রসনাবিলাস I পয়সা উশুলের মুন্নু টি-রুম
মুন্নু সিরামিকসের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া বাহুল্য। ৩৯ বছরের লিগ্যাসি ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই তাদের টি-রুমের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করার সাহস বা ইচ্ছে—কোনোটাই ছিল না। অগত্যা খাইয়ের দল এবারে উত্তরায়, মুন্নু টি-রুমে। বিস্তারিত আল মারুফ রাসেলের লেখায়
বসন্তের এক প্রাণ আইঢাই করা দুপুরে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের মুন্নু সিরামিকসের শোরুমে ঢুকে পড়লাম আমরা। নিচতলায় দারুণ সব ডিজাইনের মগ, কাপ, পিরিচ, প্লেট—মোদ্দাকথা, যা যা তৈজসপত্র লাগে খাবারঘরে, সবই রয়েছে; আর ঘর সাজানোর উপকরণ তো রয়েছেই। তবে আমাদের গন্তব্য দোতলা। সেখানেই টি-রুমের অবস্থান।
দোতলার কাচের দরজা খুলতেই নাক বরাবর চোখে পড়ে সারি সারি সিরামিকের জিনিসপত্র। অন্দরসজ্জায় বাহুল্যবর্জিত সৌন্দর্য। সেখানে একটি টেবিল রাখা, আর ছয়টি চেয়ার। ডানে এগিয়ে গেলে কফি ও ফুড কাউন্টার। কিচেন ছাড়া মূলত চারটি ঘর এখানে; একটি মিটিং রুম, আর বাকিগুলোতে বেশ কোজি ও কম্ফি পরিবেশে আড্ডা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। দেয়াল, মেঝে, ছাদে সাদা আর ক্রিম রঙের খেলা। সঙ্গে চমৎকার বৈপরীত্য এনে দিয়েছে গাঢ় রঙের টেবিল ও চেয়ার। সিলিং থেকে গাদাখানিক হলদে স্পট লাইট তো রয়েছেই, সঙ্গে বেশ চমৎকারভাবে চায়ের কেটলির আকৃতির ল্যাম্পশেডও। দেয়ালে শেলফে রয়েছে সিরামিকের সব জিনিস। এক জায়গায় তো রীতিমতো চিত্রকর্মের মতো করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে থালা-বাটি, কাপ, পিরিচ ইত্যাদি। ইন্টেরিয়রের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ আয়না। কৃত্রিম জানালার কপাটও রয়েছে এক জায়গায়। গ্লাস ওয়ালের কারণে আলোর অভাব নেই ভেতরে। আপাতত ৪০ জনের বসার ব্যবস্থা এখানে। রয়েছে স্মোকিং জোনও।
ডাবল শট এসপ্রেসো দিয়ে তৈরি আইসড আমেরিকানোয় চুমুক দিতে দিতে অপারেশনস এক্সিকিউটিভ ফাহিম শাহরিয়ার ইশান বললেন এই টি-রুমের গল্প। এর যাত্রা শুরু ২০২১ সালে। শুরুতে নিজেরা খাবার তৈরি না করলেও ২০২২ সাল থেকে এখানেই তা তৈরি হচ্ছে। আর মেনুতেও রয়েছে বৈচিত্র্যময় খাবার। কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে আবারও কফিতে বুঁদ হলাম আমরা। তিনি আরও টি-রুমের কনসেপ্ট নিয়ে জানালেন, মুন্নু সিরামিকস বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টে প্রয়োজনীয় ক্রোকারিজ সরবরাহ করে। তাহলে কেন নিজেদের একটা হবে না? নানা ধরনের ক্রোকারিজের ব্যবহারে এটি একটি এক্সপেরিয়েন্স সেন্টারও হতে পারে ক্রেতাদের জন্য।
এরপর একে একে খাবার আসতে থাকল। প্রথমেই এলো চিকেন মোমো, ডাম্পলিং সসের সঙ্গে। অবশ্য মোমো সস ঢাকার কোথাও আর দেখা যায় না। তিব্বতি এই খাবারকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। হালের ক্রেজ, ফুটপাত থেকে বড় রেস্টুরেন্ট—সবখানেই এর জয়জয়কার। এখানে অবশ্য কেবল ভাপে তৈরি হয়; ফ্রাইড মোমোর অপশন আপাতত নেই। এখানে আলাদা করে অবশ্যই বলতে হয় এর ভেতরের পুরের কথা; মাংসের পরিমাণ যেকোনো জায়গার চেয়ে তুলনামূলক বেশি, তাই মুখে গেলে সেটি যে স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটায়, তা আর বলতে হয় না!
এরপর এলো গ্রিলড চিকেন অ্যান্ড অ্যাপল স্যান্ডউইচ। পাস্তারামি চিকেনের সঙ্গে গ্রিন অ্যাপলের সঙ্গত দারুণ জমেছিল। এ ধরনের কম্বিনেশনের স্যান্ডউইচ ঢাকা শহরের রেস্টুরেন্টগুলোতে সচরাচর চোখে পড়ে না। তার ওপরে আবার ব্রাউন ব্রেডের গ্রেইনি ভাব। কালো গোলমরিচ আর লবণ মাখিয়ে স্মোকড ফ্লেভার দেওয়া হয় পাস্তারামি বানাতে; ফলে দারুণ এক স্বাদ থাকে, সেই সঙ্গে মাংসটা রাখা হয় রসাল। সঙ্গে যখন ক্যারামেলাইজড গ্রিন অ্যাপল, ডিজন মাস্টার্ড আর মেয়ো সস যোগ হয়, তখন এই স্যান্ডউইচ রীতিমতো দেবভোগ্য হয়ে ওঠে! একে সঙ্গ দিয়েছিল টমেটো সস আর পটেটো চিপস। অবশ্য এই স্যান্ডউইচ অর্ডার করতে গিয়ে খানিক দ্বিধায় পড়তে হয়েছিল। কারণ, স্মোকড ফিশ অ্যান্ড ইয়োগার্ট, রোস্ট বিফ অ্যান্ড হর্সর্যাডিশ স্যান্ডউইচও ছিল তালিকায়। নিঃসন্দেহে সব কটিই বেশ ইউনিক; তবে ভোটাভুটিতে গ্রিলড চিকেন অ্যান্ড অ্যাপল স্যান্ডউইচই জয়ী হলো। অবশ্য অন্য দুটোর স্বাদ নিতে যেতে হবে জলদিই।
এরপর টেবিলে এসেছিল চিকেন ফ্রাঞ্চেসে। ফ্রাঞ্চেসে শব্দটি ইতালীয়; ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি বোঝাতে তারা এটি ব্যবহার করে। অর্থাৎ ইতালিতে মুরগির এই ফরাসি পদ যেভাবে রাঁধে, সেভাবেই পরিবেশিত হয় এটি। ফালি ফালি করে কাটা মুরগির হাড়বিহীন বুকের মাংস, ইতালীয় হার্বস, বাহো ব্লং বা লেমন বাটার সসে জারিত হয়ে সঁতে করা মাশরুম ও ক্যাপসিকাম আর ম্যাশ পটেটোর সঙ্গে এসেছিল। অবশ্য সাইডস হিসেবে আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল রাইস। লেমন বাটার সস দারুণ, মুরগিতে হার্বসগুলো বেশ ভালোভাবে মিশে গিয়েছিল; পুরোই স্বর্গীয় ধরনের একটি খাবার! সঁতে করা মাশরুম আর ক্যাপসিকাম এক্কেবারে নিখুঁত। ক্যাপসিকামের মুচমুচে ভাব আর রসাল মাশরুমে পারফেক্টলি মিশে গিয়েছিল রসুন আর গোলমরিচ। পাশে ম্যাশ পটেটোটাও বেশ ক্রিমি ছিল। সঙ্গে অ্যাড অন করে নেওয়া ভেজিটেবল ফ্রাইড রাইসের স্বাদও ভালো ছিল। একটি কথা বলে রাখা ভালো, এই অ্যাড অন করে নিলে, তাদের এই এক সার্ভিংয়ে মোটামুটিভাবে দুজনের পেটপুজো হতে পারে, এতটাই বড় মুরগির আকার। অনায়াসে ডিস্টিংকশন মার্ক পাবে এই খাবার।
পরের খাবার হিসেবে এলো লেমন বাটার ফিশ। প্যান ফ্রাইড বাসা ফিলে, লেমন বাটার সস আর কিছু স্লাইস করা আলু। লেমন বাটার সস যেকোনো মাছ বা হোয়াইট মিটে পড়লে যে জাদুকরী স্বাদ তৈরি হয়, তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়; বরং বলা ভালো—যে খায়নি, সে জানেনি।
তালিকায় শেষ খাবার হিসেবে হাজির হয়েছিল সি ফুড স্প্যাগেটি। এতে অনেকখানি টুইস্ট আছে। সাধারণত যে ধরনের সি ফুড পাস্তা খেয়ে আমরা অভ্যস্ত, এটি তার চেয়ে খানিক ভিন্ন। মারিনারা সসের সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিলি সস। ফলে পাস্তা থেকে সি ফুডের যে র অ্যারোমা থাকে, সেটি অনেকটাই অনুপস্থিত। অবশ্য এর কারণ জানালেন শেফ নিজে এসে। আমাদের মতো খুশখানেওলারা যে গন্ধটার অনুপস্থিতিতে কাতর হয়েছি, সেটি উত্তরার মানুষ ঠিক সয়ে নিতে পারেনি। এই স্বাদ এসেছে মূলত আশপাশে যারা নিয়মিত খেতে আসেন, তাদের পরামর্শেই। শেফ জানালেন, অর্ডারের সময় বলে দিলে তারা ফিউশনের বদলে অথেনটিক সি ফুড পাস্তাই পরিবেশন করেন। অবশ্য ঝাল খেতে যারা পছন্দ করেন, তারা এটি নির্ঘাত পছন্দ করবেন। কাঁকড়া, চিংড়ি, স্কুইড আর মারিনারা সসে যে ফিউশন তৈরি করে চিলি সস, সেটিকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।
শেষ পাতে কেক নেব, না অন্য কিছু—এই চিন্তার সময়েই ইশান জানালেন তাদের চকলেট কার্ডামম ক্যারামেল কেক নাকি দুর্দান্ত। এদিকে খাওয়া শেষে একটু কফি নেব কি না, সে চিন্তাও চলছিল। পরে অবশ্য ভেটো দিলেন সঙ্গী বিখ্যাত শেফ ও খুশখানেওলা সজীব মোহাম্মাদ—‘টি-রুমে এসে চা হবে না? তা হবে না, তা হবে না!’ অগত্যা চমৎকার দুই টি-পট ভরে দুই পদের চা এলো। রোজ-লিচি হোয়াইট টি আর সিগনেচার মিল্ক টি। দারুণ নকশাদার কাপে সেটায় চুমুক দিয়ে শেষ করলাম এবারের খাদ্যাভিযান। তবে শেষ কথায় বলতে হয়, এখানকার খাবার বেজায় সস্তা, অন্তত ধানমন্ডি আর বনানী-গুলশানের রেস্টুরেন্টের তুলনায়। তাই ঢুঁ মারা যেতেই পারে এই পয়সা উশুলের মুন্নু টি-রুমে।
ঠিকানা: বাড়ি ২৯, সেক্টর ৭, সোনারগাঁও জনপথ সড়ক, উত্তরা, ঢাকা।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম: monnotearoom।
ছবি: লেখক