সঙ্গানুষঙ্গ I নকশার নেপথ্যে
বহুবিস্মৃত ইতিহাসের বার্তাবাহক। নকশায় লুকায়িত গভীর প্রতীকী ব্যাখ্যা। প্রাগৈতিহাসিক থেকে প্রাগাধুনিক সময়ের যাত্রাপথে যার জৌলুশ আজও অক্ষুণ্ন
গয়না। কেবল সৌন্দর্য বাড়ানোর উপকরণ নয়; এটি প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকার, সামাজিক মর্যাদা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতির এক অমূল্য ভান্ডার। প্রতিটি অলংকারে লুকিয়ে থাকে গভীর প্রতীকী অর্থ, যা জীবনযাপনের অংশ। শুভ লক্ষণ ও আশীর্বাদের প্রতীক।
ভারতীয় উপমহাদেশে গয়নার ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থানে আবিষ্কৃত পুঁতির মালা, শঙ্খের বালা ও সূক্ষ্ম কারুকাজ করা ধাতব অলংকার প্রমাণ করে, সেই প্রাচীনকাল থেকে অলংকার কেবল শৌখিন সাজসজ্জা নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা ও পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য প্রতীক ছিল। বহু আগে থেকে সোনা, রুপা ও রত্ন এই সংস্কৃতিতে শুভ, শক্তির উৎস ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই ধাতু ও রত্নের মধ্যে এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি নিহিত আছে, যা অশুভ শক্তি দূর করে, সৌভাগ্য ডেকে আনে এবং সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করে। তাই পরনের প্রতিটি নেকলেস, কঙ্কণ আর কানের দুল কেবল সৌন্দর্যের অংশ নয়, বরং হয়ে ওঠে ভালোবাসা, আস্থা ও সুরক্ষার প্রতীক; যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলে।
এই উপমহাদেশের প্রতিটি রাজ্য ও অঞ্চলের গয়নার ধরন আর নকশায় আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। বঙ্গীয় ললনাদের সাজে শাঁখা-পলা, নোয়া, সোনার চূড়া ও বড় নথ অনিবার্য উপাদান, যা শুধু শৃঙ্গার নয়, নারীর মর্যাদারও প্রতীক। দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় টেম্পল জুয়েলারি, মুকুটের মতো মাথার অলংকার ও কোমরবন্ধ, যা দেবদেবীর মূর্তি ও মন্দির স্থাপত্যের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত। রাজস্থান ও গুজরাটের নারীরা পরেন পোড়া সোনার নকশার ভারী হার, বোরলা (মাথার গয়না) ও চোকার, যা রাজকীয় ঐতিহ্য বহন করে। পাঞ্জাবি মেয়েদের চূড়া, ঝুলন্ত কালিরা ও বড় কানের দুল তাদের আঞ্চলিক পরিচয়কে উজ্জ্বল করে তোলে। যদিও নকশা ও উপকরণে এত বৈচিত্র্য রয়েছে; তবু পদ্মফুল, ময়ূর, সূর্য, চাঁদ বা লতাপাতার মতো মোটিফ প্রায় সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়, যা সৌন্দর্যের পাশাপাশি সমৃদ্ধি, পবিত্রতা, শুভ লক্ষণ ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে।
পাখি: স্বাধীনতা, প্রেম ও সৌভাগ্যের চিহ্ন
শিল্পকলায় পাখিকে দেবতার দূত, সুখবরের বাহক এবং আত্মার মুক্তির প্রতীক হিসেবে চিত্রণ করা হয়েছে। ময়ূর, যা সৌন্দর্য, মর্যাদা ও অমরত্বের প্রতীক, কৃষ্ণের মুকুটে তার পালক দিয়ে প্রেমের চিরন্তনতা প্রকাশ করে। তোতা প্রেম ও বিশ্বস্ততার প্রতীক, যা প্রায়ই হার, কানের দুল বা মঙ্গলসূত্রে দেখা যায়। বাজপাখি গতি, শক্তি, প্রখর দৃষ্টি ও সাফল্যের প্রতীক হিসেবে রাজকীয় গয়নায় স্থান পেয়েছে। বহুপ্রাচীন রাজবংশের রাজচিহ্ন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। রাজহাঁস, যা সরস্বতী দেবীর বাহন, জ্ঞান, সৌন্দর্য ও চিরন্তন প্রেমের প্রতীক হিসেবে অলংকারের নকশায় এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এভাবে পাখির মোটিফ কেবল শৈল্পিক সৌন্দর্যই নয়; বরং এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির গভীর প্রতীকী অর্থও বহন করে।
হাতি: শক্তি, জ্ঞান ও সমৃদ্ধির প্রতীক
অত্যন্ত শুভ ও পবিত্রও বটে। প্রাচীনকাল থেকে এই প্রাণী শক্তি, স্থিতি, জ্ঞান, দীর্ঘায়ু ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে; নতুন জীবনের সমস্ত বিঘ্ন দূর করে সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচনে। অনেক রাজবংশে হাতি ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রাজকীয় মুদ্রা, অলংকার ও পোশাকে ব্যবহৃত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির গয়নায় হাতির নকশা বিশেষ জনপ্রিয়, যা আশীর্বাদ, ধন-সম্পদ ও সুস্থতার বার্তা বহন করে; পাশাপাশি, প্রাণীটি ধৈর্য, পারিবারিক বন্ধন ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবেও গয়নার নকশায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যা জীবনের স্থিতি ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।
সূর্য ও চাঁদ: শক্তি ও কোমলতার ভারসাম্য
ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রে সূর্য ও চাঁদকে জীবনের দুই বিপরীত অথচ পরিপূরক শক্তি হিসেবে দেখা হয়, যা মিলিত হয়ে এক অনন্য সংগতি তৈরি করে। সূর্য প্রাণশক্তি, শক্তি, সাহস ও নেতৃত্বের প্রতীক; এটি জীবনের আলোকবর্তিকা, যা অন্ধকার দূর করে নতুন সূচনার পথ দেখায়। অন্যদিকে, চাঁদ কোমলতা, সৌন্দর্য, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও জ্ঞানের প্রতীক; এটি মানসিক শান্তি ও আবেগের স্থিরতা প্রদান করে। বিয়ের গয়নায় সূর্য ও চাঁদের মোটিফ নবদম্পতির সম্পর্কের পূর্ণতা, পারস্পরিক সম্মান এবং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে একে অপরকে সমর্থনের অঙ্গীকারকে প্রকাশ করে।
ফুল: প্রেম ও সমৃদ্ধির প্রস্ফুটন
ফুলের মোটিফ প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশের অলংকারের অন্যতম প্রধান নকশা, যা কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, গভীর প্রতীকী অর্থের জন্যও সমাদৃত। ফুল মানে জীবন, নতুন সম্ভাবনার প্রস্ফুটন, সমৃদ্ধি ও আনন্দের বিস্তার। প্রাচীন ভারতীয় শিল্পে ও মন্দিরের ভাস্কর্যে ফুলের নকশা দেখা যায়, যা প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন প্রকাশ করে। পদ্মফুলকে আধ্যাত্মিকতা, পবিত্রতা ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এটি কাদাজল থেকেও পবিত্র ও নির্মলভাবে প্রস্ফুটিত হয়, যা জীবনে প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্য ও শান্তি অর্জনের বার্তা দেয়। গোলাপ প্রেম, সৌন্দর্য ও আবেগের প্রতীক; এর কোমল পাপড়ি ও মাদকতা ভালোবাসার কোমলতা ও গভীরতাকে বোঝায়। এ ছাড়া জুঁই, গাঁদা ও চাঁপা ফুলের মোটিফও বিভিন্ন অঞ্চলের বধূ অলংকারে ব্যবহৃত হয়; যা সুগন্ধ, আনন্দ ও শুভ লক্ষণ প্রকাশ করে।
মাছ: উর্বরতা, প্রাচুর্য ও শুভ লক্ষণ
মাছের মোটিফ ভারতীয় অলংকারে একটি গভীর অর্থবহ ও ঐতিহ্যবাহী নকশা, যা উর্বরতা, প্রাচুর্য ও শুভ লক্ষণ হিসেবে পরিচিত। বিশেষত বাংলা ও দক্ষিণ ভারতে এই নকশার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বাংলার সংস্কৃতিতে মাছ কেবল খাদ্য নয়, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক; বিয়ের সময় কনের গয়নায় মাছের নকশা অন্তর্ভুক্ত করা হয় নবদম্পতির সংসারে ধন-সম্পদ, সন্তানের সুখ ও শান্তি কামনায়। হিন্দু পুরাণে মাছের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি হলো মৎস্য অবতার, যেখানে ভগবান বিষ্ণু মাছের রূপ নিয়ে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন। এই কাহিনি মাছকে জীবনের রক্ষক ও পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ময়ূরের পালক: আধ্যাত্মিকতা ও রাজকীয়তা
ময়ূরের পালক তার রঙের অপূর্ব মিশ্রণ ও নকশার জন্য দৃষ্টিনন্দন হলেও এর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যও সমান গভীর। হিন্দু পুরাণে ময়ূরের পালক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম পরিচিত অলংকার, যা কৃষ্ণপ্রেম, ভক্তি ও আত্মিক সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজস্থানি ও দক্ষিণ ভারতীয় বিয়ের গয়নায় ময়ূরের পালকের মোটিফ বিশেষ জনপ্রিয়, যা বধূর সাজে আনে ঐশ্বর্য ও গাম্ভীর্যের ছোঁয়া।
শিরীন অন্যা
মডেল: সিমলা মিম ও আরনিরা
মেকওভার: পারসোনা
জুয়েলারি: ক্যানভাস বাই তন্বী কবির
ছবি: কৌশিক ইকবাল
