এডিটর’স কলাম I প্রত্যাশার পারদ
নির্ধারণ করুন নিজ বিবেচনায়, কোন প্রত্যাশাগুলো যৌক্তিক, আর কোনগুলো বাড়াবাড়ি। এ নিয়ে খোলামনে কথা বলুন জীবনসঙ্গীর সঙ্গে
বিয়ে। একটি স্বীকৃত সম্পর্কের নাম। এর তাৎপর্য তার চেয়েও অনেক বেশি। দুজন মানুষের জীবন একটি নতুন বন্ধনে যুক্ত হয়ে একসঙ্গে পাড়ি দেওয়ার নামান্তর। সেই পথচলায় পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, আস্থার পাশাপাশি থাকে নানান প্রত্যাশাও। কিন্তু প্রত্যাশার পারদ যদি বেপরোয়া হয়, তাতেই বিপত্তি। ‘আপনি যদি কারও কাছে কোনো কিছু প্রত্যাশা না করেন, তাহলে কখনোই নিরাশ হবেন না,’ বলে গেছেন আমেরিকান কবি ও কথাসাহিত্যিক সিলভিয়া প্লাথ। তাই বলে দাম্পত্য জীবনের ‘অর্ধাঙ্গ’ বা ‘অর্ধাঙ্গিনী’র কাছে কোনো প্রত্যাশা থাকবে না, তা কেমন কথা? শুধু মাত্রাটা সামলে রাখা চাই!
দুই
প্রত্যাশা সব সময় ইতিবাচক নয়, জানা কথা। আরও জানা কথা, প্রত্যাশার জগদ্দল পাথর অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতার কারণেও চেপে বসতে পারে সম্পর্কের ওপর। তবু সেই জানা কথাগুলোই আমরা অনেক সময় বেমালুম ভুলে যাই; কিংবা মানতে চাই না। করোনা অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট…সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এক বিরূপ চিত্রের এখন সর্বত্রই বিচরণ। ধরা যাক, আপনার কোনো আত্মীয় বা সহকর্মী কিংবা বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত কারও স্বামী বা স্ত্রী এই বিরূপ সময়েও বেশ ফুরফুরে আছেন দাম্পত্য জীবনে। বেদম ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুজন মিলে দেশ-বিদেশে। কিনছেন নতুন গাড়ি। নতুন ফ্ল্যাটও হয়তোবা। তাদের ঘরে নিত্যনতুন আসবাবের সমাহার। সেই সব ‘সুখী দম্পতি’ মার্কা ছবি ও গল্প তারা শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কিংবা ফোন করে শোনাচ্ছেন আপনাকে। আপনারও তেমনটাই ঘোরার, কেনাকাটার, ‘দেখিয়ে বেড়ানো’র ইচ্ছে জাগছে খুব। কিন্তু আপনার জীবনসঙ্গীর সেই ফুরসত নেই, সেই সামর্থ্যও নেই। কী করবেন? মন ভার করে রাখবেন? চাপ দিতে থাকবেন তাকে?
কিংবা বৈষয়িক প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে মনস্তাত্ত্বিক প্রসঙ্গেও যদি আসি, পরিচিত অনেক দম্পতির তুলনায় আপনার স্বামী বা স্ত্রী কেমন ‘সেকেলেই’ হয়তোবা। দেখতে সুশ্রী নন অতটা। সাজগোজেও অনাগ্রহী। ‘স্মার্টলি’ কথা বলতেও অপারগ। সব মিলিয়ে অন্যদের কাছে তেমন ‘উপস্থাপনযোগ্য’ নন। অথচ চাইলেই এসবের সমাধান রয়েছে আপনার কাছে। তাকে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে, সাজগোজের ব্যাপারে, চালচলনের ব্যাপারে কেতাদুরস্ত করে তুলতে পারবেন। কিন্তু সেসবে আগ্রহ নেই তার! কী করবেন? খেপে যাবেন? নাকি মন খারাপের মেঘ ভারী করে অপেক্ষায় থাকবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে? সেই প্রত্যাশা যদি পূরণ না হয়, তাহলে আজীবন টানতে থাকবেন গ্লানিবোধ? নাকি সম্পর্কেই টানবেন ইতি? না, দুটোর কোনোটিই ভালো উপায় নয়, বিশ্বাস করুন!
তিন
মনোবিশ্লেষকদের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সার্বিকভাবে একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে মোটামুটি বেশ কয়েকটি বিষয় প্রত্যাশা করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্ত্রী চান তার স্বামী যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ান, তাকে সুরক্ষা ও মর্যাদা দেন। নিজের একান্ত সব কথা স্বামীকে শোনাতে চান তিনি। আরও চান, স্বামী যেন সেসব কথা হেসে কিংবা কোনো অজুহাতে উড়িয়ে না দেন। আরও চান, সম্পর্কে যেন সৎ ও স্বচ্ছ থাকেন তার স্বামী। তার দেহ-মনের সুস্থতা খেয়াল রাখেন। তার যথেষ্ট কাছাকাছি থাকেন। মনোযোগে রাখেন তাকে। অন্যদিকে স্ত্রীর প্রতি একজন স্বামীর সার্বিক প্রত্যাশাগুলোর মধ্যে জায়গা করে নেয় বিশ্বস্ততা, সততা, বোঝাপড়া, যত্নশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষাবোধ, মানসিক পরিপক্বতা প্রভৃতি। না, এগুলোর কোনোটিই দোষের নয়; বরং একান্তই প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে, এই উভয় ধরনের প্রত্যাশাগুলোই আসলে স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে আলাদা করার বদলে পারস্পরিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
চার
অস্কারজয়ী ব্রিটিশ অভিনেত্রী হেলেন মিরেন যথার্থই বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠতম দাম্পত্য জীবন হলো অংশীদারত্বের। যদি (স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে) একটি অংশীদারত্ব গড়ে না ওঠে, তাহলে সেই বিয়ের পক্ষে ভালো দাম্পত্য গড়ে তোলা অসম্ভব।’ সহজ কথায়, টেকসই অংশীদারত্ব বা বন্ধন গড়ে তোলার জন্য স্বামী ও স্ত্রী—দুজনেরই রাখা চাই যথাযোগ্য অবদান। হোক বিয়েটি নিজেদের কিংবা পরিবারের পছন্দে, দাম্পত্য জীবন শুরুর একদম প্রথম প্রহর থেকেই এটি দুজন মানুষের একাত্মতার জার্নি। তাই দুজনেরই সমান খেয়াল রাখা চাই কিছু বিশেষ বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে মোটা দাগে কিছু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ মেনে চলা দরকার। যেমন ধরুন, কোনো বিষয়ে দুজনের কখনো কখনো মতের মিল না-ও হতে পারে। তাই জীবনসঙ্গীকে নিবিড়ভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। অমিল ঘটলে পরস্পর আলোচনা করে মিটিয়ে নিন যত দ্রুত সম্ভব। মনের ভেতর ক্ষোভ কিংবা প্রত্যাশার চাপ পুষে সম্পর্কে বিষ ছড়ানো কিছুতেই হবে না বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। খেয়াল রাখুন, সামাজিক ও আইনি সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়েছেন বলে গায়ের কিংবা আবেগের জোরে জোর খাটানো উচিত নয়; বরং সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিন। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকতালে পর্যাপ্ত সময় রাখুন তার জন্য।
পাঁচ
দাম্পত্য জীবন কোনো একপক্ষীয় বিষয় নয়, যদিও অনেক দাম্পত্যে সে রকম অনাকাঙ্ক্ষিত চিত্রের দেখা মেলে। কিন্তু আপনি এই অত্যাধুনিক সময়ের একজন বিশ্বনাগরিক হয়ে কেন বয়ে বেড়াবেন তেমন অসুস্থতার ভার? বরং নিজ উদ্যোগে সারিয়ে তুলুন অদৃশ্য ক্ষতগুলো। পরস্পরের প্রতি প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। সেই প্রত্যাশার ওজন মাপুন উপলব্ধির নিক্তিতে। তারপর নির্ধারণ করুন নিজ বিবেচনায়, কোন প্রত্যাশাগুলো যৌক্তিক, আর কোনগুলো বাড়াবাড়ি। এ নিয়ে খোলামনে কথা বলুন জীবনসঙ্গীর সঙ্গে।
জীবন মধুময় হোক। দাম্পত্য হোক অর্থবহ।
ছবি: মেট্রো ওয়েডিং