skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I প্রজন্ম প্রভাব

নতুন চিন্তাভাবনা ও জীবনশৈলীর পক্ষেও কখনো কখনো ব্যক্তিগত, এমনকি মানবসভ্যতার জন্য হানিকর হয়ে ওঠা সম্ভব

প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে চিরহরিৎ বৃক্ষ একসময় বুড়িয়ে আসে; ফুরোয় তার অক্সিজেন ও নতুন পল্লব ছড়ানোর সক্ষমতা। সেই বৃক্ষের ছায়াতলে থাকা কোনো নতুন কুঁড়ি তখন বেড়ে উঠতে থাকে দুর্নিবার গতিতে। এভাবেই প্রজন্ম বদলের ভেতর দিয়ে সুরক্ষিত থাকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। মানবজীবনও এর বাইরে নয়। আজ যে শৈশবে, সে-ই দিনে দিনে তারুণ্য, পৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য পেরিয়ে একদিন শেষ করে জীবনচক্র। মানুষমাত্রই মরণশীল। তাই ব্যক্তিগত জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও মানবজাতির বিনাশ ঘটে না তাতে। নতুন মানুষে, নতুন সম্ভাবনায়, নতুন ফলাফলে জীবনচক্র অব্যাহত থাকে। কেননা, এই চক্র থমকে গেলে মানবজাতিরই ঘটে যাবে বিলোপ। জীবনের এই নানা পর্যায়ের চলমানতায় তৈরি হয় প্রজন্মের হিসাব। সাধারণত জন্মগ্রহণের সময়কালভেদে এর অন্তর্ভুক্তি। প্রতিটি সময়ই যেহেতু নতুন ও সতেজ, তাই এক প্রজন্মের সঙ্গে আরেক প্রজন্মের সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার ভেতর কিছু স্পষ্ট আর কিছু অস্পষ্ট পার্থক্য খেলা করতে থাকে। এ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সেই পার্থক্য প্রকট হয়ে উঠলে শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, মানবসভ্যতার জন্যও তা বয়ে আনতে পারে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা।

দুই
বড়দের দেখেই শেখে ছোটরা। এই পরম্পরা চিরন্তন। ‘আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভদ্রতার বালাই নেই’—এমন দীর্ঘশ্বাস ছড়ানো অনুযোগ-অভিযোগ অনেক সময় আপনাআপনি বেরিয়ে আসে বয়স্কদের মুখ থেকে। আর তা ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যে নয়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি সমান প্রযোজ্য? নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথে গড়ে তোলার মূল দায় পুরোনো তথা অগ্রজ প্রজন্মের। চিন্তা-চেতনা, জীবনযাপনে প্রজন্মগত কিছু ব্যবধান বরাবরই থাকে; তবু তা যথাসম্ভব কমিয়ে আনায় ভূমিকা রাখা চাই তাদের। তা ছাড়া নতুন বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা ও জানাশোনা স্বভাবতই আগের প্রজন্মের চেয়ে শ্রেয়। তাই তাদেরকে শুধু শেখানোই নয়, বরং তাদের কাছ থেকে পাঠ নেওয়ার মানসিকতা থাকা উত্তম। তাদের ভুলভ্রান্তিকে কাঠখোট্টা সমালোচনা বা নিন্দা না করে, বরং স্নেহভরা মন নিয়ে তা শুধরে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি, জীবনের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জে তাদের দেওয়া চাই প্রাণবন্ত উৎসাহ। বাংলাদেশি কিংবদন্তি রকস্টার জেমসের সেই গানের মতো—‘আকাশের উচ্চতায়/ কালো পিঠ খাড়া করে/ বৃক্ষের প্রশাখায়/ খোলা চুল মেলে ধরে…/ বড় হও/ দীর্ঘ হও/ শুধু বেড়ে ওঠো/ শুধু বেড়ে…’।

তিন
নতুন মানে টাটকা হলেও সব সময় মঙ্গলকর, তা কিন্তু নয়। নতুন চিন্তাভাবনা ও জীবনশৈলীর পক্ষেও কখনো কখনো ব্যক্তিগত, এমনকি মানবসভ্যতার জন্য হানিকর হয়ে ওঠা সম্ভব। আবার, পুরোনো মানেই সর্বদা সেকেলে বা ব্যাকডেটেড নয়। অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে ওঠে কিছু পুরোনো বিষয়-আশয়। মানুষও তেমনই। সময় ও জীবনের দৌড়ে নতুন প্রজন্মের চেয়ে পুরোনো প্রজন্ম ঢের পিছিয়ে পড়ে শারীরিক ও মানসিক—উভয়ভাবেই। তার নেপথ্যে রয়েছে যৌক্তিক কারণ। একদিকে বয়সের ভারের ক্রমাগত বৃদ্ধি, অপরদিকে জীবনের চলার পথে মুখোমুখি হওয়া বিবিধ নেতিবাচক বাস্তবতার চাপ সামগ্রিকভাবে নাড়ে কলকাঠি। তাই পুরোনো প্রজন্মের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের দায় এড়ানো নতুন প্রজন্মের পক্ষে অনুচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মতের মিল না ঘটলেও অগ্রজদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, তাদের অভিমতের ওপর গুরুত্বারোপ এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা অনুজদের দায়িত্ব। এ দায়ভার এড়িয়ে গেলে জীবনচক্রের স্বাভাবিক শৃঙ্খল ভেঙে পড়বে; যা কারও কল্যাণ বয়ে আনবে না।

চার
প্রজন্মগত ব্যবধান কমিয়ে আনার রয়েছে বেশ কিছু উপায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে মূল ভূমিকা যোগাযোগ স্থাপনের। এক প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অপর প্রজন্মের অধিবাসীদের যোগাযোগ স্থাপনে ঘাটতি দেখা দিলে এ ব্যবধানের উদ্রেক ঘটে। তাই প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষেরই পরস্পরের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে কথা ও ভাবের আদান-প্রদান ঘটানো চাই। তা ছাড়া যতটা সম্ভব একসঙ্গে সময় কাটানো, বাচনিক ও ইশারা ভাষায় অকৃত্রিমতার আভা ছড়ানো, সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা নিয়েও মন খুলে কথা বলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন এবং ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে প্রজন্মগত ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ধরনের ব্যবধান সীমা ছাড়িয়ে গেলে যথাযথ তৃতীয় পক্ষ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। মোটকথা, প্রজন্মভেদে কিছু ব্যবধান থাকা অস্বাভাবিক না হলেও তা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা শ্রেয়।

পাঁচ
প্রজন্ম পরিবর্তন চক্রের ভেতর দিয়ে প্রবহমানতা ধরে রাখে মানবসভ্যতা। যে যেই প্রজন্মেরই প্রতিনিধি হোন না কেন, অপরের প্রতি নিজ দায়িত্বভার সঠিক মূল্যবোধ ব্যবহারের মাধ্যমে সামলানো মানুষের একান্ত কর্তব্য।
এক প্রজন্মের সঙ্গে অপর প্রজন্মের সম্পর্ক কোনো রকমের দ্বেষের নয়; বরং পারস্পরিক পরিপূরক হয়ে ওঠুক।
সবার মঙ্গল হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top