ফরহিম I বিউটি স্লিপ
প্রয়োজন পুরুষদেরও। সেলফ কেয়ারের জন্য বেস্ট। বিভিন্ন সৌন্দর্য সমাধানে
ঘুম আবশ্যক। শুধু দিনশেষের ক্লান্তি ভুলে পরদিন তৈরি হওয়ার জন্য নয়। ঘুমে জীবনের বহু কিছুর সমাধান, আবার ঘুমের অভাবে হয় হাজার রকম সমস্যা। সেন্ট লুই হসপিটালের পালমোনারি অ্যান্ড স্লিপ স্পেশালিস্ট জোয় অজিলের বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ঘুম আর ঘুমের অভাব নিয়ে। যেমন, যারা পর্যাপ্ত ঘুমান না, তাদের দেহের প্রদাহ-সংক্রমণ সেরে উঠতে তুলনামূলক বেশি সময় দরকার পড়ে। এর কারণ, তাদের কোষের সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়। এমন হলে ‘ইনফেকশন কিওর’ ধীর হয়। সুস্থতা আসে দেরিতে। দিনের বেলায় ত্বক প্রধানত নিজেকে রক্ষায় কাজ করে। চেষ্টা করে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি, তাপ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো ধূলিকণার মতো বিভিন্ন দূষণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার। আর রাতের বেলায় ত্বক নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য সময় বের করে। মনোযোগী হয় নিজেকে ভালো রাখায়। তাই এ সময়ে দরকার হয় ঘুমের। জাগ্রত দেহ ত্বককে বিশ্রাম দেয় না। রাত জাগার প্রভাব তাই ত্বককে জ্বালাতন করে।
কেউ কেউ মনে করেন, কম ঘুমানো যেতেই পারে। ঘুম মানে সময়ের অপচয়! এ সময় বরং অন্য কাজে মনোযোগ দিলে সময়ের যথাযথ ব্যবহার হবে। অজিলের গবেষণা জানায়, পর্যাপ্ত না ঘুমালে সুন্দর স্বাস্থ্য ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ওয়ার্কআউটের সঠিক আউটকামের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো মেডিকেল স্কুলের গবেষকেরা জানিয়েছেন, কম ঘুম প্রভাব ফেলে শরীরের মেটাবলিজমে। নিদ্রাহীনতা দেহে গ্লুকোজের উৎপাদন কমায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
কম ঘুমে অস্থিরতা তৈরি হয়। স্ট্রেস বাড়ে। এর কারণ, ঘুমের অপর্যাপ্ততায় স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল উচ্চমাত্রায় তৈরি হয়। স্মৃতিশক্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এটি। মনে থাকে না অনেক কিছুই। ঘুমের ভুলে মনের ভুল হয়ে যায়! ডায়াবেটিসের কারণগুলোর মাঝেও লাল দাগে পাওয়া যায় কম ঘুমের খবর! অপর্যাপ্ত ঘুমে ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায়। আরও বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপর্যাপ্ত ঘুমকে। নিদ্রাদেবীর সঙ্গে আড়ি থাকলে ড্রাই মাউথ, গলাব্যথা, মর্নিং সিকনেসের মতো অস্বস্তি কষ্ট দিতে পারে।
অল্পস্বল্প অস্বস্তির গল্পের বাইরে গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবেও দুর্নাম আছে কম ঘুমের। জার্নাল অব দ্য আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন গেল বছরের এক গবেষণাপত্রে জানিয়েছে, যেসব পুরুষের ঘুম তেমন গাঢ় নয়, অন্যদের তুলনায় তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা ৮৩ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া, সেক্স লাইফে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয় কম ঘুমে। লিবিডো কমে যায়। হরমোন টেস্টোস্টেরন উৎপাদন ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমায়। কম ঘুমের প্রভাব পড়ে পেটের অন্তরালেও। অস্বস্তি হয়। অনিয়মিত ঘুমের মানুষেরা ক্যালরি গ্রহণ করে থাকেন তুলনামূলক বেশি। অনেকে অতিরিক্ত প্রায় ৩০০ ক্যালরি পর্যন্ত গ্রহণ করেন।
ঘুমের দীনতার প্রভাব সেলফ কন্ট্রোলেও আঘাত হানে। তাই রাতের পর রাত যাদের ঘুম আসে না, তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার বিষয়টি। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ঘুমের সঙ্গে সন্ধি তৈরি করতে পারলে সুন্দর হবে জীবনযাপন। স্লিপ সাইকেলের ‘ডিপ স্লিপ’ অংশে ত্বকে গ্রোথ হরমোন নিঃসরিত হয়। এতে ত্বকের কোলাজেন উদ্দীপিত হয়। ঘুমের তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরে পাওয়া যায় এই ডিপ স্লিপ স্টেজ। ত্বকে কোলাজেনের পরিমাণের ওপর মসৃণতা অনেকাংশেই নির্ভর করে। সেই সঙ্গে কোমল ভাব বাড়ে। ত্বককে ফাইন লাইন ও রিংকেল থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। পুরুষদের ত্বকে মেয়েদের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কোলাজেন বেশি থাকে। ৪০ বছরের পরে ত্বকে কোলাজেনের পরিমাণ কমতে শুরু করে। তখন ত্বকে ভাঁজগুলো সহজে তৈরি হয়। ঘুমের অভাবে দ্রুত হয় এই প্রক্রিয়া।
ঘুমের সময়ে ত্বকে রক্তসঞ্চালনের হার এবং উজ্জ্বলতা বাড়ে। কোয়ালিটি স্লিপের পরের দিন সকালে ত্বকের সজীবতা যে কারও নজর কাড়বেই। ছেলেদের কম ঘুমের প্রভাব পড়ে চুলেও। যার বৃদ্ধি নির্ভর করে চুলের ফলিকলের ওপর। তাই প্রয়োজন হয় পুষ্টি, ভিটামিন এবং মিনারেলের। রক্তপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও প্রবাহিত হয়। ঘুমের সময় রক্তচলাচল বাড়ে বলে চুলের বৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঘুমহীনতায় স্ট্রেস হরমোনের উৎপাদন বাড়ে। চুল ঝরে যেতে শুরু করে। ক্লান্তি আসে দ্রুত। মুখের সহজাত ভঙ্গি পরিশ্রান্ত দেখায়।
বিউটি স্লিপে বিউটিফায়িং
কেন ঘুম জরুরি, না ঘুমালে কী কী হয়, তা তো জানা হলো, কিন্তু ঘুমের মান বাড়বে কীভাবে? উপকারিতা নিশ্চিত করতে ঘুমানোর আগের রুটিনে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। যেমন শোয়ার আগে সুন্দর করে মুখ পরিষ্কার করে নেওয়া। এতে মুখে জমে থাকা তেল চলে যাবে। আর এক্সফোলিয়েটিং সঠিকভাবে করা হলে ত্বকের ক্লগ, মৃতকোষ উঠে আসবে। এতে পরিষ্কার হবে ত্বক। পানির শীতলতায় সারা দিনের ক্লান্তি মুছে যাবে।
ময়শ্চারাইজিংও ত্বকের জন্য জরুরি। সকাল-সন্ধ্যা মেকআপের প্রলেপ, ধুলোবালির ওড়াউড়িতে শ্রান্তি আসে ত্বকে। মুখ ধুয়ে ময়শ্চারাইজারের হালকা প্রলেপ দিয়ে নেওয়া যায় ঘুমানোর আগে। এতে ত্বক পাবে প্রাণবন্ত থাকার রসদ। সারবে শুষ্কতা-রুক্ষতা।
নাইট স্কিন কেয়ারে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একাধিক প্রডাক্ট ব্যবহার করলে কোনটির পরে কোনটি ব্যবহার করতে হবে, সেটি জেনে নেওয়া জরুরি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। পরামর্শ অনুযায়ী বিরতি দিয়ে দিয়ে ত্বকের যত্ন নিলে বিউটি স্লিপের পরে মিলবে কাঙ্ক্ষিত সজীব ভাব।
চোখের যত্নে বাড়তি মনোযোগে উপকার মিলবেই। তাই ঘুমের আগে চোখের বিশ্রামের জন্য চারপাশে আই ক্রিম বুলিয়ে নেওয়া যায়। রাত জাগলে চোখের নিচে আই ব্যাগ আর ডার্ক সার্কেল দৃশ্যমান হয়। তাই ঘুমের আগের আই কেয়ারে চোখের চারপাশের ত্বক যেমন সুন্দর থাকবে, তেমনি ঘুম এসে যেতে পারে চোখ বুজলেই।
সবকিছু শেষ করে বিছানায় শোয়ার আগে পানি পানে সারা রাতের নির্জলা সময়টায় হাইড্রেটেড থাকবে শরীর।
ঘুমে ঘুমে ঘণ্টা পার
২৪ ঘণ্টার মাঝে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুম একজন পুরুষের জন্য জরুরি। ৪ ঘণ্টার কম যদি হয় ঘুমের সময়, তাহলে শরীর-মন বিদ্রোহ করে। ক্লান্তি পরাস্ত করে।
ঘুমের আয়োজন
বিউটি স্লিপের জন্য আয়োজনও সুন্দর হওয়া চাই। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমুতে গেলে শরীর ও মন জানান দেবে কখন ঘুমাতে হবে। দিনের সে সময়টায় আপনাআপনিই ঘুম চলে আসবে।
বেড টাইম রিচুয়াল ঘুম প্রগাঢ় করে তুলতে সহায়ক। উষ্ণ শাওয়ার নেওয়া যেতে পারে। এতে গোসল সারার পর বাতাসের তাপমাত্রা দেহকে শীতলতা দেবে।
প্রতিদিনের ব্যায়াম ঘুমাতে সাহায্য করে। অ্যারোবিক এক্সারসাইজে দেহ থেকে স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। ব্রেইনের অ্যাকটিভিটি বাড়িয়ে তোলে, হার্ট রেটও বৃদ্ধি করে। এই দুই-ই ঘুমের জন্য ভালো।
আরও কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা যায়। যেমন শোয়ার ঘরের তাপমাত্রা এবং আলো। ঘুমের সময়ে দেহের তাপমাত্রা কমে যায়। তাই ১৬-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঘুম সবচেয়ে ভালো হয় বলেই তথ্য পাওয়া যায়। রুমে আলো থাকলেও ঘুমে অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ করে স্ক্রিনের আলো এ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। ঘুমের কিছু আগে থেকে ফোন এবং টিভি স্ক্রিন বন্ধ রাখা যেতে পারে। নরম বালিশ আর আরামদায়ক ম্যাট্রেসেও শান্তি মিলবে।
খাবারেও লুকিয়ে থাকে ঘুম ঘরের চাবি। যেমন কলা, আমন্ড, মধু, কিউয়ি ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে উৎসাহিত করে; আবার চিজ, কফি, অ্যালকোহল ঘুমকে দূরে সরায়। এই বিষয়গুলো মনে রেখে ডায়েট প্ল্যান করা যেতে পারে। তাতে ঘুম হবে আরামের, শান্তির।
সারাহ্ দীনা
মডেল: যশ মির্জা
মেকওভার: পারসোনা মেন্জ
ছবি: কৌশিক ইকবাল