
ফিচার I শুষ্কতায় শিশিরসিক্ত
পুরোটাই মেকআপের মুনশিয়ানা। তবে জানতে হবে ফর্মুলা—কোনটা বেশি জুতসই। ব্যবহারের কৌশলও কিন্তু চাই
অনেকের জন্য শুষ্ক ত্বক এমন এক সমস্যা শুধু শীতে নয়, বরং বছরজুড়ে। আর তা মেকআপ করার সময় আরও বেশি প্রকট হতে পারে। এমন ত্বকে মেকআপ প্রয়োগে ফ্লেকি ত্বক বা প্যাচি কভারেজের মতো সমস্যাগুলো প্রায়ই দেখা দিতে পারে। তখন মেকআপ মেখে ত্বক শিশিরসিক্ত দেখানো পরিণত হয় সংগ্রামে। সঠিক স্কিন কেয়ার রুটিন আর মেকআপ প্রয়োগের সঠিক কৌশলে শুষ্ক ত্বকেও ডিউই ফিনিশ দেওয়া সম্ভব।
সঠিক স্কিন কেয়ার
মেকআপ করার আগে, শুষ্ক ত্বকের জন্য সঠিক স্কিন কেয়ার রুটিন জরুরি। এটা ত্বককে মেকআপের জন্য প্রস্তুত করবে; আর সঠিক পণ্য বেছে নেওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেলিব্রিটি মেকআপ আর্টিস্ট ক্রিস্টেন আর্নেটের মতে, মৃদু ক্লিনজার, হাইড্রেটিং টোনার এবং এমন ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত, যা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে। অর্থাৎ এখানে লক্ষ্য হলো, ত্বককে ভালোভাবে হাইড্রেট করা এবং মেকআপের জন্য মসৃণ একটা বেস তৈরি করা।
হাইড্রেটিং ক্লিনজার
স্কিন কেয়ার রুটিন শুরু করার জন্য ব্যবহৃত পণ্য এটি; যা ত্বকের প্রাকৃতিক তেল ধুয়ে ফেলবে না। সোডিয়াম লরাইল সালফেট বা সোডিয়াম লরেথ সালফেট সংবলিত ক্লিনজার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। কারণ, এগুলো ত্বকের জন্য রুক্ষ প্রমাণিত হতে পারে, যা শুষ্কতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। এর পরিবর্তে বেছে নেওয়া যেতে পারে লরাইল গ্লুকোসাইড বা কোকো গ্লুকোসাইডের মতো নরম উপাদানযুক্ত ক্লিনজার। এই উপাদানগুলো মৃদু এবং ত্বককে কোনো রকম শুষ্ক অনুভূতি ছাড়া পরিষ্কার রাখে।
এনজাইম পিল এক্সফোলিয়েশন
শুষ্ক ত্বকের জন্য এক্সফোলিয়েশন আসলেই জরুরি। কারণ, এটা ত্বকে জমে থাকা মৃতকোষগুলো সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। ফলে মেকআপ সহজে বসে। কিন্তু এক্সফোলিয়েন্টটি যেন ত্বকে রুক্ষতা তৈরি না করে, সেটা খেয়াল রাখা জরুরি। এনজাইম পিল বেশ ভালো অপশন; মৃদুভাবে ত্বক পরিষ্কার করে। আর এনজাইম পিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্ক্রাবিংয়ের ঝামেলাও নেই, কাজ হয়ে যাবে সহজে!
হাইড্রেটিং টোনার
ক্লিনজিংয়ের পর একটি হাইড্রেটিং টোনার ব্যবহার করা যেতে পারে; যা ত্বকে আরও আর্দ্রতা জোগাবে। এমন টোনার বেছে নেওয়া শ্রেয়; যা অ্যালো পি এক্সট্র্যাক্টের মতো হালকা উপাদানগুলো দিয়ে তৈরি। এগুলো শুধু আর্দ্রতাই দেয় না, বরং শুষ্ক ত্বকে একটা আরামদায়ক অনুভূতি তৈরিতে সাহায্য করে।
আই ক্রিম
চোখের চারপাশের ত্বক তুলনামূলকভাবে পাতলা ও শুষ্ক হওয়ার ফলে সহজে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। তাই ত্বকের এই অংশটুকু হাইড্রেট করাও গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি আই ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে হায়ালুরনিক অ্যাসিড বা পেপটাইড থাকে, যা আর্দ্রতা বাড়ায় এবং সূক্ষ্ম রেখাগুলোর উপস্থিতি কমায়। এ ছাড়া এটি আই মেকআপের জন্য একটি মসৃণ বেস তৈরির পাশাপাশি মেকআপ ক্রিজিং থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
উপযুক্ত ময়শ্চারাইজার
ময়শ্চারাইজার এ ধরনের ত্বকের স্কিন কেয়ার রুটিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি ময়শ্চারাইজার নির্বাচন করা যেতে পারে, যা হায়ালুরনিক অ্যাসিড, গ্লিসারিন, শিয়া বাটার বা অ্যালোভেরার মতো উপাদানে সমৃদ্ধ। এগুলো ত্বকে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ত্বকের প্রাকৃতিক অয়েল বা মিনারেল যাতে হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করার সময় বিশেষ করে সেসব জায়গা; যেমন গালের পাশ বা মুখের চারপাশ সহজে রুক্ষ হয়ে যেতে পারে, সেখানে একটু পুরু করে মাখতে হবে, যেন ত্বক পুরোপুরি মসৃণ আর হাইড্রেটেড থাকে!
লিপ বাম
স্কিন কেয়ারের সময় ঠোঁটকে ভুলে গেলে চলবে না! শুষ্ক আর ফাটা ঠোঁট পুরো মেকআপের সৌন্দর্য ভেস্তে দিতে পারে! লিপ স্ক্রাব দিয়ে স্ক্রাব করা যেতে পারে কিংবা একটি লিপ ব্রাশ ব্যবহার করে মৃত ত্বক এক্সফোলিয়েট করে নেওয়া যেতে পারে। লিপ বাম হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে ওয়াক্স, শিয়া বাটার বা জোজোবা তেলের মতো উপাদানে ভরপুর লিপ বাম। এটি মেকআপের নিচেও ঠোঁটের মসৃণতা নিশ্চিত করবে।
শুষ্ক ত্বকে
ত্বক সঠিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ হলো সঠিক মেকআপ পণ্য নির্বাচন করা। এ ক্ষেত্রে এমন ফর্মুলা খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ, যা হাইড্রেটিং এবং ত্বককে ফ্লেকি আর রুক্ষ করে তুলবে না।
ফাউন্ডেশন
শুষ্ক ত্বকের জন্য একটি হাইড্রেটিং ফাউন্ডেশন বেছে নেওয়া যেতে পারে; যা ডিউই বা লুমিনাস ফিনিশ দেয়। ক্রিমি বা লিকুইড ফাউন্ডেশনগুলো এ ক্ষেত্রে থাকতে পারে পছন্দের শীর্ষে। কারণ, এগুলোর হায়ালুরনিক অ্যাসিড, ভিটামিন ই এবং অয়েল বেইজড ফর্মুলা শুষ্ক ত্বকের জন্য আদর্শ। ম্যাট ফিনিশের ফাউন্ডেশনগুলো এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। না হলে এগুলো ত্বকের শুষ্কতা বাড়িয়ে নির্জীব করে তুলতে পারে। কম কভারেজ চাইলে টিনটেড ময়শ্চারাইজার বা বিবি ক্রিম হতে পারে দুর্দান্ত বিকল্প; যা আর্দ্রতা বজায় রাখবে, দেবে ন্যাচারাল ফিনিশ।
কনসিলার
কনসিলার নির্বাচনে একটি ক্রিমি ফর্মুলা বেছে নেওয়া যেতে পারে; যা সূক্ষ্ম রেখা বা ত্বকের শুষ্ক অংশগুলোকে ফুটিয়ে তুলবে না। খুব বেশি ঘন কনসিলার এড়িয়ে চলা জরুরি, যা ত্বককে আরও শুষ্ক করে তুলতে পারে। পরিবর্তে, শিয়া বাটার, গ্লিসারিন বা পেপটাইড যুক্ত লাইটওয়েট কনসিলার বেছে নেওয়া যেতে পারে। এই উপাদানগুলো শুধু দাগ ঢেকে রাখে না; ত্বকেও হাইড্রেট করে। কনসিলার যতটা সম্ভব পাতলা প্রলেপে প্রয়োগ করলে এটি মেকআপকে খুব বেশি ভারী করে তুলবে। ক্রিজ তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে না।
ব্লাশ ব্রোঞ্জার এবং হাইলাইটার
শুষ্ক ত্বকের জন্য ক্রিম ব্লাশ ও ব্রোঞ্জার অপরিহার্য। এই ফর্মুলাগুলো পাউডার প্রোডাক্টের তুলনায় অনেক বেশি নমনীয় এবং ত্বকে মসৃণ, হাইড্রেটেড ফিনিশ তৈরিতে সহায়ক। খুব সহজে ত্বকে মিশে যায় আর একটা প্রাকৃতিক গ্লো তৈরি করে। হাইলাইটারের ক্ষেত্রে, ক্রিম বা লিকুইড ফর্মুলা বেছে নেওয়া যেতে পারে; যা মেকআপে একটি ডিউই, গ্লোয়িং ফিনিশ দেয়। পাউডার হাইলাইটারগুলো এড়িয়ে চলাই উত্তম; কারণ, এগুলো শুষ্ক ত্বকে বসে যাওয়াসহ প্যাচি লুক তৈরি করতে পারে।
আইশ্যাডো
আইশ্যাডোর ক্ষেত্রে লিকুইড ফর্মুলা শুষ্ক ত্বকের জন্য আদর্শ। ক্রিম আইশ্যাডো মসৃণ ও হাইড্রেটেড ফিনিশ দেয়। নমনীয় ফর্মুলার হওয়ায় এগুলো আইলিডে চিরস্থায়ী লাইন বা ক্রিজ তৈরি করে না।
লিপস্টিক
শুষ্ক ঠোঁটের জন্য, ম্যাট লিপস্টিকগুলো পরিহার করা জরুরি। এগুলো ঠোঁটকে আরও শুষ্ক করে তোলে। পরিবর্তে, ঠোঁটকে ময়শ্চারাইজ করে এমন লিপস্টিক, টিনটেড লিপ বাম বা লিপ গ্লস বেছে নেওয়া যেতে পারে। অ্যালোভেরা, জোজোবা তেল বা শিয়া বাটারসমৃদ্ধ প্রোডাক্ট বেছে নিলেও মন্দ দেখাবে না। এতে করে ঠোঁট মেকআপের নিচেও নরম ও মসৃণ থাকে।
মেকআপ টেকনিক
সব কটি প্রোডাক্ট বেছে নিয়ে এবার মেকআপ করার পালা। বেছে নেওয়া প্রোডাক্টগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হবে, প্রধানত তার ওপরই লুকের ডিউইনেস, হাইড্রেটেড ফিনিশ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবে।
হাইড্রেটিং প্রাইমার
মেকআপ শুরু করা যেতে পারে একটি হাইড্রেটিং প্রাইমার দিয়ে। মসৃণ বেস তৈরি করার জন্য। একটি ভালো প্রাইমার ত্বকে ময়শ্চার ধরে রাখার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনকে ত্বকে সঠিকভাবে বসতে সাহায্য করে। ক্রিমি বা জেলভিত্তিক প্রাইমার ব্যবহার করা যেতে পারে; এতে সারা দিন ত্বক অনেকটা সময় ময়শ্চারাইজড থাকে।
ফাউন্ডেশন অ্যাপ্লিকেশন
ত্বকে ঘষে ঘষে এর প্রয়োগ একটি ভুল পদ্ধতি। একটি পরিষ্কার, ভেজা স্পঞ্জ বা একটি ফাউন্ডেশন ব্রাশ ব্যবহার করে ত্বকে আস্তে আস্তে ট্যাপ করে ফাউন্ডেশন লাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। স্টিপলিং টেকনিক নামে পরিচিত এই পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে ফাউন্ডেশনটি ত্বকে ট্যাপ করে লাগানোর ফলে শুষ্ক স্থানে প্যাচি লুক তৈরি হয় না। দেয় নিখুঁত ফিনিশ।
আরও প্রাকৃতিক, শিশিরসিক্ত লুক চাইলে ফাউন্ডেশনটি একটি ময়শ্চারাইজার বা ফেসিয়াল অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে গ্লোয়ি বেস তৈরি হবে; যা ত্বক আর্দ্র রাখবে এবং একই সময়ে সুন্দর কভারেজ দেবে।
কনসিল
ডার্ক সার্কেল বা ত্বকের দাগ ঢাকতে একটি লাইটওয়েট কনসিলার ব্যবহার করা যেতে পারে; যা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিশে যায়। এক জায়গায় অনেক বেশি কনসিলার না মাখাই ভালো। কারণ, এতে ত্বকের শুষ্ক স্থানগুলো আরও ফুটে উঠতে পারে। তাই শুরুতে একটি পাতলা স্তর প্রয়োগ করে নেওয়া যেতে পারে। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী কভারেজ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। ত্বকের শুষ্ক অংশগুলোতে কনসিলার ঠিকভাবে বসানোর জন্য একটু বাড়তি ময়শ্চারাইজার প্রয়োগ করা যেতে পারে আগেভাগেই।
ক্রিম ব্লাশ অ্যান্ড হাইলাইটার
ক্রিম ব্লাশ শুষ্ক ত্বকের জন্য একটি গেম চেঞ্জার। কারণ, এগুলো ত্বকে সহজে মিশে যায়। ব্লাশ আঙুল বা মেকআপ স্পঞ্জ দিয়ে লাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। মুখের উঁচু জায়গাগুলোতে একটি ক্রিম হাইলাইটার ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো নিমেষে ত্বকে মিশে যায় এবং দেয় প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা মেকআপে বাড়তি কোনো টেক্সচার যোগ না করেই।
মেকআপ সেটিং
সেটিং পাউডার ব্যবহার করা হয় মেকআপ দীর্ঘ সময় ধরে রাখার জন্য। কিন্তু এগুলো ত্বকের শুষ্ক জায়গাগুলোকে আরও ফুটিয়ে তুলতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে হাইড্রেটিং সেটিং স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মেকআপ ধরে রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত আর্দ্রতাও যোগ করবে। অ্যালোভেরা বা গ্লিসারিনের মতো উপাদান থাকলে সবচেয়ে ভালো। এতে ত্বক সারা দিন সতেজ ও হাইড্রেটেড থাকবে।
অনেকের ত্বকের ক্ষেত্রে শুধু সঠিকভাবে মেকআপ প্রয়োগই সর্বশেষ ধাপ নয়; কারও কারও ক্ষেত্রে এই লুক দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে নিতে হতে পারে আরও কিছু পদক্ষেপ।
সারা দিন মেকআপ সতেজ রাখতে এবং ত্বক যাতে শুষ্ক না দেখায়, তা নিশ্চিত করতে একটি হাইড্রেটিং মিস্ট সঙ্গে রাখা যেতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী হালকা স্প্রে করে নেওয়া যেতে পারে।
মুখে বারবার হাত দেওয়া পরিহার করা জরুরি। এতে করে তেল-ময়লা সহজে মুখে স্থানান্তরিত হয়, যা মেকআপকে নিমেষে নষ্ট এবং বাড়তি শুষ্কতা তৈরি করতে পারে ত্বকে।
সারা দিন পর্যাপ্ত পানি পান ত্বককে অভ্যন্তরীণভাবে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে।
মনে রাখা জরুরি, শুষ্ক ত্বকে নিখুঁত মেকআপের গোপন কথা হলো প্রস্তুতি। সঠিক স্কিন কেয়ার রুটিন, মেকআপ প্রোডাক্ট বেছে নেওয়া এবং এগুলোর ঠিকঠাক ব্যবহারের কৌশল জানা থাকলে শুষ্ক ত্বকেও একটি হাইড্রেটেড, ডিউই ফিনিশ পাওয়া সম্ভব।
শিরীন অন্যা
মডেল: এফা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল