পাতে পরিমিতি I প্রবীণের পুষ্টি
বার্ধক্যে স্বভাবতই নানা শারীরিক জটিলতা বেড়ে যায়। প্রবীণেরা এমনিতেই থাকেন বেশ নাজুক। তাদের খাবারের প্রতি দেওয়া প্রয়োজন বিশেষ নজর। এ বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশি
সুস্থ, সবল জীবনযাপনের জন্য শিশু থেকে বৃদ্ধ—যেকোনো বয়সেই প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি উপাদান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন বিভিন্ন রোগের উৎপাত বাড়ে, তেমনি নানা ধরনের পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজনীয়তাও করে ওঠানামা; বিশেষ করে বয়সকালে জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ধরন একটু ভিন্ন।
বার্ধক্যে বিস্তার
কম বয়সের তুলনায় বার্ধক্যে যেসব পরিবর্তন আসে, তা পুষ্টির চাহিদা পূরণে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিএমআর হ্রাস
আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করি, তা থেকে পর্যাপ্ত ক্যালরি না পেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। সাধারণত কী ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করছি কিংবা কীভাবে বার্ন করছি, তার ভিত্তিতে ক্যালরির চাহিদা নির্ধারিত হয়। তবে আমাদের হৃৎপিণ্ড, লিভার, রক্ত সঞ্চালন, মস্তিষ্কসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বিশ্রামরত অবস্থায় কিছু ক্যালরি খরচ হয়, যার নির্ধারণ ঘটে ব্যক্তির মূলগত বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেটের (বিএমআর) মাধ্যমে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রেট কমতে শুরু করে।
পেশি ক্ষয়
তরুণ বয়সে যতই বলবান পেশি থাকুক না কেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়, তা হলো সার্কোপেনিয়া বা পেশি ক্ষয়। অন্যদিকে, প্রোটিনের অভাবে পেশির ভর দ্রুত কমতে থাকে। যেহেতু একটু বয়স হলে খাওয়াদাওয়ার পরিমাণ অনেকটা কমে যায়, তাই প্রোটিনের ঘাটতিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস
সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ বছরের পর থেকে মানবদেহের হাড়ের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্ষয় থেকে শুরু করে নানা রকম হাড়সংশ্লিষ্ট সমস্যা বাড়তে থাকে বয়স বাড়ার পাশাপাশি। প্রবীণদের মধ্যে নানা রকম ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতি দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর ঘাটতির কারণে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে।
দুর্বল পাচনতন্ত্র
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার থেকে শরীরের পুষ্টি উপাদান শোষণের ক্ষমতায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতা
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া মানে নানা ধরনের রোগের উৎপত্তি হওয়ার শঙ্কা। বার্ধক্যে এই ক্ষমতা স্বভাবতই তারুণ্যের তুলনায় বেশ কমে যায়।
প্রাত্যহিক পাতে প্রয়োজন
পুষ্টি উপাদানের পর্যাপ্ততা না থাকলে যেকোনো বয়সে অসুস্থতা গ্রাস করে। অন্যদিকে, বার্ধক্যের কারণে শরীরে নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি শুরু হলেও দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সঠিক পুষ্টি উপাদান থাকলে বাড়তি ভাঙন থেকে শরীরকে রক্ষা করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে প্রবীণদের প্লেটে বিশেষ কিছু পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিত করা চাই।
ক্যালরি
প্রত্যেক মানুষের দৈহিক ওজন, উচ্চতা, বয়স ও পরিশ্রমের ধরন অনুযায়ী ক্যালরি কতটুকু গ্রহণ করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। সে ক্ষেত্রে বার্ধক্যকালে কতটুকু গ্রহণ করবেন, তা ব্যক্তির শারীরিক গড়ন ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
প্রোটিন
মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডাল, ছোলা, সয়াবিন প্রভৃতি প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে সাধারণত তার ওজন অনুসারে প্রতি কেজিতে ১ থেকে ১.২ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। পেশি ক্ষয় রোধ, ক্ষত সারানো, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিনই সকালে অন্তত একটি ডিম এবং দুপুরে ও রাতে মাছ বা মাংস রাখা প্রয়োজন।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি
যদিও আমরা জানি, হাড় ও দাঁত মজবুত রাখতে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর জুড়ি নেই; সত্যি বলতে তরুণ বয়সে এতটা নিয়মমাফিক চলা অনেক সময় সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে বয়স বাড়তে বাড়তে এই গুরুত্বপূর্ণ নিউট্রিয়েন্টগুলোর ঘাটতি দেখা দিতেই পারে। তাই অন্তত বার্ধক্যকালে প্রাত্যহিক পাতে দুধ বা দুধজাতীয় খাবার; যেমন ছানা, দই, পনির, কাঁটাসহ ছোট মাছ, কুসুমসহ ডিম রাখা চাই। এ ছাড়া নিয়ম করে সকালে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সূর্যের আলোর মধ্যে থাকা উত্তম, যা দেহে ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করবে।
ফাইবার
খাবার গ্রহণের পর পেট পরিষ্কার রাখা সুস্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই পর্যাপ্ত ডায়েটারি ফাইবার বা খাদ্য আঁশ। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ, রক্তের গ্লুকোজ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে খাওয়া চাই ফল, স্যালাদ, সবজি, হোল গ্রেইন, ডাল, ওটস ইত্যাদি। এগুলো গ্রহণের সঠিক পরিমাণ নির্ভর করে কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতা বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যার ওপর। তবে অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম ফাইবার খাদ্য গ্রহণ করা শ্রেয়।
ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড
বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ; যেমন স্যালমন, সার্ডিন, টুনা এবং ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড, আখরোটে যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। এ ছাড়া বয়স বাড়তে থাকলে কারণে-অকারণে জয়েন্ট পেইন উঁকি দিতে পারে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ওমেগা ৩ থাকলে এ ধরনের বাড়তি কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, বিটা-ক্যারোটিন যুক্ত খাবারগুলোকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষার পাশাপাশি বয়সজনিত রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। বিভিন্ন ধরনের রঙিন ফল ও সবজি, সাইট্রাস ফল, বাদাম, বীজ প্রভৃতিতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স
প্রবীণদের জন্য বি১২ ও ফোলেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়তে থাকলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমার পাশাপাশি কমতে থাকে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষমতাও; সে ক্ষেত্রে বি ভিটামিনগুলো স্নায়ুতন্ত্র রক্ষা করে, এমনকি রক্তশূন্যতা প্রতিরোধেও সহায়ক। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও সবুজ শাকসবজিতে যথেষ্ট পরিমাণ বি কমপ্লেক্স রয়েছে। খাদ্যতালিকায় প্রতিদিনই অল্প পরিমাণ হলেও এগুলো রাখা চাই।
পানি
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য গ্রহণের চাহিদার পাশাপাশি পানি পানেরও ইচ্ছা কমতে থাকে। তাতে কোষে পানির পরিমাণ কমে গিয়ে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া প্রবীণদের মধ্যে ডিমেনশিয়া সমস্যা, বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বরাবরই একটু বেশি। পর্যাপ্ত পানি পানে যদি প্রবীণদের মধ্যে অনীহা দেখা দেয়, তাহলে পরিবারের সদস্যদের উচিত তার জন্য সাধারণ পানির পাশাপাশি তরল খাবার যেমন স্যুপ, ডাবের পানি, ফলের প্রাকৃতিক রস ইত্যাদি ধরনের পানীয়ের জোগান দেওয়া।
খাদ্যাভ্যাসে প্রতিরোধ
বার্ধক্যে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, কিডনি-সংক্রান্ত জটিলতা, স্ট্রোক ইত্যাদি সমস্যা বেড়ে যায়। প্রবীণদের সুস্থতা রক্ষার্থে তাই উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের চর্চা করা শ্রেয়।
অতিরিক্ত তেল হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়; তাই কম তেলে রান্না করা খাবার স্বাস্থ্যের জন্য এই বয়সে বেশ উপকারী।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে দাঁত বা হজমের সমস্যা হাওয়া স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে শক্ত কিছু চিবিয়ে খাওয়া অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণের পর দেখা দেয় হজমে গন্ডগোল। সে ক্ষেত্রে প্রবীণের পুষ্টি নিশ্চিত করতে খাবার হওয়া চাই নরম ও সহজপাচ্য। খাওয়া যেতে পারে জাউ ভাত, নরম খিচুড়ি ইত্যাদি।
ক্যালরি ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে একবারে অনেক গ্রহণ না করে, বারবার তথা দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার অল্প পরিমাণ খাবার গ্রহণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত।
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে লবণ ও চিনি সীমিত গ্রহণ করা উত্তম।
অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত; যেমন ক্যানড ফুড, প্যাকেটজাত কিংবা রেডি টু ইট খাবার ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই মঙ্গল।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে শৃঙ্খল জীবনযাপন সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। বার্ধক্যে তা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। বয়সজনিত পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে সুষম ও ব্যক্তিভিত্তিক খাদ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করলে প্রবীণেরা দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব ডায়েট প্ল্যান করে নেওয়া শ্রেয়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট
