পাতে পরিমিতি I স্বাস্থ্যকর সাহ্রী
রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের মাস পবিত্র মাহে রমজান। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান সারা বছর এ মাসের অপেক্ষায় থাকেন। ধর্মীয় দিক বিবেচনা করলে এই মাস যেমন ফজিলতে পূর্ণ, তেমনি স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায়ও এর গুরুত্ব অনেক। রোজায় স্বাস্থ্যকর সাহ্রী কেমন হতে পারে—রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
রোজার মাসে রোজাদাররা সাধারণত অন্যান্য সময়ের তুলনায় একটু ভিন্ন রকমের খাওয়া-দাওয়া করেন। হঠাৎ করে খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলের পরিবর্তনের কারণে বিশেষত সাহ্রীতে যদি সঠিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ আহার গ্রহণ করা না হয়, দেখা দিতে পারে নানা শারীরিক জটিলতা।
রোজা মানেই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা। সারা দিন সংযমশীল থেকে শরীর সুস্থ রাখার জন্য সাহ্রীতে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। এ সময়ে খাদ্যতালিকায় থাকা চাই এ ধরনের পুষ্টি উপাদান—
কার্বোহাইড্রেট: সাহ্রীতে কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবার অবশ্যই রাখা চাই। মনে রাখতে হবে, কার্বোহাইড্রেট আমাদের শরীরে শক্তি জোগানের প্রধান উৎস। অনেকে ডায়েট ফলো করতে গিয়ে সাহ্রীতে কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবারগুলো সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেন। যার ফলে সারা দিনে যে পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন, তা পূরণ না হওয়ায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তাই সাহ্রীতে অবশ্যই রাখা চাই ভাত, রুটি, ওটসের মতো কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার।
প্রোটিন: আমাদের মাসল ঠিক রাখার জন্য প্রোটিনের অভাব যেন দেহে না ঘটে, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তাই খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে মাছ, মুরগির মাংস কিংবা ডিম।
ফাইবার: একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির খাদ্যতালিকায় সারা দিনে ৪০ থেকে ৪৫ গ্রাম ফাইবার থাকা প্রয়োজন। সাহ্রীতে ফাইবার-জাতীয় খাবার কিছুটা রাখলে সারা দিনে অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগার সম্ভাবনা কমে যাবে। এ ছাড়া খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পানি ও ডায়েটারি ফাইবার না থাকলে কনস্টিপেশনের ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে খেতে পারেন সবজি, ফল ইত্যাদি।
পানি: রোজা রাখায় পানির ঘাটতিতে দেখা দিতে পারে ডিহাইড্রেশন, ইউরিনারি ট্র্যাকট ইনফেকশনসহ বিবিধ শারীরিক সমস্যা। এসব থেকে রেহাই পেতে সাহ্রীতে পর্যাপ্ত পানি ও পানিজাতীয় খাবার রাখা শ্রেয়। যেমন জুস, দুধ এবং ঘরে তৈরি স্যুপ ইত্যাদি।
শরীর সুস্থ ও সবল রাখতে খাদ্যের বিকল্প নেই। আর রোজা মানেই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণ বন্ধ রাখা। তাই সাহ্রীতে এমন খাবার বেছে নেওয়া ভালো, যেগুলো সহজপাচ্য ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন। ভারী খাবার যেমন ভাত-তরকারি গ্রহণের বদলে সফট বা কোনো তরল খাবার দিয়ে সাহ্রী সারার প্রবণতা রয়েছে কারও কারও। যেমন স্যুপ। চাইলে একে হেলদি ওয়েতে একটি ব্যালেন্স ফুডে রূপান্তর করতে পারেন সামান্য ওটস যোগ করে। তরল খাবার যারা খেতে চান, তারা মুরগির ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে ২ টেবিল চামচ ওটস মিশিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন সফট ভেজিটেবল স্যুপ। এতে হালকা খাবারেই মিলে যাবে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন।
সাহ্রীতে দুধ খেতে যারা পছন্দ করেন, তারা দু-তিনটি খেজুর কিংবা যথেষ্ট পরিমাণ ডালিম যোগে এটিকে আরও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে পারেন। অন্যদিকে, খাবার গ্রহণের পর ইয়োগার্ট সব সময়ই স্বাস্থ্যবান্ধব। সে ক্ষেত্রে সাহ্রীর পর তিন-চার টেবিল চামচ ইয়োগার্ট খেতে পারেন। এ ছাড়া চিকেন কারি বা ফিশকারিতেও ইয়োগার্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
সুস্থ থাকতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত আহারের যেহেতু বিকল্প নেই, তাই সাহ্রীর খাবারে রাখতে পারেন এই রেসিপিগুলো—
চিকেন এগ পিশপাশ: চাল আর ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়িই পিশপাশ। প্রোটিনের সব অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায় এই ধরনের খাবার গ্রহণের মাধ্যমে। আর এতে চিকেন ও এগ যোগ করায় দারুণ এক প্রোটিন রিচ সাহ্রী মেনু তৈরি হয়ে যায়।
লাউয়ের কারি: পানিবহুল সবজি হিসেবে লাউ সব সময় সেরা। এটি খুব সফট সবজি হিসেবে গণ্য। লাউয়ের কারি সাধারণত কারোরই বদহজম হয় না; বরং পেট ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। তবে খেয়াল রাখা চাই, ঝাল মসলা যেন যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা হয়। সাহ্রীতে লাউয়ের কারি গ্রহণের মাধ্যমে ক্যালরি ব্যালান্সের পাশাপাশি সারা দিনে বেশ আরাম বোধ করার সম্ভাবনা বাড়ে।
সফট ফিশকারি: শোল, শিং, পাবদা—এ ধরনের মাছের কারি বা পাতলা ঝোল সাহ্রীতে রাখা যেতে পারে। এগুলো সফট ফাইবার হওয়ায় খুব দ্রুত বডিতে অ্যাডজাস্ট হতে সাহায্য করে। অবশ্যই খেয়াল রাখা চাই, মসলা যেন পুড়ে না যায়; আবার অতিরিক্ত মসলাও ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের সফট ফিশকারিতে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও নিউট্রিয়েন্ট পাওয়া সম্ভব।
লেন্টিল মিক্সড ভেজিটেবিল: সাহ্রীতে যারা অনেক বেশি খাবার গ্রহণে অপারগ থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে ভেজিটেবলের মধ্যে ডাল মিশিয়ে নিলেই প্রোটিনসমৃদ্ধ দারুণ ডিশ পাওয়া সম্ভব। এটি সারা দিনের প্রোটিন ও ভিটামিন মিনারেলসের ঘাটতি থেকে শরীরকে রক্ষা করবে।
সাহ্রী গ্রহণেই ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা ভালো—
অনেকে সাহ্রীর সময় বাইরে বা রেস্টুরেন্টে খাবার গ্রহণ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু মনে রাখা চাই, সুস্থ থাকতে হলে বাইরের খাবার এড়িয়ে চলার কিংবা কম গ্রহণ করার পরামর্শ পুষ্টিবিদেরা দিয়ে থাকেন। কেননা, এ ধরনের খাবার সাধারণত স্বাস্থ্যকর নয়।
বাইরের বা রেস্টুরেন্টের খাবারগুলোতে সাধারণত অতিরিক্ত মসলা এবং পুরোনো তেল ব্যবহার করায় এ ধরনের খাবার গ্রহণের পর অনেকে সারা দিন অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেন। তাই সাহ্রীতে বাড়িতে তৈরি সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করাই উত্তম।
সাহ্রীতে আরও একটি অভ্যাস রয়েছে কারও কারও, যা স্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। এ ছাড়া এই অভ্যাসের কারণে সারা দিন শরীর ডিহাইড্রেট থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়। বলছি চা কিংবা কফি পানের কথা। এ ধরনের ক্যাফেইন সাহ্রীতে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকাই মঙ্গল।
মোটকথা, সুস্থ থাকতে হলে বছরের অন্য দিনগুলোতে যেমন খাবারের বিষয়ে সচেতন থাকা চাই, রোজায়ও তা জরুরি। আর সাহ্রী বা ইফতার যা-ই হোক না কেন, খাদ্যাভ্যাস সঠিক থাকলে পুরো রমজানে অতিরিক্ত কষ্ট থেকে লাঘব পাওয়া সম্ভব।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট