skip to Main Content

যাপনচিত্র I স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রতিচ্ছবি

ব্যস্ত নগরজীবনে সুস্বাস্থ্য ও ফিটনেস যেন একধরনের চ্যালেঞ্জ। সময়ের অভাব, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন আর অজস্র ভ্রান্ত ধারণার মাঝেও যারা নিজেদের সুস্থ ও সচল রাখতে সক্ষম, তারা সত্যিকার অর্থেই অনুকরণীয়। তেমনই এক ব্যক্তিত্ব নিবরাস পান্নি; বাংলাদেশের ফিটনেস জগতে পরিচিত নাম। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফাইড ফিটনেস কোচ হিসেবে তিনি অনেককে অনুপ্রাণিত করছেন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে

নিবরাস পান্নির গল্প শুধু শারীরিক অনুশীলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আত্মশৃঙ্খলা, মানসিক দৃঢ়তা এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এক অনবদ্য যাত্রা। তার জীবনধারা, চিন্তাভাবনা ও কর্মনিষ্ঠা আধুনিক বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসচেতন প্রজন্মের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। তিনি ২১ বছরের বেশি সময় ধরে ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। বর্তমানে আমরাঅ্যাকটিভ জিমের নির্বাহী পরিচালক।
প্রাত্যহিক দিনগুলোতে দুই ছেলের সঙ্গে জিমে কাটানো দুই ঘণ্টা তার কাছে দিনের সেরা সময়। একসঙ্গে ওয়ার্কআউট করেন। বললেন, ‘এক দশক ধরে আমি সিঙ্গেল মাদার। বাচ্চারা আমার কাছে কেবল সন্তান নয়, বন্ধুও। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত আমি ওদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া নিই না। দুই সন্তানের বয়স ২২ ও ২৫।’ রাতে বাসায় ফিরেও সন্তানদের সঙ্গে ঘণ্টাদুয়েক গল্প করেন। বললেন, ‘ওরা আমার কাছে প্রাইড অ্যান্ড জয়।’
নিবরাস ইনসোমনিয়াক। রাত দুইটার আগে ঘুমোতে পারেন না। সকালে ক্লাস নেন আর দুপুর থেকে অফিস করেন। সপ্তাহে তিন দিন পারসোনাল ট্রেনিং করান, যা শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটা থেকে নয়টায়। এমন দিনে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েন। সপ্তাহের অন্য দিন বেলা ১১টা থেকে ক্লাস নেন। সেই দিনগুলোতে বিছানা ছাড়েন একটু দেরিতে।
তিনি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করছেন সাত বছরের বেশি সময় ধরে। তার সর্বোচ্চ ওয়াটার ফাস্টিংয়ের রেকর্ড পাঁচ দিন। ওয়াটার ফাস্টিং করে ওয়ার্কআউটের সময় শরীরে শক্তির জোগান পান কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘টানা পাঁচ দিন ওয়াটার ফাস্টিংয়ের সময় পানির সঙ্গে ইলেকট্রোলাইট মিশিয়ে পান করেছি। এ সময় চার দিন করেছি হেভি ওয়েট লিফটিং। আমার সর্বোচ্চ লেগপ্রেস ১৭৫ কেজি, ডেডলিফট ৭০ কেজি, বারবেল স্কোয়াট ১২০ কেজি; ২৪ কেজি কেটেলবেল দিয়ে প্রতি সেটে ১০০টি করে মোট ১ হাজার বার অনুশীলন করতাম।’ এমনকি দুই বছর আগপর্যন্ত টানা ৩৬ ঘণ্টা ওয়াটার ফাস্টিংয়ের অভ্যাস ছিল তার।
দুপুর বা বিকেল থেকে শুরু করে দিনে দু-তিনবার খাবার গ্রহণ করেন নিবরাস। ইদানীং লং ফাস্টিং করছেন না। পারসোনাল ট্রেনিংয়ে ডাম্বেল, বারবেল, কেটেলবেল ও মবিলিটি অনুশীলনে গুরুত্ব দেন। তিনি মূলত মবিলিটি ট্রেনিং স্পেশালিস্ট। সকালে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে পান করেন ডিটক্স ওয়াটার; তাতে জিঞ্জার জুস, লেবুর জুস, অ্যাপল সাইডার ভিনেগার, সিনেমান পাউডার, কোলাজেন পাউডার ও ক্রিয়েটিন থাকে। ক্রিয়েটিনকে তিনি ব্রেইন ফুড দাবি করেন, যা মস্তিষ্কের কোষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুপুরে কিংবা বিকেলে দিনের প্রথম মূল খাবারের মেনুতে রাখেন ডিম ও শাকসবজি। সঙ্গে বাটার ও ঘি খেতে ভীষণ পছন্দ করেন। রাতে বাসায় ফিরে ডিমের সঙ্গে বরবটি, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো। কখনো কখনো হাফ অথবা কোয়ার্টার চিকেনের সঙ্গে দুটি লেস প্রসেসড সসেজ। মনমর্জি সায় দিলে পর্যাপ্ত মাংস ও সবজি দিয়ে পোলাও অথবা খিচুড়িতেও উদর পূর্তি করেন কালেভদ্রে। তবে বাইরে থাকলে স্টেকের সঙ্গে সবজি।
প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করেন বলে প্রতিদিন এক স্কুপ প্রোটিন শেক পানের অভ্যাস আছে নিবরাসের। অভিজ্ঞতার আলোকে জানালেন, ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী যারা ওয়ার্কআউট করেন, তাদের জন্য ক্রিয়েটিন, ওমেগা থ্রি, মাল্টিভিটামিন, ভিটামিন ডি, বি ১২ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের জন্য আয়রনের কথা বললেন আলাদাভাবে। সাপ্লিমেন্টের বাইরে ফলের মধ্যে পেয়ারার কথাও জোর দিয়ে জানালেন তিনি।
ভ্রমণে গেলে এমন হোটেল কিংবা এয়ারবিএনবি পছন্দ করেন, যেখানে অথবা যেটির নিকটবর্তী স্থানে জিম রয়েছে। সন্তানদের নিয়ে ওয়ার্কআউট করে তারপরই নিবিড়ভাবে উপভোগ করেন সেসব জায়গার নান্দনিকতা। কমপক্ষে ১৫টি দেশ ঘুরেছেন তিনি। আলাদাভাবে জানালেন লন্ডনের কথা। পাইলটের মেয়ে হিসেবে নিবরাস যখন পড়াশোনা শুরু করেন, বাবার পেশাগত কারণে তাদের অবস্থান ছিল সেই শহরে। তখন থেকে লন্ডন তার আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ১৩ বছর বয়স থেকে একা ভ্রমণ শুরু তার। তখন থেকে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দুই মাসের জন্য লন্ডনে চলে যেতেন। কথা বলছি এমন এক সময়ের, যখন তথ্যপ্রযুক্তি বর্তমানের মতো অগ্রসর হয়নি; প্রচলন ঘটেনি সেলফোন কিংবা ইন্টারনেটের। হিথরো বিমানবন্দর থেকে একা একা চলে যেতেন ফুফুর বাসায়। এটি তাকে স্বাধীনচেতা হতে শিখিয়েছে।
ভ্রমণ সম্পর্কে নিবরাস বললেন, ‘ইউ নট অনলি সি দ্য ওয়ার্ল্ড, ইউ লার্ন দ্য ওয়ার্ল্ড। ইট’স দ্য লার্নিং প্রসেস হোয়েন ইউ ট্রাভেল।’ সন্তানদের নিয়ে ভ্রমণ ঘিরে তার ভাষ্য, ‘এটি ওদের গ্র্যান্ড এক্সপোজার দেয়। সিঙ্গেল মাদার হওয়ার সময়ই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার জম্ম ও বেড়ে ওঠা যেভাবে, সন্তানদেরও তেমন জীবন দিতে চাই।’ তার আরেকটি পছন্দের ভ্রমণ ডেস্টিনেশন থাইল্যান্ড, যেখানে সম্প্রতি একাধিকবার গেছেন। ফান টাইম কাটানোর নানা রকম বিকল্পের কারণেই দেশটি তাকে এত টানে।
এই সেলিব্রিটি ফিটনেস কোচ দিনের অনেকটা সময় কাজের সঙ্গে গানের সঙ্গ নেন। আশির দশকে রেট্রো পপ মিউজিক তার পছন্দের শীর্ষে। প্রিয় শিল্পী জর্জ মাইকেল, ম্যাডোনা, টিনা টার্নার। পপ জনরার বাইরে পিংক ফ্লয়েড, জিম মরিসন, জন লেনন, ফ্লিটউড ম্যাক, পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার গান, বাপ্পা মজুমদার, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবীর গানে বুঁদ হয়ে থাকেন। আউট অব দ্য বক্স সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। জাব উই মেট, আর্থ, রুহি, দ্য হলিডে, ডার্টি ড্যান্সিং, ফ্ল্যাশড্যান্স ও সেভেন তার প্রিয় সিনেমা; পছন্দের টিভি সিরিজ দ্য ক্রাউন। প্রিয় অভিনেতা রাজকুমার রাও, হৃতিক রোশন, কেভিন স্পেসিস।
ওয়ার্কআউট রুটিন সম্পর্কে জানালেন, প্রতিদিন ২০ মিনিট কার্ডিও করেন। স্ট্রংগেস্ট পার্ট অব দ্য বডি লেগ, তাই ক্রস ট্রেনিংয়ে করেন স্বচ্ছন্দবোধ। সপ্তাহে তিন দিন লেগ, আর তিন দিন আপার ও লোয়ার বডি মিলিয়ে এক্সারসাইজ করেন। তবে বাসায় থাকলে টিভি দেখে কিংবা পডকাস্ট শুনে ওয়াকপ্যাডে হাঁটেন এক ঘণ্টা। নিবরাস বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন, তিনি পডকাস্ট হোস্ট এবং পডকাস্ট লাভার। পৃথিবীর অনেক কিছুই, বিশেষ করে হেলথ ও ফিটনেসবিষয়ক অনেক জ্ঞান পেয়েছেন পডকাস্ট থেকে। অ্যান্ড্রু হিউবারম্যান, স্ট্যাসি সিমস, জো রোগান, শ্যালিন জনসন, পল স্যালাডিনো, পল রসোলির পডকাস্ট তার অনেক বড় অনুপ্রেরণা। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া এসব পডকাস্ট শোনা যে সম্ভব ছিল না, তা-ও মনে করিয়ে দিলেন।
শাড়ি, ওয়েস্টার্ন ও ওয়ার্কআউট কস্টিউমে তাকে বেশি দেখা যায়। শাড়ি সবচেয়ে প্রিয়। পছন্দের রং নির্দিষ্ট নেই; তবে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করায় কালার কম্বিনেশন সম্পর্কে তার আছে স্বচ্ছ ধারণা। অবশ্য কাপড় থেকে ফ্যাশন—সবকিছুতেই মিনিমালিস্টিক তিনি। ফ্যাশন তার কাছে এককথায় স্টেটমেন্ট; আর তা অবশ্যই একটি ইনডিপেনডেন্ট স্টেটমেন্ট। নিবরাস বলেন, ‘আই অ্যাম মাই ওন স্টেটমেন্ট অ্যান্ড ইট কান্ট বি কম্পেয়ারড বাই আদারস।’ গুলশানে অবস্থিত জাপানিজ রেস্টুরেন্ট উমাইয়ের মেনু, ডেকোরেশন, ইন্টেরিয়রসহ অনেক কিছুই রিইনোভেট হচ্ছে তার দিক-নির্দেশনায়।
অ্যাথলেট কিংবা ফিটনেস কোচরা কোন ধরনের জুতা পছন্দ করেন, তা জানতে মুখিয়ে থাকেন অনেকে। নিবরাসের জুতা বা স্নিকারের সংগ্রহ বিশাল। টোরি বার্চ, জারা থেকে শুরু করে মিজুনো, অ্যাডিডাস, নাইকি, ফিলা, নিউ ব্যালেন্স পছন্দের ব্র্যান্ড। ব্যাগের ক্ষেত্রে টরি বার্চ, মাইকেল কোর্স, চার্লস অ্যান্ড কিথ ও মাসিমো দুতি এবং পারফিউম ব্র্যান্ড হিসেবে বারবেরি উইকেন্ড ও জো মেলন তার পছন্দের শীর্ষে। বাসায় ফার্নিচারে উডেন, মেহগনি, ব্রাউন ও অব হোয়াইট কালারের আধিক্য। বাসাজুড়ে রয়েছে নানা ধরনের লাইট—শ্যান্ডেলিয়ার, ওয়ার্ম লাইট, স্পট লাইট, ল্যাম্প, এমনকি ওয়াশরুমে ফেইরি লাইট।
প্রাণিকুলের প্রতি তার ভীষণ মমত্ববোধ কাজ করে। রয়েছে মারিও, লুলু, গোকু, জিজি ও কিচি নামে পাঁচটি পোষা বিড়াল। ফিটনেস-সম্পর্কিত মিথ প্রসঙ্গে বললেন, অনেক নারীরই ধারণা, ওয়ার্কআউট করলে ছেলেদের মতো মাসল হয়ে, পুরুষালি দেখাবে। এই মিথে বিশ্বাস করে কেউ কেউ ওয়ার্কআউট এড়িয়ে চলেন। অথচ সঠিকভাবে দেহচর্চা করলে এবং এক্সট্রা মাসল সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চললে এমনটি ঘটে না। ‘মাসল ইজ লংজেভিটি। যত লিন মাসল ফ্যাট থাকবে, শেষ বয়সে আমরা তত ভালোভাবে হাঁটতে, নিচ থেকে কোনো কিছু ওপরে তুলতে, নিজ হাতে খেতে পারব। মাসল কম থাকলে মবিলিটিও কম থাকবে,’ বললেন নিবরাস। তার জীবনদর্শন, ‘ইউ আর হোয়াট ইউ মেইক ইউরসেলফ টু বি।’

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top