ফিচার I ঢাকার বুকে ত্রিশতবর্ষী হাট
রাজধানীতে হাট। এ-ও কি সম্ভব? অনেকের কাছে খটকা লাগতে পারে। ৩০০ বছরের প্রাচীন হাটটি এখনো জীবন্ত। বসে প্রতি বুধবার নিয়ম করে। মেরাদিয়া হাট ঘুরে এসে স্মৃতি সজীব করেছেন দেবরাজ দেব
এখনো গ্রামে টিকে আছে হাটবার। মানে সপ্তাহে এক দিন বা দুই দিন বিকিকিনির ঘনঘটা। একে নিভৃত পল্লির ব্যবসায়িক বিনোদন বলা যায়।
তবে মানুষের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ফলে গ্রামগঞ্জের সেই হাট আগের মতো নেই। যারা শহরে বসবাস করেন, তাদের কাছে এগুলো এখন গল্পমাত্র। কেননা এই সুপারশপের যুগে কে আর বলবে সেই গ্রামবাংলার চিরায়ত হাটের কথা। আজকাল তো আবার ঘরে বসেই তাজা শাকসবজি কেনা যায়। আর সেখানে হাতে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে সদাই করাও যেন সময়ের অপচয়। তবে কেউ যদি নগরজীবনে হাটের স্বাদ পেতে চান, তাহলে যেতে হবে মেরাদিয়ায়। যেখানে প্রতি বুধবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাট চলে।
স্থানীয় বিক্রেতাদের মতে, এই হাটের বয়স প্রায় ৩০০ বছর। আগে এখানে বিশাল এক বটগাছ ছিল। যাকে কেন্দ্র করে এই হাট গড়ে উঠেছিল। কথা হয় বিক্রেতাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, একসময় এটি ছিল বিশাল এক হাট। কিন্তু সেই বটগাছের বদলে এখন সেখানে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন এবং উঁচু উঁচু দালানের ভিড়ে টিকে থাকা হাট। পাশের খালটিও ভূমিদস্যুদের উৎপাতে সংকুচিত হয়ে মৃতপ্রায়। তবে এখনো এই হাট রাস্তার দুপাশজুড়ে প্রায় চার কিলোমিটারজুড়ে বসে। একসময় প্রচার ছিল: সুই থেকে হাতি- সবই মেলে মেরাদিয়া হাটে। রাজধানীর খিলগাঁও থানার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে (বনশ্রী হাউজিং) অবস্থিত এই হাট। মেরাদিয়া এলাকায়। শাকসবজি, ফল থেকে শুরু করে মাটির তৈজস, জামাকাপড়, খেলনা, খাবার, পশুপাখি- সবই পাওয়া যায় এখানে। এ হাটে পার্শ্ববর্তী উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন, ডেমরা, সবুজবাগ, বাড্ডা, সাতারকুল, দক্ষিণগাঁও, নন্দীপাড়া এলাকার লোকজনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসেন। শুধু তা-ই নয়, ডেমরা, বেরাইদ, ইছাপুরা, রূপগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ দূর-দূরান্ত থেকেও আসেন হাটুরেরা। মেরাদিয়া হাটের প্রধান একটি আকর্ষণ হলো হরেক পদের মিষ্টি। মিষ্টান্ন সম্ভারে রয়েছে বালিশ, রসগোল্লা, চমচম, গজা, দই, লাড্ডু ইত্যাদি। এ ছাড়া মুড়ি, মুড়কি, নিমকি তো আছেই। ভোজনপ্রিয়দের জন্য আরও রয়েছে জিলাপি, খইয়ের মোয়া, বাতাসা, খুরমা, খাজা প্রভৃতি।
এই হাটকে আঞ্চলিক ভাষায় অনেকেই ‘মেরাইদ্দা হাট’ বলে থাকেন। ঐতিহ্যবাহী হাটটি বাঁশ এবং শুঁটকির জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। এখানে পাওয়া যায় বাঁশ ও মাটির তৈরি আকর্ষণীয় জিনিসপত্র। শুধু তা-ই নয়, রাস্তার দু-পাশে, খালি জায়গায় এখানে-সেখানে সবুজ সবজি, টাটকা মাছ ও রঙিন পণ্যের সমাহার। মেরাদিয়া হাটে ব্যবসায়ীরা মাথায় করেই নিয়ে আসেন নিজেদের পণ্য। কেউ শাকসবজি, কারও গাছের ফল, কেউ পালিত গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, আবার কেউবা নিয়ে আসেন গাভির টাটকা দুধ। বিক্রেতারা যে যেখানে জায়গা পান, সেখানেই বসে যান যার যার পণ্য নিয়ে। কেউ কেউ শাবল-খুন্তি হাতে মাটি খুঁড়ে বাঁশ পুঁতে তাতে শামিয়ানা, ত্রিপল, কাপড় বেঁধে বসার জায়গা করে নেন। আবার কোথাও সব খোলামেলা। সবকিছু মিলিয়ে দক্ষিণ বনশ্রীর এই মেরাদিয়া হাট যেন সপ্তাহের বিশেষ মিলনমেলা। বিনোদনও বটে।
৪৫ বছর বয়সী রতন সরকার। মেরাদিয়া হাটে তিনি মিষ্টি আর জিলাপি বিক্রি করেন। তার বাবাও এখানে মিষ্টান্ন বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ১৭ বছর ধরে এই ব্যবসা সামলাচ্ছেন তিনি। তার কথায়, ‘এই হাটের বয়স কমপক্ষে তিন শ বছর। আমার বাপের জিলাপির দোকান ছিল। এই হাটের আগের চেহারা আর নাই। হাট জমলেও চেহারা বদলাইছে অনেক।’ তিনি তার বাবার কাছ থেকে শোনা এই হাটের গল্প বলেন, ‘এখানে পাহাড়ের মতো বিশাল এক বটগাছ আছিলো। রাইতে দেখলে ভয় লাগতো। অনেকে কইতো জিন-পরী আছে। ভয়ে আমরা আসতাম না। বুধবার ওই বটগাছের নিচেই বসতো হাট। ভালোই শান্তি আছিল। সেই গাছ কাইটা বড় বড় বিল্ডিং বানাইছে অনেক আগেই। তাই হাটের মজাটাও আগের চাইতে কম।’
বনশ্রীর বাসিন্দা নাজিয়া অর্ণি বলেন, ‘প্রতি বুধবারই এই বাজারে মূলত সবজি, মাছ, ফলমূল কিনতে আসি। এখানে সবই টাটকা এবং তুলনামূলকভাবে কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায়।’ মেরাদিয়া হাটে এই প্রথম এসেছেন নিকেতনের সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে অনেক শুনেছি এই হাটের কথা, কখনো দেখিনি। তাই আজ দেখতে এলাম। কিছু কেনাকাটা করেও নিয়ে যাবো।’ খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা হালিম মাহমুদ। ৫৩ বছরের এই ব্যক্তি এ হাটের নিত্য ক্রেতা। তার একটি কাপড়ের দোকান ছিল এখানে। বয়স হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছাড়তে পারেননি এই হাটের মায়া। তাই তিনি প্রতি বুধবার এখনো আসেন।
আশপাশের এলাকা থেকে বিক্রেতারা যেমন আসেন, তেমনি দেশের নানা প্রান্ত থেকেও বিভিন্ন ধরনের মালামাল আনা হয় এই হাটে। পাশেই ‘নড়াই নদী’। নদী পথে বড় বড় নৌকা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আনা হয় এই হাটে। যদিও এই নদীপথ আগের মতো প্রশস্ত নেই।
কথা হয় তরমুজ ব্যবসায়ী আমিন মোল্লার সঙ্গে। ৭৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ বলেন, ‘নড়াই নদী অনেক বড় ছিল। পানি ছিল পরিষ্কার। শত শত নৌকা আসতো হাটে। দখল আর দূষণে নড়াই আজ মৃতপ্রায়। এখন পানির রঙ কালো, তবু মাঝেমধ্যে দু-একটা নৌকা আসতে দেখা যায়। আগে আশপাশে আর কোনো বাজার হাট ছিল না। সবাইকেই বাজার করতে আসতে হতো মেরাদিয়ায়।’
এই হাটে পুরুষ বিক্রেতাদের পাশাপাশি রয়েছেন বহু নারী বিক্রেতাও। হাটের আশপাশের বাসিন্দারা, বিশেষ করে নারীরা এই হাটের প্রধান গ্রাহক। আশপাশের স্থানীয়রা অপেক্ষায় থাকেন এই দিনটির জন্য। সারা সপ্তাহের বাজারটা তারা এখান থেকেই সেরে নেন। কারণ, এখানকার পণ্য দামে সাশ্রয়ী আর মানে ভালো।
তবে বৈশাখের প্রতিটি হাটে এই এলাকা অন্য সময়ের তুলনায় বেশি জমজমাট হয়ে ওঠে।
ছবি: লেখক