ফিচার I ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স
একধরনের এক্সপেরিয়েন্সিয়াল বা ইমপ্রেসিভ ডাইনিং। খাদ্য গ্রহণের এমন এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা খাবারের স্বাদ, পরিবেশ, পরিবেশন, থিম, যোগাযোগ ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে একত্র করে সৃষ্ট। কখনো কখনো সেরা রেস্টুরেন্ট অর্ডার সিস্টেম ব্যবহার করা দিয়েই এই অভিজ্ঞতার সূচনা ঘটতে পারে
গ্যালারি রেস্টুরেন্ট
এ ধরনের রেস্তোরাঁয় ভোজনকারীদের পরিবেষ্টন করে রাখে বিভিন্ন শিল্পকর্ম। সাধারণত স্থানীয় প্রতিভাবান কিংবা সুপরিচিত শিল্পীদের সৃষ্টির প্রদর্শনী ঘটে তাতে; বিশেষ করে বড় ও প্রতিষ্ঠিত গ্যালারি-স্টাইলের রেস্তোরাঁগুলোতে এমন শিল্পকর্ম শোভা পায়। এসব মনোরম সৃষ্টিকর্ম দেখতে দেখতে খাদ্য গ্রহণ করার বাসনায় ভোজনরসিকেরা গ্যালারি রেস্টুরেন্টের প্রতি আকৃষ্ট হন। এটি মিটআপ বা ডেটের জন্যও অনেকের কাছে আদর্শ। কারণ, শিল্প নিয়ে সহজ ও চিন্তাশীলভাবে আলাপচারিতা শুরু, মতামত শেয়ার করার মাধ্যমে কোনো অস্বস্তি ছাড়াই আইস ব্রেক করা যায়। কোনো কোনো গ্যালারি রেস্টুরেন্টে আধুনিক ডিজিটাল স্পর্শ দিতে টেবিলগুলোতে কিউআর কোড স্থাপন করা হয়, যা ভোজন অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়ক।
অ্যাকুয়ারিয়াম রেস্টুরেন্ট
এমন রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খেতে খেতে আপনি সমুদ্রের বিস্ময় উপভোগ করতে পারবেন। থাকবে না ডুবে যাওয়ার দুশ্চিন্তা! খাদ্য গ্রহণের এ ধরনের পরিবেশ প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও চমৎকার। সুস্বাদু খাবার মুখে চালান করে দেওয়ার ফাঁকে উপভোগ করা যায় চারপাশের বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর বৈচিত্র্যময় গতিবিধি।
ট্রপিক্যাল প্যারাডাইস রেস্টুরেন্ট
নাম শুনে ট্রপিক্যাল প্যারাডাইস রিসোর্টের মতো মনে হতে পারে; তবে পুরোপুরি এক নয়। রিসোর্টে মানুষ ছুটিতে অবকাশকালীন অভিজ্ঞতা পেতে যান; অন্যদিকে ট্রপিক্যাল প্যারাডাইস রেস্টুরেন্টে খাবারের মাধ্যমে একটি দৃশ্যমান ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া যায়। এ ধরনের রেস্তোরাঁয় অতিথিরা ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছপালা, বাঁশ, ফুল, এমনকি সৈকত বা উপহ্রদের কাছাকাছি পরিবেশে খাদ্য গ্রহণের সুযোগ পান। পরিবেশই অতিথিদের জন্য একটি প্রশান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়।
ফার্ম টু টেবিল রেস্টুরেন্ট
সবুজের সমারোহ রয়েছে, এমন কোনো স্থান থাকলে সেটিকে খামারে রূপান্তর করা যেতে পারে; আর সেখানে খাবার পরিবেশন করা হতে পারে একটি চমৎকার আইডিয়া। বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় খাদ্য প্রবণতা হলো স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। এই ধারণা উদ্যোক্তাকে তাজা, স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করা খাবার পরিবেশনের সুযোগ দেয়। সেই সঙ্গে অতিথিদের দেয় একটি শান্তিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশে খাবার উপভোগের অভিজ্ঞতা।
সিনেম্যাটিক ডাইনিং
ছুটির আগের দিনে অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ভালো কিছু খাবার আর সঙ্গে প্রিয় মুভি দেখার অনুভূতি অন্য রকম। এটি সেই সহজ আনন্দ, সেই প্রশান্তির নিশ্বাস, যা অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়। এটিই সেই অনুভূতি, যা সিনেম্যাটিক ডাইনিং জীবন্ত করে তোলে। আজকাল গ্রাহকদের এমন অভিজ্ঞতা দিতে অনেক রেস্তোরাঁয় বড় স্ক্রিন, সোফা বেডের ব্যবস্থা রাখা হয়। ফলে আয়েশ করে মুভি দেখতে দেখতে উদর পূর্তি করতে পারেন অতিথিরা।
প্রজেকশন ম্যাপিং ডাইনিং
এটি একটি বহুমুখী-ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা দেয়। প্রযুক্তির প্রভাবে টেবিল, দেয়াল, এমনকি পুরো ডাইনিং এলাকায় চিত্র, রং ও অ্যানিমেশন প্রক্ষেপণ করে। একটি মজাদার, সদা পরিবর্তনশীল আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রজেকশন ম্যাপিং ডাইনিং আসলে খাদ্য গ্রহণের অভিজ্ঞতায় ভিজ্যুয়াল শোর মতো অনুভূতি যুক্ত করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ তাদের অতিথিদের জন্য একাধিক ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করার অভিজ্ঞতা তৈরি করছে। যেমন লন্ডনের লে পেটিট শেফ, যা একটি অভিনব ও ইন্টার্যাকটিভ ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স। সেখানে ছোট্ট (৬ সেন্টিমিটার উচ্চতার) একজন অ্যানিমেটেড ভার্চুয়াল শেফ গ্রাহকের প্লেটের ওপর প্রজেকশন ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে রান্না শুরু করে। তারপর বাস্তব খাদ্য পরিবেশক সেই খাবার পরিবেশন করেন। প্রতিটি কোর্সের সঙ্গে সম্পর্কিত সমুদ্র, বরফ, বাগান ইত্যাদি থিমভিত্তিক পরিবেশের সমন্বয়ে তাতে খাবারের সঙ্গে থিয়েটারের আবহ সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে পাওয়া রোবোটিক ডাইনিং, ডিজিটাল রান্নার ক্লাস, ড্রোন পরিষেবা, কিউআর কোড মেনুর মতো ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স হালে বেশ জনপ্রিয়।
দ্য জেন
এর সৃষ্টি শূন্য থেকে শুরু হয়নি। ভবনটির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। ডাচ শেফ সার্জিও হারম্যান ও নিক ব্রিল স্টুডিও পিয়েট বুন বাকি অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে এককালের গির্জাটিকে একটি ডাইনিং স্পেসে রূপান্তর করেছেন। আর্কিটেকচার ও নির্মিত পরিবেশের প্রতি নিবেদিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও কমিউনিটি আর্কিনেক্টের মতে, বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পের দ্য জেন কেবল একটি রেস্তোরাঁ নয়; এটি একসময় সে দেশের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে এবং ডাচ সীমান্ত থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এন্টওয়ার্প শহরের গ্রোন কোয়ার্টিয়ারের একটি সামরিক হাসপাতালের গির্জা ছিল। আর্কিটেকচারাল রেকর্ডও উল্লেখ করেছে, ভবনটির অভ্যন্তরীণ অংশ ২৫ বছর ধরে ফাঁকা ও অব্যবহৃত থাকায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডিজাইনাররা সবকিছু প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে যতটা সম্ভব মূল বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে শুধু খাদ্য নয়, সেই স্থানের পেছনের ইতিহাসও উপভোগ করতে পারেন ডাইনিং অতিথিরা।
ড্যান্স লো নয়ার
এদুয়ার্দ দু ব্রোগলি প্রতিষ্ঠিত; যার অর্থ ‘অন্ধকারের নাচ’। ২০০৪ সালে প্যারিসে যাত্রা শুরু এর। ড্যান্স লো নয়ারের ধারণাটি সহজ অথচ গভীর। এখানে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে গ্রাহকদের পাতে খাবার দেওয়া হয়। আর তা পরিবেশন করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী খাদ্য পরিবেশক। উদ্যোক্তার মতে, খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য হলো সকল ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে পুনঃসংযোগ স্থাপন করা। রেস্তোরাঁটির অভ্যন্তরীণ অংশ এমনভাবে নির্মিত, ফলে সব ধরনের আলোর প্রবেশ আটকে দেওয়া হয়েছে। দেয়াল, মেঝে ও ছাদে এমন বিশেষ উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, যা আলো প্রতিফলিত করে না; ফলে পুরোটা সময় এটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। এ রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তার প্রাধান্য শীর্ষে। স্থানটিতে বিশেষায়িত আসবাব ও বসার ব্যবস্থা রয়েছে, যা অন্ধকার পরিবেশেও সহজ চলাফেরার সুযোগ জারি রাখে।
ডিনার ইন দ্য স্কাই
এই ধারণার ওপর গবেষণা করেছিল টুসনফুডি শীর্ষক একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। পরে বেলজিয়ান উদ্যোক্তা ডেভিড গিসেলস ও স্টেফান কেরকহফস এর বাস্তবায়ন করেন। ডিনার ইন দ্য স্কাই একটি অনন্য ও ব্যতিক্রমী খাদ্য গ্রহণ অভিজ্ঞতা জাহির করে, যেখানে ক্রেন ব্যবহারের মাধ্যমে টেবিলসহ অতিথিদের প্রায় ৫০ মিটার ওপরে, শূন্যে তোলা হয়। এই অভিজ্ঞতা সাধারণত বিশেষ অনুষ্ঠানে, যেমন বিবাহবার্ষিকী বা করপোরেট ইভেন্টগুলোর জন্য বুক করা হয়। ডিনার ইন দ্য স্কাইয়ের মূল ধারণা হলো একটি অসাধারণ ও স্মরণীয় ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স দেওয়া, যেখানে অতিথিরা এক অনন্য পরিবেশে খাবার উপভোগ করতে পারেন। এই সেটআপে একজন শেফ, কর্মীসহ ২২ জন ডিনারে বসতে পারেন। এটি বিশ্বব্যাপী ৬০টির বেশি দেশে আয়োজিত হয়ে থাকে।
দ্য গ্যালারি
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স হলো লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলিতে অবস্থিত দ্য গ্যালারি। ড্যারেন আলমার ও চাক ফসেট প্রতিষ্ঠিত এই ভোজনালয়ে মেনু কিউরেট করেন শেফ জশুয়া উইগহ্যাম। লস অ্যাঞ্জেলেসের গোপন রহস্য, শহরের অভ্যন্তরীণ গাইড এই অফারকে একটি একক খাদ্য গ্রহণ অভিজ্ঞতা হিসেবে তুলে ধরেছে, যা এলিমেন্টা নামে পরিচিত। পৃথিবীর পাঁচ মৌলিক উপাদান মাটি, পানি, বায়ু, অগ্নি ও ইথারে প্রাণিত একটি দুই ঘণ্টাব্যাপী পাঁচ কোর্সের শো এটি। একে প্রাণবন্ত করতে দলটি ৩৬০ ডিগ্রি প্রজেকশন ম্যাপিং, কুয়াশা ও বাতাসের মতো পরিবেশগত প্রভাব, সিনক্রোনাইজড লাইটিং ও কিউরেটেড সাউন্ডস্কেপ ব্যবহার করে।
আজকের দিনের খাদ্যশিল্পে চারপাশে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রযুক্তিনির্ভর সেবাই ভবিষ্যতের পথ। খাদ্য গ্রহণ অভিজ্ঞতার ভবিষ্যৎ চেনা টেবিল-চেয়ারের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূরে ধাবমান।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট
