skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I বিজয়ের বারতা

লড়াকু বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের যে স্বাধীন বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন, তাতে শুধু গর্ববোধ ও আনন্দ অনুভব করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ নেই

ডিসেম্বর। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার জানান দেয় একটি বছরের সমাপনী বার্তা। সারা বছরের হিসাব-নিকাশ একঝলকে করে নেওয়ার উপলক্ষ হাজির। তাই এমনিতেই এ মাসের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। আর আমরা যারা বাংলাদেশি, যারা এই স্বাধীন ভূখণ্ডের নাগরিক, তাদের কাছে ডিসেম্বর মানেই প্রথমত যেন এক সবিশেষ আনন্দ ও গৌরবের নামান্তর। মাসটির নাম আসতেই মনে পড়ে যায় শব্দযুগল—‘ষোলোই ডিসেম্বর’। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে, এদিনই অর্জিত হয়েছিল চূড়ান্ত বিজয়। সেদিন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত না হলে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কেমন হতো, তা অকল্পনীয়। আমরা ঘুণাক্ষরেও তা ভাবতে চাই না। তবে লড়াকু বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের যে স্বাধীন বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন, তাতে শুধু গর্ববোধ ও আনন্দ অনুভব করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ নেই। এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করে এবং অবদান রেখে বিজয়ের প্রকৃত মহিমা সমুন্নত রাখা।

দুই
১৬ ডিসেম্বর। এ দেশের মানুষের সর্বোচ্চ অর্জনের দিন। ইতিহাস বলে, হাজার বছরের যে পরাধীনতা এ ভূখণ্ডের মানুষ সহ্য করে এসেছিলেন, ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকদের বিবিধ নিপীড়নে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এ দেশের মানুষ। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অংশ নেন ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৭১ সালে তা রূপ নেয় চূড়ান্ত বাঁকে। ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রতিরোধে দাঁতভাঙা জবাব দেন এই ভূখণ্ডের সর্বস্তরের মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় লড়াইয়ে, অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। জন্ম ঘটে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। যে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রজ্ঞাপনে দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন এবং সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছরের ১৬ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে বিজয় দিবস।

তিন
জানা কথা, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’। স্বাধীনতা শব্দটিকে রূপক অর্থে ধরে নিয়ে এই উক্তির অনেক রকমের ভাষান্তর সম্ভব। যদি আক্ষরিক অর্থেও ধরি, তাহলে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিজয়ের মর্মার্থ উপলব্ধি করার দায়ভার এড়ানো অসম্ভব। অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা নিয়ে একটি জনপদের চূড়ান্ত বিজয় এনে দিয়ে গেছেন যারা, তাদের ঋণ শুধু কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেই, প্রতিবছরের ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন স্থাপনায় পুষ্পস্তবক অর্পণ কিংবা নানা রকমের গাম্ভীর্যপূর্ণ আয়োজনের সমাহার ঘটালেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ এর মাহাত্ম্য অনুভব করা এবং সেই অনুসারে জীবন চালিত করা প্রয়োজন। সরকার, নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তিদের ওপর এর ভার চাপিয়ে অনেকে দায় এড়াতে চান, যা কাম্য নয়; বরং আমাদের প্রত্যেক বাংলাদেশিরই রাখা চাই অবদান, যেন স্বাধীনতা ও বিজয়ের প্রকৃত তাৎপর্য ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিফলিত হয়। বোধ করি, তাহলে শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামগ্রিকভাবেই এ দেশের মানুষের জীবন হয়ে উঠবে অপেক্ষাকৃত আরও সুন্দর। প্রকৃত বিজয় হবে অর্জিত।

চার
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দৃশ্যমান শত্রুপক্ষকে হারিয়ে পাওয়া বিজয়ের সেই মহালগ্ন পেরিয়ে গেছে অর্ধশতাব্দীর বেশি। এখনো যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মহিমার যথাযোগ্য প্রতিফলন জাতীয় জীবনের সব মাধ্যমে ঘটাতে পারিনি, তা সাধারণ বিবেচনা-বুদ্ধিতেই টের পাওয়া যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন কারণ; সে অন্য প্রসঙ্গ! তবু বলি, কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতায় ছুড়ে দিয়েছেন যে গভীরবোধী জিজ্ঞাসা, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/ বলছে কি তা বাংলাদেশ?’—এর উত্তর বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে কী দেব আমরা? বোধ করি, এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় ফুরিয়ে যায়নি। আর, শুধু ভাবলেই চলবে না; বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের অবদান ও আত্মত্যাগ যেন আমাদের অপরাধবোধে না ভোগায়, তাই নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় শাণিত করে দেশ গড়ায় অবদান রাখা প্রত্যেকের জন্যই বাঞ্ছনীয়। তবেই মিলবে বিজয়ের প্রকৃত সুবাস।

পাঁচ
নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর ও সংগীতে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া সেই গান, চলুন, আবারও গুনগুনিয়ে গাই—‘সবক’টা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান/ ওরা আসবেই চুপি চুপি/ যারা এ দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ…’।
বিজয়ের মহিমা ছড়িয়ে পড়ুক সবার জীবনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top