অর্গানিক I ম্যাজিক্যাল জিনসেং
সব রোগের দাওয়াই। সুন্দর ত্বক আর চুলের জন্যও এটি ফলপ্রদ
জিনসেং হলো প্যানাক্স উদ্ভিদের শিকড়। প্যানাক্স শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ প্যানাসিয়া থেকে। এর অর্থ ‘সর্বরোগের ওষুধ’। জিনসেং মূলত উত্তর-পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে চীন, কোরিয়া ও পূর্ব সাইবেরিয়ায় জন্মে। বোঝা যাচ্ছে, ঠান্ডা পরিবেশই এর জন্মস্থল। গবেষকদের মতে, পাঁচ হাজার বছরের বেশি আগে থেকে চীন ও কোরিয়ায় জিনসেং ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঔষধি গুণের জন্য চীনা ও কোরিয়ানদের কাছে এটি খুব জনপ্রিয়।
মূলত দুই ধরনের জিনসেং ঔষধি গুণসম্পন্ন- আমেরিকান জিনসেং, এশিয়ান জিনসেং। দুটিকেই বলা হয় প্যানাক্স জিনসেং। তবে এশিয়ান জিনসেং বেশি কার্যকর। জিনসেং সাদা (খোসা ছাড়ানো) ও লাল (খোসাসহ) দুই ধরনের হয়। লাল জিনসেং উৎকৃষ্ট। জিনসেনোনোসাইড নামক একটি উপাদান এর কার্যক্ষমতার উৎস।
জিনসেং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উৎকৃষ্ট দাওয়াই। ২০০৫ সালে জার্নাল অব সাইকোফার্মাকোলজি নামক মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, ৩০ জন যুবকের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, জিনসেং সেবন তাদের পরীক্ষার সময় স্মৃতিশক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
২০০০ সালে একই জার্নালে যুক্তরাজ্যের কগনিটিভ ড্রাগ রিসার্চ লিমিটেড এবং চীনের ঝেজিঅ্যাং কলেজ কর্তৃক ৪২২ জন ব্যক্তিকে নিয়ে করা এক গবেষণায় জানা গেছে, জিনসেং মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধদের স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতেও সহায়ক। ২০০৫ সালে অ্যানালস অব নিউরোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জিনসেং মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট করে স্মৃতিশক্তিকে দুর্বল করে দেয়া রোগ (পারকিনসন, হানটিংটন) প্রতিরোধে সাহায্য করে।
জিনসেং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ২০০৩ সালে এক গবেষণা অনুযায়ী, দিনে ৬ মিলিগ্রাম জিনসেং ৮ সপ্তাহ নিয়মিত খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। টোটাল কোলেস্টেরল (টিসি), ট্রাইগ্লিসারাইড (টিজি) এবং লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিনের (এলডিএল) মাত্রা কমিয়ে হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিনের (এইচডিএল) মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এটি।
শ্বাসকষ্ট কমাতে জিনসেং খুব উপকারী ভূমিকা রাখে। ১০০ মিলিগ্রাম ৩ মাস নিয়মিত খেলে শ্বাসকষ্টের রোগ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারির নিরাময়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
আমেরিকার মায়ো ক্লিনিক ক্যানসার সেন্টারের গবেষকেরা বলছেন, ক্যানসারে ভুগছে এমন রোগীদের দুর্বলতা কাটাতে জিনসেং অত্যন্ত কার্যকর। গবেষকেরা ৩৪০ জন ক্যানসার রোগীর উপর গবেষণা করে দেখেছেন, আট সপ্তাহ ধরে উচ্চমাত্রায় জিনসেং সেবনকারী রোগীদের দুর্বলতা চিকিৎসা গ্রহণকারী অন্যদের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
এ ছাড়া মেয়েদের হরমোন বৃদ্ধিতে, সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হজমে সমস্যা ইত্যাদি নিরাময়ে এর জুড়ি নেই।
শক্তিবর্ধক পানীয় হিসেবেও জিনসেং দারুণ কার্যকর।
ত্বক ও চুলচর্চায় এটি অসামান্য ভূমিকা রাখে। বার্ধক্যরোধে পথ্য হিসেবে কাজ করে। এতে প্রচুর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস রয়েছে, যা ত্বকের কোষগুলো সক্রিয় রাখে। নিয়মিত সূর্যালোক ও ধুলাবালির সংস্পর্শে থাকলেও জিনসেং ফ্রি র্যাডিকেল থেকে ত্বককে মুক্ত রাখে। কোলাজেন উৎপাদনে অংশ নেয়। ফলে ত্বকের দৃঢ়তা বজায় থাকে। ত্বক হয় সতেজ ও নরম। জিনসেংয়ে উঁচু মাত্রার ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে। এসব উপাদান ত্বকের কোষে মিশে যায়। ফলে ত্বকের মৃত কোষগুলো সজাগ হয়ে উঠে নতুন কোষের জন্ম নেয়। পাশাপাশি চোখের চারপাশে বলিরেখা ও কালো দাগ দূর করে। এই কাজে জিনসেংয়ের চমৎকার একটি মাস্ক রয়েছে। এতে প্রয়োজন জিনসেং পাউডার এবং মধু বা দুধের একটি মিশ্রণ। মিশ্রণটি যদি কেউ ঘন করতে চায়, তাহলে ডিমের সাদা অংশ বা ময়দা মিশিয়ে নিলেই হবে। ঘন এই মাস্ক চোখের চারপাশে মাখতে হবে। ৫ থেকে ১০ মিনিট রেখে ঈষদুষ্ণ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিতে হবে।
জিনসেংয়ের ফেসপ্যাক মুখত্বকের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রদ। প্যাক তৈরি করতে লাগবে জিনসেং তেল, সূর্যমুখী তেল এবং মধু বা পানি। ভালো ফলের জন্য সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করতে হবে। এটি ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন করে। অসম্পূর্ণ বিপাক ক্রিয়ায় সৃষ্ট ব্রণ, চর্মরোগ এবং রুক্ষতা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
ত্বকের ময়লা পরিষ্কার করতে ঘরে তৈরি একটি ফেসপ্যাক অত্যন্ত ফলপ্রদ। প্রথমে জিনসেং সেদ্ধ করতে হবে (দুই ঘণ্টা)। তারপর সেই পানি ঠান্ডা করে একটি বোতলে ছেঁকে নিতে হবে। প্যাকটি ফ্রিজে রেখে ফেসওয়াশের মতো প্রতিদিন ব্যবহার করা যায়।
প্যানাক্স জিনসেং হলো অ্যান্টি-অ্যাপোপটোটিক। অর্থাৎ ত্বকের প্যাপিলা কোষের বিস্তারে উন্নয়ন ঘটায়। পুনরুৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায়। এটি মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ চাঙা করে, যা চুলের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। দেহে রোগ প্রতিরোধ সঠিকভাবে না হলে চুলের ওপর প্রভাব পড়ে। প্যানাক্স জিনসেং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রেখে চুল ঝরে পড়া রোধ করে। চুলের ডগা ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়।
চুল পড়া রোধে জিনসেং দিয়ে খুব সহজে একটি পেস্ট তৈরি করা যায়। প্রথমে ১ চা চামচ জলপাই তেল এবং ১ চা চামচ বাদাম তেলের সঙ্গে ১ চা চামচ নারকেল তেল মেশাতে হবে। মিশ্রণটি দুই মিনিট কম আঁচে গরম করতে হবে। তারপর ঠান্ডা করে জিনসেংয়ের একটি শিকড় ছিলে টুকরো করে কাটতে হবে। টুকরোগুলো রোদে শুকাতে হবে। তারপর এমনভাবে গুঁড়া করতে হবে, যেন পাউডারের মতো মিহি হয়ে যায়। এর সঙ্গে ২-৩ টেবিল চামচ ঠান্ডা তেলের মিশ্রণ ভালোভাবে মেশালেই পেস্ট তৈরি হবে। এটি দশ মিনিট চুলে মাখতে হবে ম্যাসাজ পদ্ধতিতে। রেখে দিতে হবে ঘণ্টাখানেক। সবশেষে শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করে নিতে হবে। কেবল চুল পড়াই দূর হবে না, সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পাবে।
জিনসেং সাধারণত ট্যাবলেট, পাউডার, ড্রিঙ্কস হিসেবে খাওয়া হয় এবং বোতলের গায়েই ব্যবহারবিধি লেখা থাকে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান হেলথ সিস্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী, মানসিক শক্তি বাড়াতে ৯০০ মিলিগ্রাম পাউডার দৈনিক ৩ বার, শক্তি বা স্ট্যামিনা বৃদ্ধি ও ডায়াবেটিসের জন্য ২০০ মিলিগ্রাম পাউডার দিনে ১ বার, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুবার খাওয়া যাবে। চাইলে সরাসরি খাওয়া যায়। শূন্য দশমিক ৫ থেকে ২ গ্রাম শিকড় খাওয়া যাবে। শিকড়টি চিবিয়ে খেলে আরও ভালো। কিংবা জিহ্বার নিচে রেখে দিয়েও খাওয়া যায়। পানিতে ভেজানো শিকড় দারুণ কার্যকর। পাঁচ মিনিট ফুটিয়ে পানিসহ খেলেও উপকার পাওয়া যায়।
ঢাকা সিটি কলেজের গেটের অপর পাশে সায়েন্স ল্যাবরেটরি বিক্রয়কেন্দ্রে এটি এনার্জি ড্রিঙ্কস হিসেবে পাওয়া যায়। এ ছাড়া মডার্ন হারবাল গ্রুপ এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ট্যাবলেট হিসেবে জিনসেং বিক্রি করে। পণ্য কেনার আগে যাচাই করে নিতে হবে বোতলের গায়ে প্যানাক্স জিনসেং লেখা আছে কি না। কারণ, এটাই অরিজিনাল এশিয়ান জিনসেং।
তবে খাওয়ার সময় সতর্কতা জরুরি। শিশু, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য এটি নিরাপদ নয়। স্নায়ুর ওপর কাজ করে এমন কোনো ওষুধ (ঘুমের ওষুধ, ডিপ্রেশনের ওষুধ) খেলে জিনসেং খাওয়া যাবে না। কারণ, স্নায়ু ক্ষতিকর মাত্রায় উদ্দীপ্ত হতে পারে। হার্টের রোগীদের মধ্যে যারা হেপারিন বা ওয়ারফারিন খাচ্ছেন, জিনসেং খাওয়া তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের জিনসেং খাওয়া উচিত নয়। যাদের স্তন কিংবা জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে ক্যানসার আছে, তাদের জিনসেং খাওয়া বারণ। কারণ, অতিরিক্ত ইস্ট্রোজেন এসব ক্যানসারে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
রেন্টিনা চাকমা
ছবি: ইন্টারনেট