ফরহিম I মেন অ্যান্ড মেকআপ: অ্যান আনটোল্ড স্টোরি
মেকআপের জেন্ডার ইনক্লুসিভ হয়ে ওঠার পুরো সুযোগ লুফে নিচ্ছেন হালের সৌন্দর্যসচেতন পুরুষেরা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এ গল্পের শুরু অনেক আগেই
লৈঙ্গিক দোহাই দিয়ে নিজের যত্ন ভুলবার সময় গত হয়েছে। কয়েক শতকের মধ্যে চলতি শতকই প্রথম; যখন পুরুষেরা নিজেদের খেয়াল রাখছেন, নিজেদের নিয়ে নতুন করে ভাবছেন, মেলে ধরছেন পুরুষত্বের ইতিবাচক দিকগুলো। সোশ্যাল মিডিয়া আর মেল ইনফ্লুয়েন্সারদের কল্যাণে পুরুষদের মেকআপ আর স্কিন কেয়ার নিয়ে অন্যদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে নতুন করে।
২০২৫ সালের অর্ধাংশ পার করে বলা যেতেই পারে, ‘রূপে গুণে অনন্যা’, এই প্রবাদবাক্য এখন আর খাটে না। রূপ আর শুধু গায়ের রঙে সীমাবদ্ধ নেই; গুণ তো সমান সবার জন্যই। লিঙ্গভেদে সৌন্দর্য রক্ষা সকলের তরেই সত্য। ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে শুরু করে উনিশ শতক, পুরুষদের মেকআপে দেখা গেছে বিস্তর তফাত; যা যথাযথ হয়েছে একুশ শতকে। গ্রেট ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া ১-এর শাসনকালে পুরুষদের মেকআপ অথবা স্কিন কেয়ারকে মেয়েলি মনে করা হতো; এটি ছিল তাদের পুরুষত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। সেই সময়ে চার্চ, রাজনীতি কর্তৃক এমন পুরুষদের বর্জনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। বিশ শতকে আসতে আসতে মেকআপ শব্দটাই শুধু নারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, শোবিজের কল্যাণে পুরুষেরাও যত্ন নিতে শুরু করেছেন নিজেদের লুকের। অতীত ঘাঁটলে পুরুষদের মেকআপের যে বিবর্তন দেখা যায়, তা জানলে হয়তো বর্তমানের এই পরিবর্তন সত্যিই সাহসী মনে হবে। বিভিন্ন যুগে পুরুষদের মেকআপ নিয়ে তৈরি হয়েছে ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যা।
মিসরীয় সভ্যতায় পুরুষদের সৌন্দর্য
প্রাচীন মিসরে প্রভাব ছিল দৈহিকভাবে আকর্ষণীয় নারী-পুরুষদের। নারীদের মন জয় করতে পুরুষদেরও নিজেদের বিশেষভাবে উপস্থাপন করতে হতো। প্রায় ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বে টানা কাজল দেওয়া চোখের পুরুষদের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। সঙ্গে ছিল হালকা সবুজাভ চোখের পাতা, আর সোনালি ব্রোঞ্জারের আলো-ছায়ার খেলা। মিসরীয় উপত্যকার আবহাওয়ার জন্যই কিনা পুরুষেরা নিজেদের সাজাতেন ব্রোঞ্জ টোনের মেটে রঙে। প্রচলিত আছে, চোখে দেওয়া এই কাজল শুধু তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করত এমনটা নয়; বরং তাদের বাঁচাত বিভিন্ন রকমের কালো জাদু থেকে। এমনটাই বিশ্বাস করা হতো।
রোমান সম্প্রদায়ের নায়কী ভাব
রোমানরা ছিলেন শৈল্পিক। যুগে যুগে অনেক শিল্পীর জন্ম, রংতুলির ব্যবহার, ইতিহাস আর শিল্পকর্মে উঠে এসেছে তাদের সৃষ্টি। তা খানিকটা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে রোমান যুগের পুরুষদের মেকআপ-প্রীতি। রোমান পুরুষেরা তাদের সাজসজ্জায় ব্যবহার করতেন হালকা গোলাপি রঙের ব্লাশ, ঠোঁটে মাখতেন লাল আভা, নেইলপলিশেরও প্রচলন ছিল; চুলকে হালকা কার্ল করার মাধ্যমে নিজেদের তারা আরও আকর্ষণীয় দেখাতে ভালোবাসতেন।
ইংল্যান্ডের এলিজাবেথীয় পুরুষেরা
ভূতের মতো সাদা, লাল আভায় রাঙা গাল—এই ছিল রানি এলিজাবেথ ১-এর সময়ের পুরুষদের মেকআপ। রেসিজমের হালকা-বিস্তর প্রভাব দেখা যেত তাদের সাজপোশাকেও। যদিও অনেকে মনে করেন, এই সাজসজ্জার শুরু শেকসপিয়ারিয়ান স্টেজ ড্রামার সঙ্গে। সেই সময়ে মেকআপ ইন্ডাস্ট্রি পরিপূর্ণ ছিল না বলে লেড বিশিষ্ট এই মেকআপের ব্যবহারে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ; যা পরে ক্যানসারে রূপ নেয়।
আঠারো শতকে ফ্রেঞ্চ অ্যারিস্টোক্রেসি
যেমন রাজা তেমন তার প্রজা। বয়স যখন ২৩, প্রায় সব চুল হারিয়ে রাজা লুই-১৬ পড়েছিলেন বিপাকে। কিন্তু রাজসভায় চুলহীন রাজাকে দাম দেবে কে! প্রায় অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ের মতো করে তিনি শুরু করলেন কৃত্রিম চুলের ব্যবহার। রাজার প্রভাবেই কিনা ফ্রান্সজুড়ে শুরু হলো কোঁকড়ানো আলগা চুলের ফ্যাশন। রাজসভা ছাড়িয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি এই স্টেটমেন্টের। গলায় নরম কাপড়ের গলাবন্ধ, হালকা হিল জুতা আর রাজার সম্মানে উইগ—খুব সহজে ইউরোপের এপার-ওপার পৌঁছে গেল নতুন ধারার সূচনাকারী এই স্টাইল।
১৯৩০-এর হলিউড
গেল অনেকটা সময় পেরিয়ে। হলিউডের হাত ধরে মানুষ পরিচিত হয় মেট্রোসেক্সুয়াল বিউটি কনসেপ্টের সঙ্গে। রানি ভিক্টোরিয়া ১-এর প্রভাব ছড়িয়েছিল দ্রুতই। এবারে অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়েই পুরুষদের সৌন্দর্য তুলে ধরা হচ্ছিল জনসমক্ষে। নারীদের মতো পুরুষেরাও যে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন, তা যেন অজানাই ছিল সবার। আমেরিকায় পুরুষদের সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে সবে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল স্যালন আর মেল পারলারগুলো। ক্লার্ক গ্যাবলের স্লিক লুক ছিল সবার জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।
সত্তর থেকে আশির রেট্রো ম্যান
১৯৬৭ সালে ওয়ে বেন্ডি, ১৯৮২ সালে কেভিন ওকিন—মূলত হলিউডের মেল সেলিব্রিটিদের সাজসজ্জায় আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তারাই। এ ছাড়া স্কট বার্নসের মেকআপ ব্রাশের জাদুতে হলিউড তারকারা মাতিয়েছেন রুপালি পর্দা। মেইনস্ট্রিম রক অ্যান্ড রোল কালচারে ডেনিমের ব্যবহার, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, কিংবা হারকিউলিসের লম্বা চুল, সাজসজ্জায় মিনিমালিজম আর কিউট বয় লুকে কুপোকাত হয়েছে অনেক নারীহৃদয়। আশির দশকের মেকআপ আর্টিস্টরা ভেঙেছেন অনেক নিয়ম; তৈরি করেছেন মেল বিউটি রেজিম। তাদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল মিলেছে, যখন বিশ্বজুড়ে পুরুষেরা নিজেদের সাজিয়েছেন নতুন করে; হোক সে বলিউডের সঞ্জয় দত্ত থেকে ঋষি কাপুর, কিংবা বাংলার জসীম থেকে ফারুকের মতো তারকারা।
নতুন শতাব্দীতে
আমেরিকান পপ কালচারের আবির্ভাব, আর মেল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন চমক—দুই-ই ছিল ২০০০ এর আলোচ্য বিষয়। ‘গাইলাইনার’ নামটির সঙ্গে যারা বিশেষভাবে পরিচিত নন, মনে পড়ে কি জ্যারেড লেটো আর অ্যাডাম লেমবার্টের কথা? জনি ডেপের কাজলে মাখা চোখের প্রেমে পড়েননি এমন নারী পাওয়া দুষ্কর। মেট্রোসেক্সুয়ালিটির একটা আপডেটেড ভার্সন আর তার সঙ্গে মেল মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনত্বের হাওয়া নিয়ে খুব সুন্দরভাবে খেলেছেন সময়ের শীর্ষ মেল মেকআপ আর্টিস্টরা।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পুরুষত্ব
বিউটি স্ট্যান্ডার্ড দুমড়ে-মুচড়ে দিতেই নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্ম! সময়টা ২০১০। পুরোটাই তো রেভল্যুশন, ফেসবুক, চ্যাট সাইট, অ্যান্ড্রয়েড ফোন, ছবি তোলার হিড়িক, নিজেকে আরও ফুটিয়ে তোলার প্রতিযোগিতা—সবই যেন নতুন লাগে। কভারগার্ল, মেবেলিনের মতো ব্র্যান্ডগুলো তখন মাত্র মেল গ্ল্যামস্টারদের টার্গেট করতে শুরু করেছে, বছর না ঘুরতেই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের তালিকায় যোগ হয়েছেন মেল মডেলরা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এর আগে পুরুষদের নিজেদের লুক নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেছে কমই; যা শুধু ছিল আগে রুপালি পর্দায়, হাতে মুঠোফোন আসায় নির্দ্বিধায় শেয়ার করা যায় অন্যের সঙ্গে, তবে কেনইবা সাজসজ্জা প্রাধান্য পাবে না। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সহজে খোঁজা সম্ভব কীভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়।
ভূত ভবিষ্যতের মাঝে বর্তমান
ক্লিনজার, টোনার, ময়শ্চারাইজার, সানস্ক্রিন- চেকলিস্ট ডান। ফাউন্ডেশন, ব্রোঞ্জারে ঢেকে যাচ্ছে ত্বকের সব খুঁত। নিজেকে প্রেজেন্ট করা চাই একদম প্রপারম্যান হিসেবে, এই তো বর্তমানের ম্যান মেকআপ থিউরি। থ্যাংকস টু কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি। ব্রাও জেল, লিপ বাম আর সান প্রোটেকশন স্প্রে যেন সবার সঙ্গী। শুধু সেলিব্রিটি নয়, নিজেকে সাজাচ্ছেন সাধারণ পুরুষেরা। প্রেজেন্টেশন, ডেট নাইট কিংবা কোনো টুর্নামেন্টে প্রস্তুত থাকছেন প্রতিনিয়ত।
এখন লিঙ্গভেদে সবার জন্যই এসেনশিয়াল স্কিন কেয়ার মাস্ট। বৈরী আবহাওয়া, স্ট্রেস, ডায়েট্রি ইস্যু—সব মিলিয়ে ত্বক যেন দেহের আয়না; সেই মুখচ্ছবি যদি সুন্দর না লাগে, তবে কী করে সম্ভব আত্মবিশ্বাসী থাকা? নিজেকে মেলে ধরতে করতে হবে যাচাই-বাছাই; নিজের জন্য খুঁজে নেওয়া চাই আলটিমেট মেকওভার।
বিদিশা শরাফ
মডেল: নাহিদ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: ক্যানভাস
