এডিটর’স কলাম I সম্প্রীতির সৌন্দর্য
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, সামাজিক সম্পর্কগুলো একতরফা নয়। পৃথিবীতে উদার মানুষের অভাব নেই। তারা আশপাশেই আছেন। আপনার সঙ্গে যেচে আলাপ তারা করতেই পারেন
ধরা যাক, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। হাল ফ্যাশনের পোশাক আর অ্যাকসেসরিজ গায়ে জড়িয়ে, শহরের সেরা বিউটি পার্লার থেকে মেকআপ নিয়ে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে সেখানে হাজির হয়েছেন। সেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ। যাঁরা এসেছেন, সবাই প্রাণোচ্ছল, কেউ মজার মজার কথা বলছেন, কেউ বিভিন্ন বিষয়ে সিরিয়াস আলাপ করছেন, কেউবা কোনো কৌতুক শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। কোনো কোনো অতিথি পূর্বঘনিষ্ঠতার সূত্রে আলাদা হয়ে এক কোণে খোশগল্পে মশগুল। আর আপনি? চুপ করে বসে আছেন একা, দেখছেন সবকিছু; কিন্তু অংশ নিচ্ছেন না কোথাও। যদিও এখানে আপনার অপরিচিত কেউ নেই বললেই চলে। পরিচিতরা আপনার কুশল জানতে চাইছেন, কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার উদ্যোগ করছেন; কিন্তু দু-একটি বাক্যের পর আর এগোচ্ছে না। ফলে একা বসে থাকতে হচ্ছে আপনাকে। এমন নয় যে আপনি কোথাও কখনো কারও সঙ্গে মেশেননি। তা অনিচ্ছায় বা কেবল প্রয়োজনে ঘটেছে, এমনও নয়। কিন্তু বড় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে আপনার এই অবস্থা হয়। আড়ষ্টতা এসে যায় আচরণে। অথচ কত আগ্রহ নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় যান। সবই দেখেন, কিন্তু অংশগ্রহণের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন।
সমাজমনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে কী বলে, আমার জানা নেই। যত দূর বুঝি, মনে হয়, এটা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মতো কোনো সমস্যা। এর সঙ্গে রয়েছে শৈশবে পাওয়া পরিবেশের সম্পর্ক। কারও কাছ থেকে আকস্মিক দুঃখ পেলে এমন হতে পারে। আত্মদম্ভ বা হীনম্মন্যতা থেকেও হয়ে থাকে।
যে কারণেই ঘটুক না কেন, সামাজিক জীবনে এটি প্রীতিকর নয়। যত সাজগোজ করুন, দামি পোশাক আর গয়না জড়িয়ে হাজির হোন অনুষ্ঠানে, আপনার এই সৌন্দর্য ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থহীন, যতক্ষণ নিজের উপস্থিতি অন্যদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে উঠছে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যত ব্যস্ততা থাকুক না কেন, আমরা সামাজিক জীব। সমাজে যার যত বেশি শেয়ারিং, সে তত সামাজিক; তার ব্যক্তিত্বের দীপ্তিও তত দূর পৌঁছায়। এমন নয় যে, এ জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। যে মানুষটি আপনার ভেতর থেকে নিজেকে প্রাণময় আর সুন্দর করে মেলে ধরতে চাইছে, জনসমাগমে এসে তাকে মুক্ত করে দিলেই দেখবেন, জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। এমনকি যে সাজ নিয়ে এসেছেন, আপনার সৌন্দর্য সব জড়তা ভেঙে তাকে অতিক্রম করেছে। নিজের অজান্তেই সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন আপনি। যেখানে যাচ্ছেন, পৃথিবী আপনার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠছে।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, সামাজিক সম্পর্কগুলো একতরফা নয়। পৃথিবীতে উদার মানুষের অভাব নেই। তারা আশপাশেই আছেন। আপনার সঙ্গে যেচে আলাপ তারা করতেই পারেন। কিন্তু কতক্ষণ? কাউকে কাউকে ভালো না-ও লাগতে পারে; কিন্তু কোনো ব্যক্তির কাছে সবাই অপ্রিয় হতে পারে না। আমাদের মনে রাখা দরকার যে সামাজিক সম্মিলনীতে প্রিয়-অপ্রিয় বলে কিছু নেই। এই যেমন ঈদের উৎসবে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে যাই। উৎসবের আসল সৌন্দর্য এটাই।
আমি বিশ্বাস করি, চিত্তের সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে তা রয়েছে। নানাভাবে, নিজের অগোচরেই সেটি আমরা উপেক্ষা করি, কিংবা বাইরের রূপ দিয়ে আড়াল করে রাখি। প্রতিদিনই আমাদের সহজ-সরল ছোট ছোট কত আবেগ-অনুভূতিকে অপ্রকাশের নেতিবাচক প্রণোদনায় মেরেই ফেলি! আপনার কাছের বা পরিচিত কারও কাজ ভালো লাগলে এই অনুভূতি তার কাছে কেন অব্যক্ত রাখবেন? কারও কৃতিত্বের প্রশংসা না করে আমি তো থাকতে পারি না। বোধ করি, এতেও গড়ে উঠতে পারে সম্প্রীতির জগৎ। এর সুখই আলাদা।
ঈদ আসছে। ব্যক্তিতা ছেড়ে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি পারিবারিক হয়ে উঠবো আমরা, সামাজিক হয়ে উঠবো। এই উৎসবে আমাদের নানা রকম সম্মিলনী হবে; এমন মানুষকে আমরা পাবো, যার সঙ্গে দেখা হয়নি বহুদিন। এ মুহূর্তের আনন্দ কি এড়ানো যায়? বা, সবাই মিলে একটা পুনর্মিলনীর ব্যবস্থা করা হলো; সেখানে আপনিও আছেন। কেন এই সুখকর ক্ষণগুলো থেকে দূরে থাকবেন?
যেকোনো উৎসবের সৌন্দর্য মূলত সম্প্রীতির প্রকাশেই নিহিত। ঈদেও তাই। সাজপোশাকে আমরা সেই সৌন্দর্য উদ্যাপন করি মাত্র। এটা তো জরুরিই।
মডেল: তিথি ও মৌসুম
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস