skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I ফ্যাশনে হ্যান্ডপেইন্ট

ফ্যাশনে ডিজাইন আর পেইন্টের মেলবন্ধন। ধারাটি নতুন নয়, এর জনপ্রিয়তাও নয় উপেক্ষীয়। একসময় বাংলাদেশে এর বেশ সমাদর ছিল। মাঝে কিছুটা ভাটা পড়লেও নতুন করে চাহিদা বেড়েছে। পোশাক-নকশার এই মাধ্যমের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন উম্মে তানিয়া

কাপড়, ফ্যাশন আর কাপড়ের ডিজাইন- সব প্রায় একই সময়ে শুরু হয়েছে, যদিও রঙ বা ডিজাইনিং অনেকটাই পুরোনো। কারণ, কাপড় তৈরির অনেক আগে মানুষের শরীরে পেইন্ট করার প্রচলন ছিল। শরীরে বিভিন্ন রকমের ডট ব্যবহার করে এই ডিজাইন হতো। পরবর্তী সময়ে তা চলে আসে কাপড়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রিন্ট ও পেইন্টের প্রসার ঘটতে থাকে।
হ্যান্ডপেইন্টের শাব্দিক অর্থ হাতে করা রঙ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিত্রশিল্প; শিল্পীর ব্যবহৃত রঙ বা রঞ্জকের ব্যাখ্যা ও ধরন। তা ছাড়া রয়েছে কারিগরি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে নান্দনিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রঙ নিয়েই খেলেন হ্যান্ডপেইন্ট আর্টিস্টরা, আঙুল আর তুলির প্রতিটি আঁচড় নিছক কোনো দাগ কেটে যাওয়া নয়, বরং তাতে মিশে থাকে স্বপ্ন ও মায়া। নিজের ভেতরের গল্প ছুঁয়ে যায় প্রতিটি আঁচড়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন পেইন্ট করবেন, ডিজাইন করবেন কোনো ড্রেস, তখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে আপনার মন ঠিক কী অবস্থায় আছে। বলা হয়, পেইন্টিংয়ের সৌন্দর্য অনেকাংশেই নির্ভর করে শিল্পীর মানসিক অবস্থার ওপর।
প্রিন্ট ও পেইন্ট- দুটি ভিন্ন আঙ্গিক ও মাধ্যম। পেইন্ট হতে পারে প্রিন্টের মতো, কিন্তু প্রিন্ট কখনোই পেইন্টের মতো হতে পারে না। শুরুতে মানুষ দুটো পদ্ধতিতেই কাপড় রাঙাতো। প্রথমত, কোনো ছবির পুরো অংশকে রঙ করতো। দ্বিতীয়ত, একই রকমের একটা ডিজাইন তৈরি করে তাতে রঙ করতো, যা পরে প্রিন্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়।
প্রাচ্যে কাপড়ে রঙ করার প্রচলন তিন হাজার বছরের পুরোনো। আলেক্সান্ডার ভারতে এসে হাতে আঁকা ও ছাপাই- দু ধরনের কাপড় দেখেছেন। পরে বাণিজ্যব্যবস্থার উন্নতির ফলে এশিয়ার বাইরে মিসর ও গ্রিসে এর ব্যবসা শুরু হয়। আরও পরে ইউরোপ ও আফ্রিকায় এর রপ্তানি শুরু হয়। চীনেও ব্লক প্রিন্টের প্রচলন ছিল, যা জাপানিরা রপ্ত করেছিল।
এরই সঙ্গে বলতে হয় সিল্ক কাপড়ে হ্যান্ডপেইন্টিংয়ের কথা; কারণ, চীনারাই প্রথম এর ব্যবহার শুরু করে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে হ্যান রাজত্বকালে। রাজদরবারে তখন সবচেয়ে সমাদৃত শিল্পকলা ছিল রেশম বস্ত্রে পেইন্টিং। যাতে থাকতো কালো রঙের ক্যালিগ্রাফি। এতে ব্যবহৃত রং, আঠা ও ব্রাশ- সবই ছিল প্রাকৃতিক। ক্যালিগ্রাফি থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের ছবি আঁকার প্রচলন ঘটে। আসে রঙের সমাহার। সিল্কের ওপর আঁকার আগে এর প্রস্তুতি প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ। এটি ছিল তাদের জন্য একধরনের মেডিটেশন। দর্শনচর্চাও হতো এর মধ্য দিয়ে। এটাও আয়ত্ত করে জাপানিরা। পরে এর প্রসার ঘটে পৃথিবীজুড়ে। এখন এই সিল্ক পেইন্টিংয়ের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় বাটিক ও টাই-ডাই, আরও নান্দনিক করে তোলার জন্য। জাপানিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো এবং চীনাদের পোশাক চেংসামেও হ্যান্ডপেইন্টের প্রচলন রয়েছে।
আমেরিকার অগ্রগণ্য শিল্পী হায়াসিন্থ ব্যারন। তিনি একাধারে শিক্ষক, কবি, নাট্যকার, আর্টিস্ট, ভাস্কর, ছাপচিত্রশিল্পী, ফ্যাশন ও ডিজাইনার। ইন্টেরিয়র ডিজাইনও করেন। আশির দশকে সেলিব্রিটি শিল্পীদের পোশাকে হ্যান্ডপেইন্ট করে তিনি বিখ্যাত হন। পরে তিনি হ্যান্ডপেইন্টেড পোশাকের কারখানা তৈরি করেন এবং সেখানে প্রায় চার শ শ্রমিক কাজ করেন তার অরিজিনাল হ্যান্ডপেইন্টকে পোশাকে কপি করার জন্য। রঙের ওয়াশ ও গাঢ় রঙের ব্যবহার ছিল তার হ্যান্ডপেইন্টে।
আরেকজন তরুণ আর্টিস্ট হলি ফওলার্স। তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান ডিজাইনার, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে পোশাকে অর্নামেন্টাল ডিজাইন। লন্ডনের সেন্ট মার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পেইন্টিং, প্রিন্টমেকিং এবং টেক্সটাইল ডিজাইনে পড়াশোনা করেন। তার মতে, পোশাক হলো একটা ক্যানভাস, তা পরার মানে আর্টকে পরিধান করা, সঙ্গে ফ্যাশনকে ধারণ করা। তার হ্যান্ডপেইন্ট একধরনের ইল্যুশন তৈরি করে। যেমন তিনি গাউন বা বিভিন্ন পোশাকে এমনভাবে অর্নামেন্টগুলোকে চিত্রিত করেন, দেখে অনেকে ভাবেন গয়না পরেছেন। ফ্লোরাল ও অর্নামেন্ট ডিজাইনে আধুনিক ও অভিজাত এক উপস্থাপন থাকে তার কাজে।
এই ধারার আরেকজন হলেন ডিলান ও’ব্রাউন; যিনি ২২ বছর বয়সে, ২০১৩ সালে পেইন্টিং শোতে সরাসরি একজন মডেলের ড্রেসে হ্যান্ডপেইন্ট করে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ড্রেস ছাড়াও কাজ করেন জুতা, ঘড়ি এবং অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের ওপর। ক্যালিফোর্নিয়ার বাল্টিমোরে রয়েছে তার একটি হ্যান্ডপেইন্টেড পোশাকের শোরুম। সেখানেই তার বাড়ি। এভাবেই পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে চলছে হ্যান্ডপেইন্টের ফ্যাশন। ফ্রান্সেও রয়েছে লেদার পেইন্টের ব্যবহার। এ ছাড়া টি-শার্ট, স্কার্ফ, ব্যাগ, শু, বুটেও হ্যান্ডপেইন্ট বেশ জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নানা ধরনের কাপড় আর মাধ্যমে হ্যান্ডপেইন্ট হয়ে থাকে।
তবে গল্পটা ভিন্ন। হ্যান্ডপেইন্ট শুধুই শৌখিন আর্টিস্টদের কাজ ছিল; ক্রেতারাও ছিল নির্দিষ্ট গন্ডির। ধারাটা মূলত শুরু হয় সত্তর ও আশির দশকে। যারা খুব শৌখিন, নিজের ডিজাইন দিয়ে অথবা নিজের হাতেই পোশাক ডিজাইন করতে পছন্দ করতেন, মূলত তারাই নিজেদের পোশাকে হ্যান্ডপেইন্ট করতেন। বছর দশেক লেগেছে সাধারণ মানুষের ড্রেস লিস্টে এর জায়গা করে নিতে। কারণ শিল্পীর সম্মানী, উপকরণ ও উপাদানের উচ্চ বাজারদর; ফলে মানসম্মত পোশাক ক্রয়সাধ্যের মধ্যে রাখা কঠিন ছিল। আর কাজটা সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশে পোশাক অলংকরণের ভাবনাটা সবার সামনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাজির করেন এক দম্পতি- কাজী রকিব ও মাসুদা কাজী। সম্প্রতি মাসুদা কাজী হ্যান্ডপেইন্টেড জুয়েলারির প্রদর্শনী করেন গ্যালারি কায়ায়। বর্তমানে এই দম্পতি আমেরিকাপ্রবাসী। রাজশাহী থেকেই কাজ করতেন একেবারে বাণিজ্যিকভাবে। বাংলাদেশের শীর্ষ সব ফ্যাশন হাউজের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের করা শাড়ি, কামিজ এসব অনেক শোরুমেরই বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এই দম্পতির সবচেয়ে পছন্দের ফর্ম হচ্ছে ময়ূর, মাছ, প্যাঁচা, ফুল, পদ্ম। বলা যায় তাদের দেখে ফ্যাশনপ্রেমীরা এই ধারার দিকে ঝুঁকেছেন।
তবে এই ধারার পথিকৃৎ আসলে পটুয়া কামরুল হাসান। তাঁর হাউজ রূপায়ণে তিনি হ্যান্ডপেইন্টেড পোশাক করেছেন। অনেক পরে এসে প্রয়াত শাহরুখ শহীদ এই পোশাক নিয়ে কাজ করেছেন। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবিতে তিনি নিজে যেমন আঁকতেন, তেমনি আঁকিয়েও নিতেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারা যান। তিনি কখনো হেনরিজ হেরিটেজ, কখনোবা শাহরুখস কালেকশনের ব্যানারে হ্যান্ডপেইন্টেড পোশাক তৈরি করেছেন। মূলত প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতেন। পাখি, প্রজাপতি তার পছন্দের বিষয় ছিল।
এ ছাড়া তরুণ ঘোষ ও স্বপন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন হ্যান্ডপেইন্টেড পোশাকে। তরুণ ঘোষের নাম এলেই সবার আগে আসে মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারের কথা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়, বর্ণাঢ্য ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের প্রথম পোস্টার ডিজাইন তাঁরই করা। সমানভাবে হ্যান্ডপেইন্টেও রয়েছে তার নাম। স্বপন চৌধুরী হ্যান্ডপেইন্টে বিখ্যাত তাঁর দক্ষ লাইনের জন্য। তাঁর করা এই পোশাকের ক্রেতা বিশেষত পরিচিত মহলের মানুষজন। তিনি ডিজাইন করেন ফুল, পাখি, লতাপাতা- সবকিছু মিলিয়ে।
ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ- এই তিনটি মাসে নানা রঙের পোশাকের সমারোহ থাকে বাংলাদেশজুড়ে। ফ্যাশন হাউজগুলোর আয়োজনে থাকে বাহারি রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট ও শার্ট। এসব পোশাকে হ্যান্ডপেইন্টের ফর্মগুলোও থাকে মেলানো। সঙ্গে ব্যবহার করা হয় এমব্রয়ডারি, চুমকি পুঁতি, স্প্রে পেইন্ট ও কারচুপির কাজ।
ফেসবুক এখন অনেকের কাছে ব্যবসায়িক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক পেজের সাহায্যে নিজেদের তৈরি পোশাক এবং অন্য সামগ্রীগুলো ক্রেতাদের সামনে উপস্থাপন করছেন তরুণ ব্যবসায়ীরা। রা, দি মালাকাইট ক্যাসকেট, পেরিডট, সঞ্জয় হ্যান্ডপেইন্ট, গুটিপোকা, হিজিবিজি, হুর নুসরাত, এহা, প্রজাপতি, কিংশুক, কারুজ ইত্যাদি বিভিন্ন পেজে দেখা মেলে হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়ি, কামিজ, কুর্তি, পাঞ্জাবি এবং টি-শার্টের। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাক হলো মসলিনে করা মাল্টিকালার হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়ি। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই বেশি করছে এই কাজগুলো। পুরো আঁচলজুড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ফুল, পাখি, ময়ূর ওয়াশ ও ডিটেইল লাইনের কাজ মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে হ্যান্ডপেইন্ট (সঞ্জয় হ্যান্ডপেইন্ট) ও দি মালাকাইট ক্যাসকেট পেজের কাজগুলো অসাধারণ।
মূলত যারা শখের বশে হ্যান্ডপেইন্ট করেন, তাদের জন্য রেডিমেড ফেব্রিক পেইন্টগুলোই যথেষ্ট। যদি আনাড়ি হন পেইন্টের কাজে, তাহলে খুব সহজেই ক্যামেল বা পিডিলাইটের রেডি পেইন্ট দিয়ে অনায়াসে শখ মিটিয়ে ফেলতে পারেন। লাগবে শুধু ফ্রেশ কাপড় আর তুলি- ব্যস, হয়ে যান আর্টিস্ট। তবে যারা পেশাদারি নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের জন্য র’কালার এবং সঙ্গে মেশানোর অন্যান্য উপাদান কিনে নিজের পছন্দমতো রঙ বানিয়ে নেয়াই শ্রেয়। আজকাল একদম রেডি ফ্যাব্রিক কালার পাওয়া যায়, যাতে শুধু প্রয়োজনমতো পানি মিশিয়ে নিলেই হবে। যদি নিতান্তই নিজের মতো করে রঙ বানিয়ে কাজ করতে চান, তবে আপনাকে যেমন এনকে, বাইন্ডার, নিউটেক্স ইত্যাদি কিছু মূল উপাদানের নাম জানতে হবে; তেমনি জানতে হবে মিশ্রণের পদ্ধতি ও পরিমাণ।
পোশাকে হাতের কাজ বলতে একটা সময় শুধু সুই-সুতার নকশাকেই বোঝানো হতো। কুটিরশিল্পীদের কথা এলেই আগে নকশিকাঁথার নাম আসতো, যাতে পুরোটাই ছিল সুতার ফোঁড়ে করা। তবে এখন কাপড়ের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে শিল্পীর রংতুলিও দরকার।
সৃষ্টিশীল জগতের এত নতুন কিছুর ভিড়েও হ্যান্ডপেইন্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে মসলিন ও সিল্কে এই শিল্পকলার কদর বেড়ে চলেছে। এখন পৃথিবীর অনেক দেশে চলছে সিল্ক উৎপাদন ও হ্যান্ডপেইন্ট। বাংলাদেশে এর প্রসার আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, তরুণদের আগ্রহ এবং এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা।
tania.finearts@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top