ট্রিবিউট I স্মৃতির শাফিন
শাফিন আহমেদ। কিংবদন্তি রকস্টার। ‘মাইলস’-এর সাবেক ভোকাল ও বেজিস্ট। বাংলাদেশ সময় গত ২৫ জুলাই ২০২৪, সকালে, ৬৩ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে প্রয়াত হয়েছেন। তার স্মৃতিচারণা করেছেন ‘শিরোনামহীন’-এর ব্যান্ড লিডার ও বেজিস্ট জিয়াউর রহমান
আমরা সব সময় একজন রোল মডেল খুঁজি। শাফিন আহমেদ আমার কাছে তেমনই একজন। তাকে অনুসরণ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের অনেক মিউজিশিয়ান। ১৯৯১ সালে আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিই, তখন প্রকাশ পায় মাইলসের প্রথম বাংলা অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’। পরবর্তীকালে কলেজের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ওই অ্যালবামের, শাফিনের কণ্ঠের ‘গুঞ্জন শুনি’, ‘সুপ্ত বাসনা’ গানগুলোতে বুঁদ হয়ে ছিলাম দিনের পর দিন। এর আগে প্রকাশ পাওয়া মাইলসের ইংরেজি অ্যালবামগুলো আমার শোনা ছিল। তবে আজম খান, সোলসের মতো সদস্যরা বাংলা গান করার জন্য তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। অবশ্য মাইলসের গানের কম্পোজিশনে পরিপক্বতা ছিল অন্য রকম, যা হৃৎস্পন্দনে দোলা দিয়ে যেত। এসব কারণেই এই ব্যান্ডের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকে এলআরবি, ফিলিংস (বর্তমানে নগর বাউল), ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটার গানে ডুবে থাকতাম।
আমি ছিলাম মেটাল গানের ভক্ত। ফলে ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটার প্রতি অন্য রকম ভালো লাগা ছিল। একই কারণে আয়রন মেইডেন, মেটালিকা, মেগাডেথ, সেপালটুরা, স্লেয়ার ছিল আমার পছন্দের ব্যান্ড। তবু ক্যাসেটের যুগে আমার প্লে-লিস্ট থেকে পপ-রক ব্যান্ড মাইলস কখনো বাদ পড়েনি। এর পেছনে অনেক কারণের একটি—শাফিন আহমেদ। মাইলস শুনতে ভালো লাগে, যা কানের জন্য বেশ আরামদায়ক, এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশ নেই।
মেটাল জনরার বাইরে ইংরেজি ভাষাভাষী ব্যান্ডগুলোর মধ্যে পিংক ফ্লয়েড, ডায়ার স্ট্রেইটস ভালো লাগত। পপ-রক জনরায় নাজারেথ ছিল দারুণ পছন্দের। ছোটবেলা থেকেই ইনস্ট্রুমেন্টের মধ্যে আমি বেজ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। অদ্ভুতভাবে নাজারেথের বেজ লাইনের সঙ্গে বাংলাদেশে একমাত্র শাফিনের বেজ লাইনের সাদৃশ্য পেতাম। এই বেজ লাইনগুলো গ্রুভ প্লে করে ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়। এর থেকে বাইরে গিয়ে, একধাপ এগোনো একটা এক্স-ফ্যাক্টর আছে এই ধরনের প্লেয়িংয়ে; উল্টো বাজার মতো একটা ব্যাপার আছে। এ ধরনের প্লেয়িং করে কীভাবে গান গাইতেন শাফিন, আমার কাছে তা একধরনের রহস্য।
এমনিতেই বেজ বাজিয়ে গান গাওয়া কঠিন; কিন্তু শাফিন যা করতেন, তা ছিল সর্বোচ্চ কঠিন। অর্থাৎ তিনি উল্টো বাজিয়ে গানও উল্টো গাইতেন। গান তিনি যে কোয়ান্টাইজে গাইতেন, বেজ বাজাতেন উল্টো কোয়ান্টাইজে—এটা ভয়ানক কঠিন! যেমন আমি মেগাডেথের ডেভ মাস্টেইনের বড় ভক্ত, এই ভদ্রলোক রিফ বাজিয়ে গান গাইতেন। সাধারণত রিফ বাজিয়ে গান গাওয়া সহজ হলেও ডেভ মাস্টেইনের বাজানো রিফের সঙ্গে গায়কির কোয়ান্টাইজেশন বেশ কঠিন। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, শাফিন আহমেদের মতো মিউজিশিয়ানদের গ্রেটনেস শুধু স্কিলের ওপর নির্ভর করে হতে হবে, তেমনটি নয়। নির্দিষ্ট স্কিলের পর বাকিটা নির্ভর করে মেলোডি সেন্স, সেনসিবিলিটি, পরিমিতিবোধের ওপর। এসব বিবেচনায় শাফিন আহমেদ বাংলাদেশের রক মিউজিক ইতিহাসের অন্যতম সেরা বেজিস্ট; গান গাওয়ার ক্ষেত্রেও তা-ই।
আমার মতে, বাংলাদেশি কিছু ব্যান্ড অ্যালবামের সব গানই অনন্য। ফিলিংস, ওয়ারফেজ, আর্টসেলের মতো মাইলস এ রকমই একটি গ্রুপ। মাইলসের গানের মান এত উচ্চ মানের, যার কোনোটি বাদ দিয়ে অ্যালবাম শোনা শেষ করা যেত না। এর নেপথ্যে মানাম আহমেদের কম্পোজিশন স্কিলের কথা বলতেই হবে। এরপর শাফিন আহমেদের গায়কি ও উপস্থাপনার কথা। হামিন আহমেদ, তূর্য, জুয়েল—এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একধরনের ম্যাজিক ক্রিয়েট হতো। একজন প্রেজেন্টার হিসেবে শাফিনের স্টাইল, ফ্যাশন সেন্স অনবদ্য। শ্রোতা হিসেবে, মিউজিশিয়ান হিসেবে তার কাছ থেকে যা পেয়েছি, তা অনেক। শাফিনসহ মাইলসকে স্টেজে দেখলে মনে হতো স্করপিয়ন্সের মতো আন্তর্জাতিকভাবে দাপুটে, পাশ্চাত্যের কোনো ব্যান্ড দাঁড়িয়ে আছে। তাকে শ্রদ্ধা জানাই আমাদের সমৃদ্ধ করার জন্য।
শাফিন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ২০০০ সালে। আমরা শিরোনামহীন ছিলাম একটি রক মিউজিক কম্পিটিশনে অংশগ্রহণকারী; তিনি ছিলেন জুরিবোর্ডের সদস্য। গ্রিনরুমে তার সঙ্গে দেখা হলেও সেবার তেমন কথাবার্তা হয়নি। তবে ২০০৮ সালে শিরোনামহীন বামবার (বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন) সদস্যপদ পেলে তিনি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ‘ওয়েলকাম অন বোর্ড’ বলে কিছু গাইডলাইনও দিয়েছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি আমার অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে অনেকবার অনেকভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। (ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি ‘শাফিন ভাই’ বলে ডাকতাম।) মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও বসুন্ধরায় অবস্থিত ফানক্যাডেলিক প্র্যাকটিস প্যাডে দেখা হয়েছিল। খুব অল্প কথা বলেই প্যাডে ঢুকে গিয়েছিলেন এবং সেটি এই কিংবদন্তির সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এ ছাড়া উপস্থাপক হয়ে শাফিন আহমেদ আমাকে একটি টক শোতে ডেকেছিলেন। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। মেজাজ খুব সুন্দরভাবে সামলাতে পারতেন তিনি; খুব কম্পোজড থাকতেন। আবেগের পাশাপাশি যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করতে পারতেন।
শাফিন আহমেদ বেড়ে উঠেছেন কিংবদন্তিদের সংস্পর্শে। বাবা কমল দাশগুপ্ত ও মা ফিরোজা বেগম। নজরুলসংগীতের অনেক সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত, যেটি হয়তো আমরা অনেকে জানি না। যার বেশির ভাগ গেয়েছেন ফিরোজা বেগম। কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত গান নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন উপস্থাপক, ব্যবসায়ী ও সাবেক মেয়র আনিসুল হক। সেই অনুষ্ঠানে শাফিন আহমেদ একটি গান গেয়েছিলেন। আমার বয়স তখন খুব কম। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই গান কিন্তু নজরুলসংগীত ছিল না। ব্যান্ড সংগীতের বাইরেও শাফিন আহমেদের ছিল দুর্দান্ত পদচারণা।
শাফিন আহমেদের মতো কিংবদন্তিরা মৃত্যুতে বিলীন হয়ে যান না। সৃষ্টিকর্মে বেঁচে থাকবেন তিনি। ঘুরেফিরে আসবেন যুগের পর যুগ।
অনুলিখন: ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সংগ্রহ