skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ভেজিটেরিয়ান ডায়েট

এ নিয়ে বাহাদুরি আছে অনেকের। কেউ কেউ আবার অনুসরণ করতে বাধ্য। তবে কারণ যা-ই হোক, স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া চাই। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

বিভিন্ন দেশে বা স্থানে ধর্মীয় কারণ, এমনকি শারীরিক অবস্থার জন্যও অনেকে মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, যাদের ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষাশী বলা হয়। এই ভেজিটেরিয়ানদের আবার নানা রকম খাবার গ্রহণ কিংবা বাদ দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে ডায়েটে রয়েছে রকমভেদ। যেমন ভেগান ডায়েট, ওভো-ল্যাকটো ভেজিটেরিয়ান ডায়েট, ওভো-ভেজিটেরিয়ান ডায়েট এবং ল্যাকটো-ভেজিটেরিয়ান ডায়েট।
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেলস ও পানি—বৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্য উপাদানের এই ছয়টি বিশেষ ভাগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রোটিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যাকে বলে ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট। এটি মাসেল বিল্ডিং থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পর্যন্ত নানা কাজ করে। বাড়ন্ত শিশুদের, বিশেষত নয়-দশ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রোটিন রিকয়ারমেন্ট অনেক। বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকে আমরা প্রোটিন পেয়ে থাকি। যেমন দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের মাছ, মুরগির মাংস, গরু বা খাসির মাংস, ডাল, বাদাম প্রভৃতি। ভেজিটেরিয়ানরা তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এ ধরনের প্রোটিনের মধ্যে প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
যারা অ্যানিমেল প্রডাক্ট বা প্রাণিজ প্রোটিন খাদ্যতালিকা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেন, তাদের বলা হয় ভেগান। ভেগান ডায়েট অনুসরণকারীদের ফুড লিস্টে সাধারণত থাকে শুধুই উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। তারা কোনো ধরনের প্রাণিজ প্রোটিন তো বটেই, এমনকি প্রাণী উৎস থেকে উৎপন্ন কোনো খাদ্য উপাদানও গ্রহণ করেন না। তার মানে, কোনো রকম মাছ বা মাংস, ডিম বা দুধ ইত্যাদি নেই ভেগান ডায়েটে। বলে রাখা ভালো, প্রাণিজ প্রোটিনের প্রায় সব কটি পুষ্টি উপাদানই মোটামুটি উদ্ভিজ্জ বা প্ল্যান্ট প্রোটিন থেকে পাওয়া সম্ভব। তবে নানা রকম ভিটামিনের মধ্যে ভিটামিন বি টুয়েলভ বা কোবালামিন পাওয়া যায় শুধু গরুর কলিজা, ডেইরি প্রডাক্ট ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিন উৎসে। যেহেতু ভেগান ডায়েট অনুসারীরা প্রাণিজ প্রোটিন একদমই গ্রহণ করেন না, তাই তাদের ক্ষেত্রে কোবালামিনের জন্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেন অনেক পুষ্টি বিশেষজ্ঞ বা হেলথ এক্সপার্ট।
ওভো-ভেজিটেরিয়ানরাও ভেগানদের মতো সব ধরনের প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তবে পার্থক্য হলো, ওভো-ভেজিটেরিয়ান ডায়েটে ডিম ও ডিমের তৈরি খাদ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। সে ক্ষেত্রে তারা কোলিন, বায়োটিন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ন্যাচারাল সোর্স থেকেই পেয়ে যান। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না।
অন্যদিকে, ওভো-ল্যাকটো ভেজিটেরিয়ান ডায়েটেও রয়েছে প্রোটিন গ্রহণে ভিন্নতা। বিভিন্ন ধরনের বাদাম, ডাল, বিচিসমৃদ্ধ খাদ্য, ডিম ইত্যাদির পাশাপাশি তারা দুধ ও দুধের তৈরি বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণ করেন। অনেক লিমিটেশনের মধ্যেও ওভো-ল্যাকটো ভেজিটেরিয়ান হওয়ার কিছু দারুণ দিক রয়েছে। যেহেতু কোনো রকম গরু-খাসি এমনকি মুরগির মাংসও এ ধরনের ভেজিটেরিয়ানরা খান না, সে ক্ষেত্রে স্যাচুরেটেড ফ্যাটও কম গ্রহণ করেন। তাই হার্টের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি, এমনকি পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমে যায় তাদের।
আরেক ধরনের ভেজিটেরিয়ান রয়েছেন, যারা তাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেন সব ধরনের মাছ, মাংস ও ডিম। তারা শুধু প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডাল, বাদাম ও বিচিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিদিন দুধ কিংবা দুধে তৈরি যেকোনো খাদ্য গ্রহণ করেন। এদের বলা হয় ল্যাকটো-ভেজিটেরিয়ান। এই ভেজিটেরিয়ানরা দুধ, চিজ, দই, বাটার ও ঘি বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
প্রোটিনের হেলথ বেনিফিট অনেক। দৈহিক গঠন ও মাসেল বিল্ডিংয়ে প্রোটিনের যথাযথ গ্রহণ সম্ভব না হলে মাংসপেশির ভাঙন, ওজন কমতে থাকা, চুল ঝরাসহ দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। যারা সিক্স প্যাকের জন্য জিমে যাওয়ার পরিকল্পনায় থাকেন, তাদের বেলায় খাদ্যতালিকায় রাখা চাই প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষাশীদের প্রায়শই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় সঠিক প্রোটিনের সন্ধান করতে গিয়ে। সঠিক উৎস বাছাই করতে পারলে তাদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের ঘাটতি সাধারণত হয় না। সে ক্ষেত্রে রাখতে পারেন এই খাদ্য উৎসগুলো: মাশরুম, টফু, কিনুয়া, পিনাট বাটার এবং মিক্সড নাট উইথ সিডস।
মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান উপাদান। খাদ্য গ্রহণ অবশ্যই আনন্দের সঙ্গে করা ভালো। তাই ভেজিটেরিয়ানদের খাদ্যতালিকায়ও থাকা চাই ভিন্নতা। সে ক্ষেত্রে রাখতে পারেন এই রেসিপিগুলো:
হামাস
হামাস হলো মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত ডিশ। যেসব ভেজিটেরিয়ান, বিশেষত যারা ভেগান ডায়েট অনুসরণ করেন, তাদের জন্য এটি চমৎকার একটি উদ্ভিজ্জ প্রোটিন উৎস। হামাস একরকম ডাল বা ছোলা দিয়ে তৈরি। আমাদের দেশে এ ডাল মটরকালাই বা চানা বুট নামে পরিচিত। হামাস তৈরির প্রিপারেশনে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। তাই ভেজিটেরিয়ানরা ঝটপট খাবারের রেসিপি হিসেবে এটি যোগ করতে পারেন খাদ্যতালিকায়।
উপকরণ: চিক পি বা চানা বুট, রসুন কোয়া, লবণ, লেমন জুস, তিল, অলিভ অয়েল ও পানি।
প্রণালি: হামাসের প্রধান উপকরণ হলো তাহিনী। ব্লেন্ডারে তিল ও সামান্য অলিভ অয়েল দিয়ে ব্লেন্ড করে তাহিনী তৈরি করে নিন। এরপর সেদ্ধ করা চিক পি দিন ব্লেন্ডারে। তারপর একে একে বাকি উপকরণগুলো যোগ করুন। তাহিনী, লবণ, লেবুর রস, রসুনের কোয়া এবং পরিমাণমতো পানি দিয়ে ব্লেন্ড করুন। ভালোভাবে মিক্সড হয়ে গেলে অল্প অলিভ অয়েল দিয়ে নিন এবং পুনরায় ব্লেন্ড করুন। নিজ পছন্দমতো ঘনত্ব রেখে একটি সুন্দর পাত্রে ঢেলে নিলেই এটি খাওয়ার জন্য তৈরি।
রুটি বা নান দিয়ে হামাস খেতে দারুণ টেস্টি ও পুষ্টিকর। যাদের রক্তে উচ্চমাত্রায় ব্যাড কোলেস্টেরল, অর্থাৎ এলডিএলের মাত্রা বেশি, হামাস সেটির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। জানেন তো, রক্তে এলডিএল বেশি থাকলে হার্টের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অ্যাথেরোস্কলেরোসিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
স্প্রাউট স্যালাড
মুগডাল বা ছোলা দিয়ে তৈরি স্প্রাউট স্যালাড তৈরি করতে প্রথমেই দেড় থেকে দুই রাত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ডালগুলো। ছোট ছোট অঙ্কুরিত হতে দেখা গেলেই এটি রেডি, যাকে বলে অঙ্কুরিত ছোলা বা ডাল। একে স্প্রাউটও বলা হয়।
উপকরণ: অঙ্কুরিত ডাল, টমেটো, লেবুর রস, পুদিনাপাতা, গোলমরিচ, অলিভ অয়েল ও লেটুস পাতা।
প্রণালি: প্রথমে একটি পাত্রে অঙ্কুরিত ছোলা নিন। এরপর টমেটো কুচি, পুদিনাপাতার কুচি, গোলমরিচ, অলিভ অয়েল দিয়ে মাখিয়ে নিন। তারপর অল্প লেবুর রস দিয়ে লেটুসপাতার সঙ্গে মিক্স করে নিলেই খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রেডি।
ভেজিটেরিয়ানরা প্রতিদিন দুই থেকে তিন সার্ভিং স্প্রাউট স্যালাড খাদ্যতালিকায় যোগ করতে পারেন। এতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। এ ছাড়া ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ফোলেটসহ ভিটামিন কে-এর দারুণ উৎস এটি। তাই যারা প্রাণিজ উৎসের প্রোটিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতি দূর হবে স্প্রাউট স্যালাডে। বিশেষ করে গর্ভবতী নিরামিষভোজীদের ক্ষেত্রে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি দূর করতে দারুণ এক খাদ্য উৎস এটি।
সবশেষে বলি
খাদ্য গ্রহণ কিংবা বিরত থাকার ওপর ভিত্তি করে ভেজিটেরিয়ানদের মধ্যে রয়েছে নানান ভাগ। প্রতিটি খাদ্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে পুষ্টি উপাদানের ভিন্নতা। তাই যিনি যে ডায়েটই ফলো করুন না কেন, প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি যেন না হয়, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা কিংবা নিজের ইচ্ছা—যে কারণেই ভেজিটেরিয়ান ডায়েট অনুসরণ করুন না কেন, খাদ্য উপাদানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টির এক্সচেঞ্জ হচ্ছে কি না, তা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top