ফিচার I পসরা-পরবর্তী
বাংলাদেশের লোকাল ফ্যাশন শিল্পের প্রতি ক্রেতাকুলের ভালোবাসা, সমর্থন সেই প্রথম থেকে। তবু খামতি দেখা যায় বিক্রয়-পরবর্তী ধাপে। ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কে তখনই দেখা দেয় ঘনঘটা। ক্রেতা অধিকারে কতটুকু ভাবছে এই ইন্ডাস্ট্রি, সেই খোঁজে সারাহ্ দীনা
ক্রেতা আকর্ষণের জন্য হাঁকডাকের কমতি নেই বেশির ভাগ লোকাল ব্র্যান্ডের। দুর্দান্ত মডেলদের ফটোশুট, ওভিসি, ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার কনটেন্ট, বিশাল বিলবোর্ড—সবই থাকে। উৎসব এলে জৌলুশ বাড়াতে করা হয় অক্লান্ত পরিশ্রম এবং খরচ। আকৃষ্ট হন ক্রেতারা। আর যারা নিয়মিত কেনেন, তারাও পুনরায় ফিরে আসেন। কিন্তু কেনাকাটা সম্পন্ন হওয়ার পরে যদি ক্রেতা সেই পণ্য নিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন, সে ক্ষেত্রে ক্রেতা কেমন সেবা পেয়ে থাকেন?
ক্রেতার বিপরীতে বিক্রেতা। এটাই সত্যি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে বিক্রেতার কাছে ক্রেতা লক্ষ্মী সমান। কারণ, তার বিকিকিনির আয়োজন তো শুধু এই ক্রেতার জন্যই। আর যিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে কেনেন, তিনি আশা করেন, ক্রয়-পরবর্তী সেবাতেও বিক্রেতা থাকবেন তার পাশে। ক্রেতার বাস্তব অভিজ্ঞতাই টানা যেতে পারে এখানে উদাহরণে।
ঈদের শপিংয়ের সময় বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি ব্র্যান্ড থেকে কেনা হলো একটি পোশাক। প্রচণ্ড ভিড়ে পাওয়া গেল না ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ। ফলাফল—বাসায় ফিরে দেখা গেল, সাইজে প্রয়োজন পরিবর্তন। পরদিন ক্রেতা সকাল-সকাল শোরুমে দৌড়। কিন্তু তখন আর কেনার সময়ের মতো আন্তরিক নন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী। তিনি দায়সারা তখন। ক্রেতাও অস্বস্তিতে। পরে দীর্ঘ কালক্ষেপণের পরে সমাধান দিলেন ম্যানেজার। একই সঙ্গে জানালেন এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পেছনের গল্প। কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে উৎসবকে কেন্দ্র করে খণ্ডকালীন কর্মী নিয়েছেন বেশ কয়েকজন। তারা বিক্রিতে দারুণ প্রভাব রাখছেন। কিন্তু ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে অভ্যস্ত নন। তাই ভোগান্তি হয়েছে ক্রেতার।
অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনও এখন দারুণ প্রিয় ক্রেতাদের কাছে। ব্যস্ত ক্রেতা একটি অনলাইন ফ্যাশন ব্র্যান্ডে কামিজ অর্ডার করেন। উদ্দেশ্য—ঈদের দিন পরা। পরে দেখা যায়, একটি কামিজের সামনের অংশের নিচের দিকে ছেঁড়া, যা ঢাকতে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে রিফুর। সঙ্গে সঙ্গে পেজে জানানো হলেও কালক্ষেপণ করেন তারা। তত দিনে ঈদ শেষ। বিক্রেতার চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা সেখানে দেখা যায়নি।
আইন যা বলে
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ ক্রেতার স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনে ক্রেতাদের অধিকার সুরক্ষার জন্য সেখানে উল্লেখ আছে—
ক্রেতার ফেরত দেওয়ার অধিকার
ক্রেতার যদি কোনো পণ্য বা সেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি থাকে, তবে সেই পণ্য বা সেবা ফেরত কিংবা প্রতিস্থাপনে অধিকার তার রয়েছে। পণ্য বা সেবা ফেরত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত পূর্ণ করা হলে ক্রেতার ক্ষতিপূরণের অধিকার থাকবে।
ক্রেতার অভিযোগ শোনা এবং সমাধান
ক্রেতার যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তাহলে তাদের অভিযোগ শোনার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রয়েছে। সেখানে ক্রেতা অভিযোগ জমা দিতে পারেন এবং সেই অভিযোগ সমাধানের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো ক্রেতার সুরক্ষা এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ এবং আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে এখন দুই রকমের ক্রেতা তৈরি হয়েছে। একদল অনলাইনে স্বচ্ছন্দ আর অন্য দল অফলাইনে। আবার কোনো কোনো ক্রেতা একই সঙ্গে দুই ধরনের বাজারে কেনাকাটা করে থাকেন। দুই জায়গাতেই ক্রেতারা বিক্রয় প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে কেনাকাটা শেষ করেন। এই দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির দেওয়া তথ্য ক্রেতার সিদ্ধান্তে অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তাই একই ধারাবাহিকতায় ক্রয়-পরবর্তী সমস্যার সমাধান খুঁজতে তাদের শরণাপন্ন হতেই দেখা যায় বেশির ভাগ ক্রেতাকে।
বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্র্যান্ডের অনলাইন ওয়েবসাইটেই তাদের অনলাইন কেনাকাটার রিটার্ন অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি সম্পর্কে তথ্য দেওয়া আছে। তবু আফটার সেলস কাস্টমার কেয়ারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ক্যানভাস টিম যোগাযোগ করে ফ্যাশন বাজারের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে।
জেন্টল পার্কের চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের ব্র্যান্ডের এক্সচেঞ্জ-রিটার্ন পলিসি প্রতিটি ক্যাশ মেমোতে উল্লেখিত রয়েছে। যেকোনো রেগুলার প্রোডাক্ট ৭ দিনের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী বদলের ব্যবস্থা আছে। শুধু ইনভয়েসটি সংরক্ষণ করতে হবে। সেটি থাকলে দেশের মধ্যে ২৪টি জেলার ৫৪টি জেন্টল পার্ক শোরুম থেকে ৭ দিনের মধ্যে পণ্য পরিবর্তন করা যাবে। তবে কোনো ট্যাগ, লেবেল ও পণ্য নষ্ট করা যাবে না।’ কে ক্র্যাফটের ম্যানেজিং পার্টনার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘আমাদের রিটার্ন অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ পলিসি অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। ক্রেতা চাইলে কেনাকাটার আগেই বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন। বিক্রয়-পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য চাহিদা অনুযায়ী বদলে নেওয়া যাবে। তবে পণ্য কোনোভাবেই ব্যবহার, ধোয়া কিংবা অল্টার করা যাবে না। ছেঁড়া যাবে না হ্যান্ড ট্যাগ। আবার অনলাইনে অর্ডার করে কেনা পণ্যে যদি কোনো সমস্যা পাওয়া যায়, তাহলে ৫ দিনের মধ্যে ছবিসহ ক্রে ক্র্যাফটের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করে জানাতে হবে। তাহলেও পাওয়া যাবে রিটার্ন অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের সুযোগ।
হ্যান্ডক্রাফটেড শু ব্র্যান্ড লোকাল লেবেল থেকে জানা গেল, তারা ক্রেতাদেরকে এক সপ্তাহ সময় দেন তাদের সমস্যা জানিয়ে সমাধান পাওয়ার জন্য। একই সঙ্গে এই ব্র্যান্ডের অনলাইনে অর্ডার করার ক্ষেত্রে মূল দামের সঙ্গে বাড়তি এক শ টাকা যোগ করে ট্রায়ালের জন্য অন্য একটি সাইজ পাওয়া সম্ভব। এতে ক্রেতা সাইজ নিয়ে বিড়ম্বনা এড়াতে পারেন।
আশ্রয় যখন আইন
ক্রেতা চাইলে কেনাকাটার নব্বই দিনের মধ্যে অভিযোগ জানাতে পারবেন। লিখিত আকারে, ফ্যাক্স ও ই-মেইল ইত্যাদি মাধ্যমে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগের আবেদনে অবশ্যই অভিযোগকারীর পূর্ণ নাম ও ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম, ফোন নম্বর এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে। আমলযোগ্য অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত ও জরিমানা আরোপ করা হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর ধারা ৭৬(৪) অনুযায়ী আদায় করা জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীকে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
সবিশেষে
ক্রেতার অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে বিক্রেতার সঙ্গে তার দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে; যা পরবর্তী সময়ে ক্লায়েন্ট স্যাটিসফেকশন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এতে ক্রেতা উপকৃত হন, আর বিক্রেতাও কেনাকাটায় স্বচ্ছন্দ হতে পারেন।
ছবি: ইন্টারনেট
