প্রাগৈতিহাসিক I প্রস্তর যুগ পর্যালোচনা
প্যালিওলিথিক (প্যালিও) বা পুরোনো প্রস্তর যুগের খাদ্যাভ্যাস বহুল চর্চিত বিষয়। মূলত এই খাদ্যাভ্যাস থেকে আন্দাজ করা যায়, প্রাগৈতিহাসিক সে যুগের মানুষের খাবার গ্রহণের পদ্ধতি কেমন ছিল
স্টোন এইজ বা প্রস্তর যুগের খাদ্যাভ্যাসের পুনর্মূল্যায়ন করতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে, যা চলমান ছিল প্রায় ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে কৃষিকাজ আবিষ্কারের আগপর্যন্ত। অতীতের মানুষ ছিল এখনকার তুলনায় বেশ দীর্ঘদেহী, এ কথা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। সে সময় মানুষের শারীরিক ও অঙ্গগত অভিযোজন ঘটে। ফলে মস্তিষ্কের আকার বেড়ে যায়; কমে যায় অন্ত্রের আকার। এই বিবর্তনীয় পরিবর্তন সম্ভবত পুষ্টিসমৃদ্ধ, সহজে হজমযোগ্য খাবার খাওয়ার অভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বর্ধিত মস্তিষ্ক মানে বর্ধিত বুদ্ধিমত্তা। বেশ দীর্ঘদেহী হওয়ার কারণে সেই সময়কার মানুষের দেহে ক্যালরি ও পুষ্টির চাহিদা বাড়ে। প্যালিওলিথিক যুগের অধিবাসীরা পাথরের যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন, যেন তারা শিকার কিংবা খাবার সংগ্রহ, প্রস্তুত ও রান্না করতে পারেন। তারা জেনে গিয়েছিলেন, রান্না করলে খাবার সহজে হজমযোগ্য হয় এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিজ খাবার থেকে আরও শক্তি আহরণ করা সম্ভব হয়। তারা ছিলেন এককথায় সর্বভুক; তবে জলবায়ু, অবস্থান ও ঋতুর ওপর নির্ভর করে তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটত।
মজার ব্যাপার হলো, সুদূর অতীতের সেই খাদ্যাভ্যাসের একধরনের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে আধুনিক যুগে। তা-ও বেশি দিন আগে নয়। আধুনিক প্যালিও ডায়েটের সূচনা ১৯৭৫ সালে; মার্কিন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ওয়াল্টার এল. ভয়েগটলিন ‘দ্য স্টোন এইজ ডায়েট: বেসড অন ইন ডেপথ স্টাডিজ অব হিউম্যান’ বইটি প্রকাশের পর। সেই বইয়ে তিনি দাবি করেন, মানুষ স্বভাবতই অধিক মাংস ও কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত ডায়েটে অভ্যস্ত ছিল, যা প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক জাতির খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন মার্কিন রেডিওলজিস্ট ড. এস. বয়েড ইটন। সেখানে তিনি বলেন, আধুনিক দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলো বর্তমান ডায়েট ও মানুষের বিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে একটি অসংগতির ফল। তার যুক্তি হলো, প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহকদের খাদ্যই আজকের মানুষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
২০০২ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী ড. লরেন করডেইন ‘দ্য প্যালিও ডায়েট: লুজ ওয়েট অ্যান্ড গেট হেলদি বাই ইটিং দ্য ফুডস ইউ ওয়ার ডিজাইনড টু ইট’ বইটি প্রকাশের পর প্যালিও ডায়েট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর থেকে জনসাধারণ ‘গুহাবাসীর ডায়েট’ নামে পরিচিত এই খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। এর সমর্থকদের দাবি, এটি আধুনিক খাদ্যাভ্যাসকে আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে এবং এমন খাবার উপাদানগুলোকে গুরুত্ব দেয়, যা মানুষের পক্ষে খাওয়ার উপযোগী।
বর্তমানের প্যালিও ডায়েটে সবজি, ফল, লিন মিট বা চর্বিহীন মাংস, বাদাম, মাছ, মধু ও ডিমের মতো খাবার অধিক গুরুত্ব পায়। বাদ পড়ে শস্যদানা, দুগ্ধজাত, ডালজাতীয়, অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার। ওজন কমাতে এবং স্বাস্থ্যকর হওয়ার বিশ্বাস থেকে অনেকে প্যালিও ডায়েট অনুসরণ করেন; যদিও শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো একে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডায়েটের খুঁটিনাটি সম্পর্কে পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের বিশদভাবে জানা প্রয়োজন, যেন তারা রোগীদের সম্ভাব্য সুবিধা ও ঝুঁকির বিষয়ে পরামর্শ দিতে এবং সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন।
জানা কথা, গেল দুই শতাব্দীতে শিল্পায়ন ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এবং বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে উচ্চ ক্যালরি সংবহনের ওপর ভিত্তি করে স্বল্পমূল্য, সহজলভ্য ও অতি প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রচলন ঘটেছে। এ ধরনের খাবার গ্রহণের ভয়াবহ পরিণতি হলো স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কার্ডিওভাসকুলার সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর প্রসার। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ—উভয়েই এই প্রবণতা পাল্টানোর জন্য সমাধান খুঁজছেন। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করার ‘আদর্শ’ খাদ্য অনুসন্ধানে প্যালিও ডায়েট ও ব্লু জোন ডায়েটের মতো প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী রন্ধনশৈলী নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
প্যালিওলিথিক খাদ্যাভ্যাস
বিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদেরা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং আধুনিক শিকারি-সংগ্রাহক সম্প্রদায়গুলোর ওপর গবেষণা করে পুরোনো প্রস্তর যুগের খাদ্যাভ্যাস পুনর্গঠন করেছেন। সেই আদিম যুগের মানুষ সাধারণত চাষাবাদ না করা ফলমূল, শিকড় বা আলুজাতীয় উদ্ভিদ, সবজি এবং মাঝেমধ্যে মধু, মাছ ও মাংস খেতেন। তারা বিভিন্ন মাত্রায় চর্বি ও প্রোটিন গ্রহণ করতেন এবং উদ্ভিদজাত আঁশসমৃদ্ধ খাদ্য খেতেন। আইসোটোপিক (একধরনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া) বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পুরাতাত্ত্বিক সময়ে কোনো সর্বজনীন খাদ্যাভ্যাস ছিল না, তা প্রমাণিত হয়েছে। ইসরায়েলে আবিষ্কৃত প্রায় ৮ লাখ বছর পুরোনো জীবাশ্ম পরীক্ষা করে জানা যায়, তারা মূলত উদ্ভিদভিত্তিক বিভিন্ন খাদ্য গ্রহণ করতেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল বীজ, বনজ ফল ও সবজি, বাদাম এবং কম পরিমাণে মাংস ও মাছ। নিয়ানডার্থালের (বিলুপ্ত প্রাচীন মানব সম্প্রদায়) দাঁতের ক্যালকুলাস থেকে পাওয়া মাইক্রোফসিল পরীক্ষায় আধুনিক ইরাক ও বেলজিয়ামে উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে ছিল খেজুর, শিম ও বীজ। কিছু চিহ্নিত উদ্ভিদের স্টার্চ বা মাড় রান্নার মাধ্যমে রাসায়নিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে। পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক বাসিন্দারা প্রধানত প্রাণিজ প্রোটিন ও কাঁচা খাবারের ওপর নির্ভর করতেন বলে প্রচলিত যে ধারণা রয়েছে, এসব পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, দুই ডজনের কম সমসাময়িক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এখনো বিভিন্ন অঞ্চল ও জলবায়ুতে বসবাস এবং শিকারি-সংগ্রাহক জীবনধারা অনুসরণ করে। এর মাঝে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা গোত্রটি হলো উত্তরের তানজানিয়ার হাদজা নৃগোষ্ঠী। তাদের খাদ্যাভ্যাস প্যালিও ডায়েটের বৈশিষ্ট্য বহন করে, যা সম্পূর্ণ ও অপরিবর্তিত বা আনপ্রসেসড খাবারকে গুরুত্ব এবং শস্য, দুধজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলোকে বাদ দেয়। তারা ফাইবার ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য খান এবং মূলত উদ্ভিজ্জ শিকড়, জামজাতীয় ফল, মাংস, বাওবাব ফল ও মধু গ্রহণ করেন। আধুনিক সময়ে শীতকালে শিকারি-সংগ্রাহকদের, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উত্তরাঞ্চলের মতো হিমশীতল অঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে মাছ আহরণই খাদ্যের চাহিদা পূরণের প্রধান কর্ম; তারা প্রাণিজ খাবার থেকে উষ্ণ অঞ্চলের শিকারিদের তুলনায় অধিক ক্যালরি সংগ্রহ করেন।
তালিকায় আলোকপাত
বিভিন্ন অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, প্যালিওলিথিক যুগের খাদ্যতালিকা সম্ভবত বিশেষ কয়েকটি খাবারের সমন্বয়ে গঠিত ছিল।
উদ্ভিদজাত: টিউবার (কন্দজাত আনাজবিশেষ), বীজ, বাদাম, বুনো বার্লি পিষে তৈরি আটা, ফল, বেরি ও ফুল। টিউবার হলো সেই ফুলের অংশ, যা উদ্ভিদ পুষ্টি সংরক্ষণে ব্যবহার করে। এগুলো সাধারণত মাটির নিচে থাকে এবং দেখতে আধুনিক সময়ের গাজর, পার্সনিপ ও আলুর মতো।
প্রাণিজাত: বড় ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন বাইসন ও খরগোশ), পাখি (বাতাসি হাঁস ও বুনো মোরগ), সরীসৃপ (কচ্ছপ)। এ ছাড়া সংগ্রহ করা ডিম মোট শক্তির প্রায় ৩ শতাংশ সরবরাহ করত।
মাছ ও শেলফিশ: লবণাক্ত পানির তাজা মাছগুলো মূলত উপকূলীয় ও নদীকেন্দ্রিক জনপদে খাওয়ার চল ছিল।
কীটপতঙ্গ: বিভিন্ন কীট (যেমন ঘাসফড়িং ও পিঁপড়া) এবং এসব থেকে আহরিত পণ্য; যেমন মধু ও মৌচাক যে যুগের মানুষের জীবিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
প্রস্তর যুগের খাদ্য ছিল প্রাকৃতিকভাবে সংগ্রহ করা ও পূর্ণ উদ্ভিজ্জ। শরীর ও মস্তিষ্ক উন্নয়নের জন্য ক্যালরিতে বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য নিশ্চিত করত। আজকের দিনের প্যালিও ডায়েট এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি; যদিও এই ডায়েট আদতে আরেকটু বিজ্ঞানভিত্তিক ভারসাম্য দিয়ে আধুনিকভাবে পুনঃপ্রকাশিত।
ফুয়াদ রূহানী খান
চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট
