়েছে।
ঢাকায় মেজবানি খাবারের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চিটাগং এক্সপ্রেস রেস্টুরেন্টের সুবাদে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সীমানার ঠিক বাইরে, নর্দা ঢালিবাড়ি কোকাকোলা এলাকার ছোট্ট এই রেস্টুরেন্টের খাবার এতটাই লোভনীয় হয়ে ওঠে ঢাকার ভোজনরসিকদের কাছে যে, ভাঙা রাস্তা আর অচেনা পথ পাড়ি দিয়েও এখানে খেতে আসতেন দূরদূরান্ত থেকে! বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা আর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের কথা মাথায় রেখেই চট্টগ্রামের তিন বন্ধু মিলে খুলেছিলেন রেস্তোরাঁটি। এরপর রীতিমতো ক্রেজ! রমজান মাসে সেহ্রি খেতে শেষ রাতে যানজট এড়িয়ে অনেকেই এসে নিয়ে গেছেন মেজবানি স্বাদ। বাদ যাননি জাতীয় দলে খেলা চট্টগ্রামের
ক্রিকেটার তামিম ইকবালও। চিটাগং এক্সপ্রেসে খাবার পরিবেশন করা হয় সেট মেন্যু হিসেবে। ভাত, গোস্ত, ডাল গোস্ত ও পায়া কারি। লাকড়ির চুলায় হয় রান্না আর পরিবেশন করা হয় মাটির খোরায়। এ ছাড়া চিটাগং এক্সপ্রেসে পাওয়া যাবে আখনি বিরিয়ানি। সেট মেন্যুর বাইরেও আলাদা করে নেয়া যাবে মেজবানি মাংস ও মেজবানি রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম কালাভুনা। ঝোলবিহীন, মাখা মাখা কিন্তু মসলাদার স্বাদের এই গরুর মাংসের আইটেমই মেজবানি স্বাদের রেস্টুরেন্টে আসা ভোজনরসিকদের প্রথম পছন্দ।
সংগীতশিল্পী এলিটা ও তার স্বামী আশফাক নিপুণ, সঙ্গে এলিটার পরিবারের আরও দুজন মিলে গড়ে তুলেছেন মেজবানি স্বাদের রেস্তোরাঁ নবাব চাটগাঁ। গুলশান ১ নম্বর সার্কেলে, নাভানা টাওয়ারের পেছনে এই রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় মেজবানি মাংস, কালাভুনা, ঝুরা গোস্ত, আখনি বিরিয়ানি। ইন্টেরিয়রে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ব্রিজ, চেরাগ আলী পাহাড়ের ছোঁয়া। স্বাদ বদলাতে পাবেন টাটকা সামুদ্রিক মাছ যেমন রূপচাঁদা, লইট্টা ও কোরাল মাছের মুচমুচে ভাজায়। মিষ্টিমুখের জন্য জর্দা, ফিরনি। ইফতার ও সেহ্রির বিশেষ আয়োজনও থাকে নবাব চাটগাঁতে। এখানে হেঁশেলের দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রামের বশির বাবুর্চি। গুলশানেই রয়েছে মেজবানি স্বাদের আরেকটি রেস্টুরেন্ট ‘চিটাগং বুল’। নামেই বোঝা যাচ্ছে ষাঁড় গরুর মাংসের সঙ্গে চট্টগ্রামের মেজবানি মাংসের স্বাদের সম্পর্কের রসায়নটাই বিজ্ঞাপিত করতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। দিনের শুরু যদি করতে চান মেজবানি স্বাদে, তাহলে ‘চিটাগং বুল’ হতে পারে ছুটির দিন সকালে আপনার গন্তব্য। নাশতার আয়োজনেই আছে মেজবানি মাংস, নেহারি বা নলার ঝোল, চানা ডালের মতো মেজবানি পদ। সকালবেলায় ভাতের আয়োজন থাকে না, তাই মেজবানি মাংস চেখে দেখতে পারেন বাটার নান বা রুমালি রুটির সঙ্গেও। গলা ভেজাতে নোনতা লাচ্ছি, চিটাগং বুলের স্পেশাল লাচ্ছি আর সবশেষে এক কাপ মাসালা চা দিয়েই হতে পারে ‘পারফেক্ট ফ্রাইডে’র শুরুটা।
মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে মোস্তাকিমের চাপ লুচি চেখে দেখতে ছুটে গেছেন অনেকেই। তবে স্বাদটা আর আগের মতো নেই বলেই অভিযোগ। এবারে ফুড ডেস্টিনেশনে মোহাম্মদপুরকে রাখুন ‘ভাতের দুয়ান’-এর জন্য! ভাতের দুয়ান অর্থাৎ সোজাসাপ্টা ভাতের দোকান। এখানে ভাতই পাওয়া যায়। উদ্ভাবনী অন্দরসাজ আর সাদাসিধেভাবে মাটির বাসনে পরিবেশন করা অসাধারণ স্বাদের খাবার। দামও সাধ্যের মধ্যে। এখানে মেজবান প্যাকেজ ছাড়াও আছে বরিশাল, নোয়াখালী ও কুমিল্লা সেট মেন্যু। টাটকা বাজার আর নির্দিষ্ট পরিমাণে রান্না করেই মান ধরে রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মেজবানি মেন্যুও একই রকম- ভাত, মেজবানি মাংস, চানার ডাল ও নলার ছোল। সঙ্গে দেয়া হয় চাটনি ও সালাদ।
এসব মেজবানি ভোজনালয় ছাড়াও ঢাকার বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় মেজবানের প্রধান আকর্ষণ কালাভুনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে চানখাঁরপুল অঞ্চলের সোহাগ, মিতালি অত্যন্ত পরিচিত দুটি নাম। এখানে রাতভর গান আর আড্ডার সঙ্গে চলে উদরপূর্তি। এই দুই রেস্টুরেন্টে এসে মাঝরাতে কালাভুনা, বুটের ডাল আর পরাটার ভোজ এখনো হয়তো অনেককে করে তুলবে নস্টালজিক। এ ছাড়া খিলগাঁওয়ের ক্যাফে খিলগাঁও, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটের কাছে জামান হোটেল, পুরান ঢাকার বোখারি রেস্তোরাঁ, বরিশাল মুসলিম হোটেলেও মিলবে সুস্বাদু কালাভুনা।
একসময় শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারা শুক্রবার সকালে বাজারে গিয়ে চেনা মাংসের দোকান থেকে কিনে আনতেন গরুর পছন্দসই অংশের মাংস। দুপুরবেলা বাসায় মসলা আর মাংসের বাষ্পের মনমাতানো গন্ধ! জুমার নামাজের পর পরিবারের সবাই মিলে মাংস-ভাতের ভোজ। যান্ত্রিক নগরে সেই সংস্কৃতি গেছে হারিয়ে। তাই হয়তো রেস্টুরেন্টে গিয়ে সাদা ভাত আর মাংসের ভোজে সেই স্মৃতিকেই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।
ছবি: সংগ্রহ