স্বাদশেকড় I ক্রি…ক্রিং…আইসক্রিম
ক্রি…ক্রিং…ক্রিং…ঘণ্টি বাজিয়ে আইসক্রিমওয়ালার হাজির হওয়া অনেকেরই শৈশব-কৈশোরকে বর্ণিল ও আনন্দমুখর করে তোলে। সেই স্মৃতি ভোলার নয়! কিন্তু কোত্থেকে এলো এই সুস্বাদু ডেজার্ট?
কথায় আছে, আপনি সুখ কিনতে পারবেন না, তবে আইসক্রিম কিনতে পারেন! কথাটির একধরনের মাহাত্ম্য আছে। কেননা অনেকের কাছেই আইসক্রিম যেন সুখেরই নামান্তর। কোনো খাবারের জনপ্রিয়তা যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে, তখন সেটি ঘিরে থাকা লোককাহিনি থেকে সত্যকে আলাদা করা মুশকিল। আইসক্রিম কে কোথায় আবিষ্কার করেছেন, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবু সেই অনুসন্ধানে চলুন, হাত পাতা যাক ইতিহাসের কাছে।
আমেরিকা ও ইউরোপের সঙ্গে আইসক্রিমের রয়েছে এক গুরুতর ও দীর্ঘকালীন সম্পর্ক। জন্মদিন, ট্রফি জয় এবং অন্যান্য বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপনে ওই দুই মহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে আইসক্রিম খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। তাই এ খাবার যার হাতে আবিষ্কার, বিশেষ ধন্যবাদ তার আপনাআপনিই পাওনা। কেননা আইসক্রিমের দুটি স্কুপ আমাদের যেকোনো বিরস বদনের দিনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই আইসক্রিম তাই হয়ে ওঠে অনেকেরই ভীষণ প্রিয় ডেজার্ট।
প্রায় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন চীনে বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মিষ্টান্নের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে আইসক্রিমের স্বাদকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে দিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবদান রেখেছেন অসংখ্য অজ্ঞাত উদ্ভাবক, সে কথা অনুমান করা কঠিন নয়। জনপ্রিয় এই ডেজার্টের উদ্ভাবন মোটেই চোখের পলকে ঘটেনি; বরং এর আজকের অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে শত শত বছরের ইতিহাস। প্রাচীন চীন ও মিসরের লোকেরা স্বাদযুক্ত বরফ খেতেন; ইতালীয় ও পরবর্তীকালে ফ্রেঞ্চ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরাও আইসক্রিমকে আধুনিক করতে সাহায্য করেছিলেন। তাই প্রাচীন বিশ্বের আদি উৎপত্তি থেকে বর্তমানের সুস্বাদু ট্রিট পর্যন্ত আইসক্রিমের ইতিহাসটি বেশ দীর্ঘ ও জটিল।
আধুনিক যুগের অনেকেই হিমায়িত খাবার উপভোগ করেন। তাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরাও তা করতেন। চীনের লোকেরা ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে চূর্ণ বরফে ফলের রস যোগ করেছিলেন। অন্যদিকে প্রাচীন মিসরীয়রা একইভাবে পানি জমা করে বরফ তৈরির উদ্ভাবনী কৌশল নিয়ে এসেছিলেন।
প্রাচীনকালের ইতিহাসের নানান পরতে রয়েছে হিমায়িত কিংবা বরফের খাবার উপভোগ করার নানান উপাখ্যান। জানা যায়, প্রাচীন ইসরায়েলি রাজা সলোমন (খ্রিস্টপূর্ব ৯৯০—৯৩১) এবং মেসিডোনিয়ান রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬—৩২৩) মতো ব্যক্তিরা বরফের পানীয় উপভোগ করতেন। অন্যদিকে, নিরো (৩৭—৬৮ খ্রিস্টাব্দ), ক্লডিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব ১০—খ্রিস্টাব্দ ৫৪) এবং জুলিয়াস সিজারের (খ্রিস্টপূর্ব ১০০—৪৪) মতো রোমান শাসকেরা ফল ও জুস মিশ্রিত বরফ খেতে পছন্দ করতেন।
‘প্রাচীন বিশ্বে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে হ্রদগুলো তখনো বরফে পরিণত হয়নি; তাই তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে বরফ ও তুষার পেয়েছেন,’ জানিয়েছেন খাদ্য-ইতিহাসবিদ সারা ওয়াসবার্গ জনসন। তিনি যোগ করেন, ‘বরফ সংগ্রহের জন্য যে সময় ও প্রচেষ্টা ব্যয় করতে হতো, তা ছিল ব্যয়বহুল; ফলে শুধু ধনীদের সামর্থ্য ছিল তা সংগ্রহ করার।’
তাহলে, কীভাবে আধুনিক আইসক্রিমের উদ্ভব? আরও কয়েক শ বছর পর ডেইরি শিল্পের বিকাশের ফলে ডেজার্ট বানানোর জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বরফের চাহিদা বাড়ে। আর সেই ডেজার্টই কালে কালে আধুনিক আইসক্রিমে রূপ নেয়। ওয়াসবার্গ জনসন জানান, যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুই শতক আগে চীনের জনসাধারণের মাঝে বরফে জমাট বাঁধা দুধ ও ভাত খাওয়ার প্রচলন ছিল। আর সেটিই আইসক্রিমের সবচেয়ে প্রাথমিক সংস্করণ বলে অভিমত অধিকাংশ খাদ্য ইতিহাসবিদের।
এর কয়েক শতক পরে, তাং রাজবংশের চীনা সম্রাটেরা ৬১৮ থেকে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একই ধরনের আইসক্রিমের স্বাদ উপভোগ করতে থাকেন। তারা দুধ ও ক্যামফর বা কর্পূর নামক একটি সুগন্ধযুক্ত পদার্থ মিশ্রিত করে এটি হিমায়িত করতেন। তাই আইসক্রিমের উদ্ভব যে চীনেই, সে কথা মেনে নেওয়া যায়। তবে এটিকে মিষ্টান্নে বিকশিত করতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও কয়েক শতাব্দী।
এদিকে একাদশ শতাব্দীতে প্রাচীন পারস্যের অধিবাসীরা ‘শরবত’ নামক একটি মিষ্টি স্বাদযুক্ত পানীয় নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করেন। সেই পানীয় ছিল আইসক্রিমের মতোই। জাম, ডালিম কিংবা নাশপাতি সহযোগে এই বরফের পানীয়ের স্বাদ গ্রহণ করতেন তারা। তাই বলা যেতে পারে, শরবত হচ্ছে আইসক্রিমের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আদি রূপ। সেখান থেকে, সম্ভবত ক্রুসেড (১০৯১—১২৯১), এমনকি ইতালিয়ান অভিযাত্রিক মার্কো পোলোর (১২৫৪—১৩২৪) অভিযানের কারণে হিমায়িত ডেজার্টের ধারণাটি পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। অন্যদিকে, সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রথম কোনো শরবেটো বা শরবতের রেসিপি লিখেছিলেন ইতালিয়ান শেফ আন্তোনিও লাতিনি (১৬৪২—১৬৯২)। সেখান থেকে আইসক্রিমের ধারণাটি দ্রুত ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৫৩৩ সালে ফরাসি রাজা অঁরি সেকেন্ড অব ফ্রান্সকে (১৫১৯—১৫৫৯) বিয়ে করে ইতালীয় রাজপরিবারের সদস্য ক্যাথরিন দি মেদিসি (১৫১৯—১৫৮৯) যখন ফ্রান্সে পাড়ি জমান, তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তৎকালীন আইসক্রিম। অন্যদিকে, ১৬৮৬ সালে সিসিলিয়ান সেফ ফ্রান্সেস্কো প্রকোপিও (১৬৫১—১৭২৭) প্যারিসে একটি ক্যাফে খোলেন, যেখানে তিনি হিমায়িত দুধ, ক্রিম, মাখন ও ডিমের মিশ্রণ অথবা জেলটো পরিবেশন করতেন।
দিনে দিনে আইসক্রিমের বিস্তার আটলান্টিক মহাসাগরীয় বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২—১৭৯৯) ১৭৯০ সালে আইসক্রিমের জন্য তৎকালীন ২০০ ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন বলে জানা যায়। একই দেশের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন (১৭৪৩—১৮২৬) ব্যবস্থা রেখেছিলেন বিশেষ ‘বরফ ঘরে’র, যেখানে তিনি তার প্রিয় এই ডেজার্ট সংরক্ষণ করতেন। তবে না বললেই নয়, আইসক্রিমের ব্যাপক বিস্তারে বিশেষ সহযোগিতা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের। জেফারসনের ক্রীতদাস-বাবুর্চি জেমস হেমিংস (১৭৬৫—১৮০১) নিখুঁত ভ্যানিলা আইসক্রিম তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন। অন্যদিকে, মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি এবং হোয়াইট হাউসের বাবুর্চি অগাস্টাস জ্যাকসনই (১৮০৮—১৮৫২) আইসক্রিমের তাপমাত্রা কমাতে তাতে প্রথম লবণ যোগ করেছিলেন বলে দাবি ইতিহাসবিদদের। তাই তাকে ‘আইসক্রিমের জনক’ বলা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ডেইরি ফুডস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, আইসক্রিম সর্বত্র সহজলভ্য হয়ে উঠতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সে সময় আবিষ্কার ঘটে ‘কোন আইসক্রিম’ ও ‘আইসক্রিম সানডেসে’র। আর তাতে এই ডেজার্টের বিকাশ পায় ব্যাপক গতি। কিন্তু কীভাবে ও কোথায় জন্ম ঘটেছিল এই দুই আইকনিক আইসক্রিমের? সানডে আইসক্রিমের সম্ভাব্য জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ইভানস্টন, নিউইয়র্কের ইথাকা কিংবা উইসকনসিনের টু রিভারস শহরের যেকোনো একটিতে। জানা যায়, ধর্মীয় শহর হিসেবে খ্যাত ইভানস্টনে ১৮৯০ সালে রোববারে সোডা বিক্রি নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস হয়েছিল। এর ফলে একটি স্থানীয় সোডা ফাউন্টেনকে যথেষ্ট সৃজনশীল হতে হয়েছিল। আইসক্রিম সোডা পরিবেশনের পরিবর্তে তারা সোডা সিরাপ দিয়ে আইসক্রিম পরিবেশন শুরু করে। আর এই ট্রিটকে ডাকা হতো সানডে আইসক্রিম বলে।
এর বছর দুয়েক পর ইথাকার এক ওষুধের দোকানের মালিক তার বন্ধুর জন্য এক থালা আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলেন, এর মধ্যে ছিল চেরি সিরাপ এবং একটি মিছরিযুক্ত চেরি। যেহেতু তিনি রোববারে এই আইডিয়ার প্রকাশ করেছিলেন, তাই দুই ব্যক্তি সুস্বাদু খাবারটিকে নাম দিয়েছিলেন ‘চেরি সানডে’। তবে টু রিভারসের অধিবাসীদের দাবি ছিল, সানডে আইসক্রিমের ধারণা তারা প্রায় এক দশক আগেই ভেবেছিলেন। তাদের জোর দাবি, একটি সোডা ফাউন্টেন ও আইসক্রিম পার্লারের মালিক ১৮৮২ সালের শুরুর দিকে একজন গ্রাহকের অনুরোধে সাধারণত সোডার জন্য ব্যবহৃত চকোলেট সিরাপ আইসক্রিমে ব্যবহার করেন।
কোন আইসক্রিম উদ্ভাবনের বিষয়টিও একই রকম তর্কসাপেক্ষ। ব্রুকলিনভিত্তিক আইসক্রিম শপ অ্যাম্পল হিলসের প্রতিবেদনে জানা যায়, আর্নেস্ট হামউই নামের এক সিরিয়ান অভিবাসী এ আইসক্রিম উদ্ভাবনের স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯০৪ সালের বিশ্ব মেলায় তিনি জালাবিয়া নামে একটি ওয়েফার ডেজার্ট তৈরি করছিলেন এবং একজন আইসক্রিম বিক্রয়কর্মীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলগতভাবে সেটি নিয়ে কাজ করতে।
যাহোক, ইতালীয় অভিবাসী ও আইসক্রিম প্রস্তুতকারক ইতালো মার্চিয়ানি (১৮৬৮—১৯৫৪) ‘আইসক্রিম কাপ এবং এর মতো পণ্য তৈরির ছাঁচ নির্মাণ যন্ত্রে’র জন্য একটি পেটেন্ট দাখিল করে তা ১৯০৩ সালে লাভ করেন। তবে তার পেটেন্ট কোন আকৃতির ছিল না এবং এমনকি হাতলটি ছোট ছিল, ফলে বেশির ভাগ মানুষ হামউইকেই কোন আইসক্রিমের প্রকৃত উদ্ভাবক মনে করেন।
এককথায়, আইসক্রিমের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। এই সুস্বাদু হিমায়িত ট্রিট হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
i ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট