মনোজাল I ত্বকযত্ন না ভোগবাদ?
ত্বকযত্নের নিত্যনতুন প্রকরণ আর মাল্টি স্টেপ বিউটি রুটিনের প্রবল চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড় সৌন্দর্যসচেতনদের। তারপরেও প্রবল আকর্ষণ। এ যেন ট্রেন্ডে গা ভাসানোর চেয়ে বেশি কিছু। সংস্কৃতির স্থানান্তর বললেও কি ভুল হবে
ত্বক নিয়ে খুব সচেতন? সারাক্ষণের ভাবনা, কী ব্যবহার করলে তা আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। নতুন কোনো সৌন্দর্যপণ্য বাজারে আসামাত্রই আটঘাট বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়া তার ওপর? পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে ত্বকসচেতন মানুষের ত্বকযত্নের পণ্যের একটি বিশাল স্টক থাকে আজকাল। হিসাবটা প্রায় চমকে ওঠার মতো। নিদেনপক্ষে গড়পড়তা সাত ধরনের ফেস মাস্ক, চার রকম বডি লোশন, তিন ফ্লেভারের ফেস ক্লিনজার, কয়েক রকম বডি স্ক্রাব, নিয়াসিনামাইড সেরাম, ল্যাভেন্ডারভিত্তিক বডি ওয়াশ, এসেন্স, হায়ালুরনিক সেরাম, অ্যালকোহলভিত্তিক টোনার, আই ক্রিম ইত্যাদি। দেখে মনে হতেই পারে, এটি কোনো সেলিব্রিটির ব্যবহৃত পণ্যতালিকা? ভুল, নিতান্তই সাধারণ একজনের।
প্রশ্ন হচ্ছে, এটাকে যদি ভোগবাদ বলা হয়, খুব কি ভুল হবে? ব্যাপারটা রীতিমতো গবেষণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন মানুষ ত্বকযত্নের রুটিনের সঙ্গে এমন প্রবল, প্রায় বাধ্যতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে? নানা রকম স্টেপ সংযুক্ত রুটিনের এই উত্থান এবং সেগুলো অনুসরণ করার চাপ কেবল যে একটি ট্রেন্ড, তা নয়; বরং তার চেয়ে বেশি কিছু বলে গবেষকদের ধারণা। রীতিমতো যেন একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, যা নিরীক্ষা করে দেখার মতো।
মজার ব্যাপার হলো, এক দশক আগেও আমাদের ত্বকযত্নের রুটিনে একটি ক্লিনজার এবং একটি ময়শ্চারাইজারই যথেষ্ট ছিল। যেখানে এখন তালিকায় যোগ হয়েছে সেরাম, এক্সফোলিয়েন্ট, টোনার, মাস্ক ইত্যাদি অনেক কিছু। প্রতিটি পণ্যের ট্যাগলাইন নতুন কিছুর প্রতিশ্রুতি দেয়—উজ্জ্বল, কাচের মতো ঝকঝকে, দাগহীন তারুণ্যময় ত্বক। ফলাফল—ত্বকযত্নের এই উত্থান; যা সৌন্দর্যপ্রেমীদের বাথরুমের কাউন্টারগুলোকে পরিণত করেছে বিউটি প্রোডাক্ট কাউন্টারে আর সেলফ কেয়ারকে করে তুলেছে পারফরম্যান্সের শামিল। কিন্তু অতশত চকচকে বিপণন এবং তারকাদের লোভনীয় সুপারিশের আড়ালে যে প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো পুরো ব্যাপারটি কি আসলেই ত্বকস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, নাকি সেখানে রয়েছে অন্য ফাঁকি? আসলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নতুন ফর্মুলেশনগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার এই যাত্রায় সেলফ কেয়ার আর অতিমাত্রায় ব্যবহারের মাঝখানের রেখাটি ঝাপসা হয়ে আসে। মনোবিজ্ঞান বলে, আমাদের এই কেনাকাটা আসলে কেবল ত্বকের যত্নের নিরিখে নয়, বরং এটি ব্র্যান্ডগুলো থেকে দেখানো স্বপ্ন, আশা ও নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি। যার পেছনে ভোগবাদ কাজ করে অনেকটাই। আধুনিক ত্বকের যত্নে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি কেবল পণ্য বিক্রি করে না; বিক্রি করে আকাঙ্ক্ষা। সৌন্দর্যপণ্যের প্রতি গ্রাহক মনোভাব ও আবেগ সম্পর্কে কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সৌন্দর্যপণ্য ক্রয়ে আবেগ সব সময় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। গ্রাহকেরা কেবল কার্যকারিতা খোঁজেন না; তারা এমন একটি অনুভূতির পেছনে ছোটেন, যাতে তাদের মনে হয় একটি নতুন সেরাম, টোনার বা ময়শ্চারাইজার তাদের পুরো চেহারা পাল্টে দেবে। সোশ্যাল মিডিয়া এই মানসিকতার পালে হাওয়া লাগিয়ে দেয়; বিশেষ করে, টিকটক ও ইনস্টাগ্রাম ত্বকযত্নকে বিনোদন এবং একই সঙ্গে স্ট্যাটাসের প্রতীক করে তুলেছে।
বলা বাহুল্য নয়, বিজ্ঞাপনে সৌন্দর্যের ভাষাও ইদানীং পাল্টে গেছে। যেমন যদি কোনো পণ্য ঐচ্ছিক হিসেবে বাজারজাত করা হয়, তখন গ্রাহক সেটি কেনার আগে দ্বিধায় ভুগতে পারেন। কিন্তু যখন এটি অপরিহার্য হিসেবে তৈরি বলে দাবি করা হয়, তখন তার কাছে সিদ্ধান্তটি জরুরি মনে হয়। গবেষকদের মতে, সৌন্দর্যপণ্যকে ‘প্রয়োজনীয়তা’ বলার ভাষাগত কৌশলই একে গ্রাহকদের কাছে বিলাসিতার বদলে বাধ্যবাধকতায় পরিণত করে। যখন একটি সেরামকে তারুণ্যময় ত্বকের জন্য অপরিহার্য হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তখন একজন সৌন্দর্যসচেতন গ্রাহকের কাছে এটি এড়িয়ে যাওয়াকে নিজের প্রতি অবহেলার শামিল মনে হয়। ‘অ্যান্টি-এজিং’, ‘স্কিন ব্যারিয়ার রিপেয়ার’ এবং ‘গ্লো-বুস্টিং’-এর মতো জনপ্রিয় শব্দগুচ্ছ এই প্রেশারকে আরও জোরদার করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফিয়ার অব মিসিং আউট কীভাবে ক্রয়ের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে এবং ত্বকের যত্নে এর প্রভাব কতটা শক্তিশালী। ট্রেন্ডিং বিউটি প্রোডাক্টগুলো সব সময় গ্রাহকদের মনে করিয়ে দেয়, তাদের ত্বকের যত্ন নেওয়া দরকার, যাতে তারা নিখুঁত ত্বকের রহস্য মিস না করেন। সমস্যা হলো, এই অতিরিক্ত ব্যবহারের মানসিক প্রভাব একসময় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে। কারণ, এই পণ্যগুলো যখন স্তরে স্তরে ব্যবহার করা হয়, তখন উপকারের চেয়ে ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত এক্সফোলিয়েশন, ত্বক ঝুলে পড়া বা জ্বালাপোড়া করা এই যত্নের অতিরিক্ত চাপের একদম সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তারপরেও আকর্ষণ অব্যাহত থাকে; কারণ, অনেকের জন্য ত্বকযত্ন এখন কেবল ত্বকের যত্ন নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রাহকেরা কিছু ব্র্যান্ডের প্রতি বরাবরই অনুগত থাকেন। দৃশ্যমান কোনো ফল না পেলেও সেটি আবার ক্রয় করেন। কেন? অভ্যাস, বিশ্বাস এবং একধরনের কুসংস্কার যে, এটি ব্যবহার করা ছেড়ে দিলে ত্বক নষ্ট হয়ে যাবে। এই মনস্তাত্ত্বিক সংযুক্তি, বিজ্ঞাপনের নিরলস বার্তার সঙ্গে মিলিত হয়ে, ত্বকের যত্নকে একটি অন্তহীন চক্রে পরিণত করে; যা অনেকটা এমন যে—কিনুন, প্রয়োগ করুন এবং পুনরাবৃত্তি ঘটান। আসলে সাধারণভাবে বলতে গেলে ত্বকের যত্ন হলো স্বযত্ন, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে লালন-পালন এবং সুরক্ষার একটি উপায়। কিন্তু আধুনিক শিল্প একে আরও জটিল কিছুতে পরিণত করেছে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে শৃঙ্খলা, মূল্য ও মর্যাদার প্রতীক। নিখুঁত কিছু পাওয়ার পেছনে ছোটা, প্রতিটি ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চাপ, ত্বকের যত্নকে নিছক একটি বাধ্যবাধকতার মতো করে তুলেছে; যা ঘটছে মনের অজান্তেই। ত্বকের আসলে কী প্রয়োজন, তা বোঝা; প্রতিটি নতুন প্রবণতার টান প্রতিরোধ করা এবং সৌন্দর্য বিপণনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এই বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার চাবিকাঠি হতে পারে।
রত্না রহিমা
মডেল: প্রজ্ঞা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল
