skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I প্যালিও ডায়েট

দূর অতীতের বিশেষ ডায়েট। হালে আবারও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। কীভাবে একে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত, রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

মানবজাতির প্রাচীন খাদ্যাভ্যাস থেকে এসেছে প্যালিও ডায়েট। সেই প্রস্তর যুগ বা গুহামানব যুগের খাদ্যাভ্যাস। তাই একে অনেক সময় ‘কেইভম্যান ডায়েট’ বা ‘স্টোন এইজ ডায়েট’ও বলা হয়। সেই ইতিহাসে নজর বোলালে দেখা যায়, মানুষের তখনকার খাদ্যাভ্যাস ছিল বেশ ভিন্ন। যেমন প্রায় ১০ হাজার থেকে ২৫ লাখ বছর আগে, মানুষ যখন প্রাণী শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ করে জীবনযাপন করত, অর্থাৎ প্যালিওলিথিক (প্যালিও) যুগে তাদের প্রধান আহার্য ছিল মাংস, মাছ, ফল, শাকপাতা, বাদাম, মূলজাতীয় খাবার। কৃষি কাজ ও পশুপালন যেহেতু তখনো শুরু হয়নি, তাই শস্য উৎপাদনের সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া দুগ্ধজাত খাবারের চলও সে সময় শুরু হয়নি।
কৃষিব্যবস্থা প্রচলনের পর থেকে মানুষ ভাত, গম, যব, ভুট্টা, ডাল ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে খাদ্যাভ্যাস বদলে যায়, যা ধাপে ধাপে এসে পৌঁছেছে আজকের আধুনিক খাদ্যতালিকার চিত্রে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে মানুষের শারীরিক নানা সমস্যায়ও। খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলের কারণে কমতে শুরু করেছে আয়ুষ্কাল। তাই দীর্ঘ জীবন পেতে অসুস্থতা থেকে দূরে থাকার বাসনা কম-বেশি সবার মনে কাজ করে। ফলে অনেকে মানতে শুরু করে দিয়েছেন অতীতের নানা রকম ডায়েট। সেগুলোর মধ্যে প্যালিও ডায়েট পাচ্ছে বিশেষ জনপ্রিয়তা। এর অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, আমাদের দেহ এখনো আধুনিক খাদ্যের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারেনি। জেনেটিক গঠনে মানুষ এখনো প্রাচীন যুগের মতোই আছে। তাই প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি, পরিশোধিত তেল বা শস্য আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রতিটি ডায়েটেরই কিছু রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন রয়েছে। বিভিন্ন ডায়েটে রয়েছে ভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও রিকমেন্ডেশন। প্যালিও ডায়েটও কিছু কিছু খাবার সমর্থন করে, আবার এই খাদ্যতালিকার রয়েছে কিছু খাবারে নিষেধাজ্ঞাও। এই ডায়েট অনুসরণ করলে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও শাকসবজি, বাদাম, বীজ, মাংস; বিশেষত ঘাস খাওয়া প্রাণীর মাংস, পোলট্রি, মাছ, ডিম খাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে শস্য; যেমন চাল, গম, যব, ভুট্টা এবং ডালজাতীয় খাবার, মিল্ক ও ডেইরি প্রোডাক্ট, যেকোনো প্রসেসড ফুড, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড, সুগার ও লবণ এ খাদ্যতালিকায় রাখা বারণ।
উপকারী ভূমিকা
প্যালিও ডায়েটের উপকারিতা নিয়েছে গবেষণার অন্ত নেই। সেগুলোর সূত্রে জানা যায়, এই ডায়েট অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
 প্রসেসড ফুড ও অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার পর খুব দ্রুত ওজন বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে দেখা দিতে পারে ফ্যাটি লিভার। কেক, টমেটো সস, আচার, জ্যাম, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, সফট ড্রিংকস, চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সসেজ, নাগেটস, প্রক্রিয়াজাত মাংস, চিনিযুক্ত চকলেট, চিনিযুক্ত চা, মিষ্টান্ন ইত্যাদির জায়গা প্যালিও ডায়েটে একেবারেই নেই। এসব খাবার বাদ দেওয়া গেলে ক্যালরি কমে যায়, লিভারের সুস্থতা ফিরে আসতে থাকে এবং ওজন কমতেও সাহায্য করে।
 প্যালিও ডায়েট রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক। এ ধরনের ডায়েটে শস্য ও প্রসেসড সুগার বাদ দেওয়া হয় বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমে আসে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকার মেলে।
 হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে এ ডায়েট উপকারী। শুধু প্রাকৃতিক খাবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ করা হয় বলে রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাড়তি কোলেস্টেরল কমিয়ে, মেদ ভুঁড়ি ঝরিয়ে, শরীর ফুরফুরে রাখতে সাহায্য করে প্যালিও ডায়েট।
 পেট পরিষ্কার না থাকলে সারা দিনে খাবার গ্রহণ কেমন যেন অস্বস্তির হয়ে ওঠে। অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা হতে পারে শুধু কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে। প্যালিও ডায়েট এ ধরনের সমস্যার সমাধান এবং হজমশক্তি উন্নত করে। এই ডায়েটে যেহেতু প্রচুর আঁশযুক্ত ফল ও শাকসবজি খাওয়া হয়, তাই কোষ্ঠকাঠিন্য কমে এবং হজমতন্ত্র সুস্থ থাকে।
 অতিরিক্ত প্রসেসড ফুড বাদ দিলে শরীরের টক্সিন কমতে শুরু করে। প্যালিও ডায়েটে যেহেতু সবই ন্যাচারাল খাবার এবং এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ ডায়েট, তাই শরীর ডিটক্সিফাই করে। এতে ক্লান্তি কমে যায় এবং স্বাভাবিক এনার্জি বাড়ে।
সবিশেষ সতর্কতা
প্রতিটি নতুন গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন চিকিৎসাসেবা হালনাগাদ করা হয়। তাই গবেষণায় পাওয়া গেছে, প্যালিও ধরনের ডায়েটের কিছু সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকিও বিদ্যমান।
 কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি আমাদের শরীরে শক্তি প্রদান, কোষ ও হাড়ের সুস্থতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। শস্য, ডাল ও দুগ্ধজাত খাবার ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম ও ফাইবারের দারুণ উৎস। তাই দীর্ঘদিন প্যালিও ডায়েট অনুসরণে শরীরে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
 খরচ বিবেচনায় অন্যান্য ডায়েটের চেয়ে প্যালিও ডায়েট বেশ ব্যয়বহুল। এটি মূলত মাংস, মাছ, বাদাম ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় খরচ পড়ে তুলনামূলক বেশি।
 এই ডায়েটে ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের সামঞ্জস্য থাকে না বলে শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে এটির অনুসরণ উপকারের বদলে ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
 প্রিয় খাবার; যেমন ভাত, রুটি, ডাল, দুধ বাদ দেওয়া দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। অনেক সময় চর্চাকারী নিরাশ হতে শুরু করেন। ফলে মাঝপথেই ছেড়ে দিতে পারেন প্যালিও ডায়েট চর্চা।
প্রত্যেক মানুষেরই শরীরের চাহিদা আলাদা। তাই একই ডায়েট সবার জন্য কার্যকর না-ও হতে পারে। প্যালিও ডায়েটের অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সঠিক জ্ঞান ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ পুরোপুরি এ ডায়েট শুরু করলে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top