ফুড বেনিফিটস I পেস্তা বাদাম
রোগ প্রতিরোধে, সবলতায়, সৌন্দর্যচর্চায় পেস্তা বাদামের বিকল্প কল্পনাতীত
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশে তন্নতন্ন করলে ও একটি পেস্তা বাদামগাছ পাওয়া যাবে না। সুদূর ইরান, চীন, আফগানিস্তান পেরিয়ে এ বাদাম ঠাঁই পায় আমাদের এক বাটি সুস্বাদু ক্ষীর বা পায়েসে। পেস্তা বাদামের গাছ প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৫৪ সালে, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার কিছু অংশে।
পেস্তাই সবচেয়ে পুরোনো বাদাম। এর দাম যেমন বেশি, তেমনি প্রোটিনেও এটি টইটুম্বুর। সরাসরি বাদামে যাদের আপত্তি, তারা এটি খায় নানাভাবে। যেমন আইসক্রিমের সঙ্গে।
পেস্তা বাদামের খোলস খুব পাতলা হয়। বাদাম পরিপক্ব হলে খোলসটি নিজেই এক পাশে ফেটে যায়। তখন খুব সহজেই শাঁস বের করে নেওয়া যায়।
পেস্তা বাদামের শাঁস পাতলা ও লালচে বাদামি রঙে আবৃত থাকে। এই আবরণের কেতাবি নাম ‘পেল্লিকেল’। সেটি ছাড়িয়ে নিলে বাদামের সবুজ বর্ণ উঁকি দেয়।
একে শুধু খাদ্য বললে ভুল হবে। এটি একাধারে একটি পথ্য, রূপচর্চার উপাদান। ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল করতে কিংবা ত্বকের খসখসে ভাব দূর করতে এ বাদামের জুড়ি নেই। ডায়াবেটিক, ফ্যাট ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, চোখের ছানি, কোষ্ঠকাঠিন্য, লিভার ও দাঁতের সমস্যা সারানো ও ওজন নিয়ন্ত্রণে পেস্তা বাদাম ভালো একটি দাওয়াই।
গবেষণায় প্রমাণিত, নিয়মিত পেস্তা বাদাম খেলে এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস পায়। শরীরে বিদ্যমান কোলেস্টেরলের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ আছে, যেমন এলডিএল, এইচডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইড। সবচেয়ে খারাপ কোলেস্টেরল হচ্ছে এলডিএল। এই কোলেস্টেরল রক্তনালিতে জমে বেশি। পেস্তা বাদাম সেই বিনাশী কোলেস্টেরলই নিয়ন্ত্রণ করে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ফাইটোস্টেরল এবং অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড হৃৎপি-ের রক্ষক হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য, অন্যান্য বাদামের তুলনায় পেস্তা বাদামে ফ্যাটের পরিমাণ কম।
ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নন, অর্থাৎ, যাদের ডায়াবেটিস টাইপ টু, তাদের জন্য পেস্তা বাদাম প্রকৃতির আশীর্বাদ। পেস্তা মানবদেহের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গ্লাইকেশন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস বাড়তে দেয় না।
স্পেনের রোভিরা আই ভার্জিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মনিকা বুলো জানিয়েছেন, একাধিক পুষ্টিকর খাবার একত্রে সুগার নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিকা রাখে, পেস্তা বাদাম একাই তা করতে পারে। অর্থাৎ, এটি যেন একাই এক শ। স্পেনে গবেষণার জন্য, ডায়াবেটিসের সীমানায় থাকা ৫৪ জন ব্যক্তিকে দৈনিক একই পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতে দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই ৫৪ জনের মধ্যে ২৭ জনকে প্রতিদিন ৫৭ গ্রাম করে পেস্তা বাদাম খেতে দেওয়া হয়েছিল। আট মাস পর তাদের রক্ত পরীক্ষা করে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, রক্তে সুগার কমানোর উপায় হিসেবে পেস্তা বাদামই সবচেয়ে সহজ পথ্য।
বয়স বাড়লে মানুষ নানাবিধ অসুখ-বিসুখে পড়ে। পেস্তা বাদামে আছে ক্যারোটেনয়েড অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যেমন লুটেইন ও জিয়াজানথিন। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো বার্ধক্যজনিত সমস্যা প্রতিরোধে সক্ষম।
পেস্তায় থাকা লুমেন নামের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টটি চোখে ছানি পড়া রোধে কার্যকর। এ বাদাম নিয়মিত খেলে চোখের ম্যাকুলা ডিজেনারেশন কমে যায়। এটি চোখের ফ্রি র্যাডিক্যাল ড্যামেজ কমিয়ে দেয়। ফলে রাতকানা হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
পেস্তা বাদামে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এই ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। খাবারে ফাইবার বলতে আঁশকে বোঝায়। নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসকেরা আঁশযুক্ত খাবার খেতে পরামর্শ দেন। খাবারের ফাইবার দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয়- দুভাবে শরীরে প্রবেশ করে। দুই ধরনের আঁশই শরীরের জন্য উপকারী।
পেস্তা বাদামে থাকা সোডিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন লিভার সুস্থ রাখে। এগুলো কিডনির জন্যও ভালো।
এ বাদামের ভিটামিন বি৬ নার্ভের ফাইবার উন্নত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পেস্তার নিউট্রিয়েন্টস মগজে এনডোরফিন, মেলাটোনিন, সেরেটোনিন ও গামা অ্যামিনোবিউট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন করে নার্ভ সিস্টেম উন্নত রাখে।
পেস্তার ভিটামিন বি৬ উপাদান ও পাইরিডক্সিন- রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। এতে রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এ ছাড়া দাঁতের রোগ নিরাময়ে পেস্তা বাদাম বেশ ভালো।
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পেস্তা বাদাম খাওয়া স্বাস্থ্যোপযোগী। এ জন্য আগের দিন রাতে দুধ অথবা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে পারেন বাদামগুলো। বাদাম ভিজিয়ে রেখে খাওয়াকেই ভালো বলে আখ্যায়িত করেছেন গবেষকেরা। এতে বাদামের সাইট্রিক অ্যাসিড দূর হয়। এ ছাড়া বাদামের মধ্যে থাকা ট্যানিন মানুষের পরিপাকে সমস্যা তৈরি করতে পারে। ভিজিয়ে রাখলে ট্যানিন চলে যায়।
বাদাম ভেজাতে হবে সঠিক নিয়মে। এই কাজে ফোটানো পানি ব্যবহার করা উত্তম। দুই চামচ সি-সল্ট দিয়ে ছয় ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে তা বেশি ফলপ্রদ হয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম পেস্তা বাদামে থাকে ক্যালরি ২৩৫১ কিলো জুল, শর্করা ২৭.৫১ গ্রাম, চিনি ৭.৬৬ গ্রাম, ফাইবার ১০.৩ গ্রাম, স্নেহ ৪৫.৩৯ গ্রাম, সুসিক্ত স্নেহ ৫.৫৫ গ্রাম, বহুসুসিক্ত স্নেহ ২৩.৮২ গ্রাম, প্রোটিন ২০.২৭ গ্রাম। এ ছাড়া থাকে লুটিন জিজানথেল, থায়ামিন বি১, রিবোফ্লাভিন বি২, ন্যায়েসিন বি৪, ভিটামিন বি৬, ফোলেট বি৯, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি, ডি, ই, ক্যালসিয়াম ও আয়রন।
ু শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট