যাপনচিত্র I চ্যালেঞ্জের তাড়না
রূপালী চৌধুরী। প্রখ্যাত করপোরেট ব্যক্তিত্ব। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। জানার চেষ্টা তার একান্ত জীবন
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে বিএসসি (অনার্স) পাসের পর ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হন; মেজর সাবজেক্ট মার্কেটিং। এরপর প্রথম কর্মস্থল ছিল সুইস মাল্টিন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড কোম্পানি—সিবা গেইগি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। যোগ দিয়েছিলেন প্ল্যানিং ইনফরমেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টে। দায়িত্ব ছিল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নিয়ে কাজ করা। পরবর্তীকালে বদলি হন প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে ব্র্যান্ড ম্যানেজার পদে থাকাকালে সেই কোম্পানি ছেড়ে যোগ দেন বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুরুতে ছিলেন প্ল্যানিং ম্যানেজার। পরবর্তীকালে মার্কেটিং, সেলস, ডিস্ট্রিবিউশন, প্ল্যানিং ও সিস্টেমস—এসব নিয়ে সরাসরি কাজ করেছেন। ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের প্রধান, সিস্টেমস বিভাগের প্রধান, ডিরেক্টর অব অপারেশনস। প্রোডাকশনস, সাপ্লাই চেইন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি)—পর্যায়ক্রমে এসব বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। এরপর ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি এমডি পদে পেয়েছেন পদোন্নতি। সেই দায়িত্ব এখনো সামলাচ্ছেন।
রূপালী চৌধুরীর মেজাজেই রয়েছে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের তাড়না। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি স্বাধীনচেতা। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে নানা রকম বৈষম্য দেখেছি। এসব আমি মানতে পারতাম না। অবশ্য আমার বাবা ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী ছিলেন ব্যতিক্রম। একজন মানুষ হিসেবে আমি জানি কী করা উচিত অথবা অনুচিত; এখানে সমাজের হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়। বাবা আমাকে সব সময় নিজে কিছু করার প্রেরণা জুগিয়েছেন।’
সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া রূপালী চৌধুরী শৈশবে শিখেছেন গান ও নাচ। চিকিৎসক বাবা চেয়েছিলেন, মেয়ে সায়েন্স নিয়ে পড়ুন। পড়েছিলেনও। তবে আইবিএতে এমবিএ পাঠ তার জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়। কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন করপোরেট জগৎ। সে সময় বাবা, ভাই, বন্ধুবান্ধব এবং তৎকালীন বাগ্্দত্তা (পরবর্তীকালে স্বামী)—সবার কাছ থেকেই উৎসাহ পেয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে সহকর্মীরাও জুগিয়েছেন প্রেরণা। বললেন, ‘বার্জারের এমডি হব—নারী হিসেবে এমন ভাবনা তখন ভাবতেও পারিনি। আমি স্রেফ কাজ করে যেতে চেয়েছিলাম। তাই যখনই যে কাজ পেয়েছি, চেষ্টা করেছি ভালোভাবে সম্পন্ন করার। আমার কখনো ব্যর্থ হওয়া চলবে না—এই তাড়না সব সময় ছিল। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে একজন স্লো লার্নার, তবে খুবই হার্ড ওয়ার্কিং, কমিটেড অ্যান্ড সিনসিয়ার পারসন মনে করি।’
রূপালী চৌধুরী আরও বলেন, ‘টাকা উপার্জন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করার তাগিদ অনুভব করি। নিজের না থাকলে মানুষের জন্য করা যায় না। নারীদের আমি সব সময় বলি, “টাইড আপ ইওর মানি উইদ সামথিং নোবেল কজ”। এখন আমার প্যাশন হচ্ছে কীভাবে নতুন নতুন কর্মসুযোগ সৃষ্টি করতে পারি।’
অদম্য, সফল এই মানুষ সকালে ঘুম থেকে ওঠেন ৭-৮টার মধ্যে। প্রথমেই চেষ্টা করেন মেডিটেশন করার। সকালের শুরুতে গুলশান ক্লাবে গিয়ে সাঁতার কাটা চাই-ই তার। (তবে কোনো কারণে সে সময় মেলাতে না পারলে সন্ধ্যায় সাঁতরান।) সাঁতার শেষে বাসায় ফিরে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবনের পর চিয়া সিড ও একটি কলা খান। এটুকুই তার সকালের নাশতা। দুপুরে খাদ্যতালিকায় থাকে ফল ও ডাবের পানি। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের মা। ছেলে কবি ও কলামিস্ট; কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ব্যবসা করছেন। মেয়ে এনভায়রনমেন্টাল বায়োলজিস্ট; কাজ করছেন কানাডায়। প্রবাসী কন্যার সঙ্গে ফোনে কথা বলার কারণে কখনো কখনো রাতে ঘুমাতে কিছুটা দেরি হয় তার।
স্বামী সিদ্ধার্থ হক (আবদুল হক) একজন প্রখ্যাত কবি। পাশাপাশি করপোরেট ব্যক্তিত্বও। কবির সঙ্গে সংসার প্রসঙ্গে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষের সঙ্গে সংসার করা সহজ নয়! এদের মাথা, মন ও শরীরে সব সময় নানা চিন্তা ঘোরে। এরা নৈমিত্তিক বিষয় নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন না। তবে বন্ধু ও সঙ্গী হিসেবে দুর্দান্ত।’
আড্ডা দিতে পছন্দ করেন রূপালী চৌধুরী। প্রতি শুক্রবার তার বাসায় বসে আড্ডার আসর; নিজের ও স্বামীর বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে। তাতে ঘুরেফিরে আসে গান-বাজনা, কবিতা, উপন্যাস, ছবি প্রভৃতি সৃজনশীল বিষয়। বর্তমানে যে বাসায় থাকছেন, সেটি সাজিয়েছেন নিজের মতো। তাতে ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচারের আধিক্য। শিগগির উঠবেন নতুন বাসায়। প্রতিশ্রুতিশীল ডিজাইনার রেজিনা নাসের সিনথিয়া করেছেন ইন্টেরিয়র ডিজাইন। বাসা সাজিয়েছেন মডার্ন ফার্নিচারের আধিক্য দিয়ে; যার পরতে পরতে শৈল্পিক ছোঁয়া। দেশ-বিদেশের পেইন্টারদের ছবি কালেকশনের শখ আছে রূপালী চৌধুরীর। স্বভাবতই সেসব পেইন্টিং শোভা পায় বাসায়। অন্যদিকে, বাসায় মালিকে দিয়ে গার্ডেনিং করাতে ভালোবাসেন।
ভ্রমণ বেশ প্রিয় এই করপোরেট ব্যক্তিত্বের। সম্প্রতি ইতালির ফ্ল্রোরেন্সের উফিজি আর্ট গ্যালারি ঘুরে এসেছেন। তার মতে, ফ্লোরেন্সের প্রতিটি ঘরই যেন একেকটি মিউজিয়াম। এ ছাড়া রোমে গিয়ে ঘুরে দেখেছেন ভ্যাটিকান সিটি। তিনি বলেন, ‘রেনেসাঁর আগে, বিশেষত ১০০০ থেকে ১৩০০ সাল পর্যন্ত সেখানকার সবকিছু বিবলিক্যাল। ওখানকার শিল্পকর্ম খেয়াল করলে বোঝা যায়, আর্টিস্টদের পক্ষে কতটুকু বৈপ্লবিক হওয়া সম্ভব।’
নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, যুক্তরাজ্যের টেট গ্যালারিসহ পৃথিবীর বেশ কিছু প্রসিদ্ধ আর্ট গ্যালারি দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। স্পেন, ফ্রান্স, ইস্টার্ন ইউরোপ রয়েছে বাকেট লিস্টে। তবে ইতালির প্রেমে বুঁদ হয়ে আছেন অদ্যাবধি। ইউরোপ তাকে বেশি টানে। সেখানকার ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প, সংগীত এই আকর্ষণের নেপথ্য কারণ। জানালেন, একবার মিলানে যেতে চান লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’ দেখার জন্য।
রূপালী চৌধুরীকে শাড়িতেই দেখা যায় বেশি। অবশ্য দেশের বাইরে গেলে পরিধেয় নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। নির্দিষ্ট কোনোটি নয়, বরং জগতের সব রংই তার প্রিয়। পছন্দের অ্যাকসেসরিজ ঘড়ি; ব্র্যান্ড ওমেগা। প্রিয় পারফিউম ব্র্যান্ড শ্যানেল। মেকআপে মিনিমালিস্টিক তিনি। নরমাল হেয়ারের পাশাপাশি পরিস্থিতি বুঝে কার্লি, পাফি করেন।
সচরাচর রান্না করেন না; তবে বাসায় অতিথি এলে পছন্দের ডিশ নিজে তৈরি করে খাওয়াতে ভালোবাসেন। পরিবারের সদস্যদের মতে, তার রান্না করা মাছ ও গরুর মাংস যেন অমৃতসুধা! এদিকে পরিবারের অন্যরা পছন্দ না করলেও শুঁটকি তার বেশ প্রিয় খাবার।
রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব স্টাইল থাকা দরকার। স্টাইল হচ্ছে হোয়াট ইউ ক্যান ক্যারি। ইট ক্যান্ট বি ডিফাইন্ড বাই অ্যানিবডি।’ অবসরে গান শোনা, বই পড়া আর সিনেমা দেখা—এই তিনটি তার বেশ ভালো লাগে। কখন কোন ধরনের গান শুনবেন, তা নির্ভর করে মন-মর্জির ওপর। পছন্দের কণ্ঠশিল্পী জয়তী চক্রবর্তী, অদিতি মহসিন, শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিং, মেহেদী হাসান, অজয় চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনেক ধরনের সিনেমা তার ভালো লাগে। বললেন, ‘ইদানীং নেটফ্লিক্সে অনেক নতুন পরিচালকের মুভি দেখি। তবে পরিচালকের চেয়ে বরং অভিনেতাদের দেখেই বেছে নেওয়া হয় বেশি। রবার্ট ডি নিরো, টম হ্যাংকস, হোয়াকিন ফিনিক্স, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, টম ক্রুজ, চঞ্চল চৌধুরী, আরফান নিশো, শাহরুখ খান, আমির খান, ভিকি কৌশল—এদের অভিনয় আমার প্রিয়। পছন্দের সিনেমা—সানফ্লাওয়ার, রোমান হলিডে, ঘরে বাইরে, অরণ্যের দিনরাত্রি, ইনসেপশন, দ্য রেভেন্যান্ট, বার্ডম্যান, ব্যাবেল। ডিরেক্টর হিসেবে সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, জেমস ক্যামেরন, ক্রিস্টোফার নোলান, মার্টিন স্করসেজি, কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো পছন্দের। এ ছাড়া প্রচুর ইউটিউব কনটেন্ট দেখি। পাকিস্তানি ড্রামা, কেবিসি, টার্কিশ ও স্প্যানিশ সিরিজও ভালো লাগে। একটা সময় পর্যন্ত প্রচুর বাংলা উপন্যাস পড়েছি। করপোরেট জগতে প্রবেশের পর এত বেশি অফিশিয়াল রিপোর্ট, নিউজপেপার ইত্যাদি পড়ছি, ফিকশন পড়ার খুব একটা সময় পাই না। এখন অবশ্য সাহিত্যের মধ্যে অটোবায়োগ্রাফি পড়ি বেশি। পছন্দের লেখক ইউভাল নোয়া হারারি।’
জীবনদর্শন তার কাছে সিম্পল—‘টুডে ইজ বেটার দ্যান ইয়েস্টারডে, টুমরো মাস্ট বি বেটার দ্যান টুডে।’ পছন্দের ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা ও বারাক ওবামা।
ফুয়াদ রূহানী খান
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন