skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I মেটাবলিজম ডায়েট

শুধু ক্যালরি কমাতে নয়; শরীরের প্রতিটি কোষ সক্রিয় রাখতে নিয়মমাফিক পুষ্টি বেছে নেওয়ার উপায়। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ

আমরা যা-ই খাই না কেন, তা শরীর শোষণ করে হজমের পর। এই পুরো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন হয় রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; যাকে বলে মেটাবলিজম। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ হয়তো অনেক খাবার খাচ্ছেন, অথচ ওজন তেমন বাড়েনি; আবার অল্প খাওয়ার পরও কেউ ভুগছেন ওবেসিটি বা ওভার ওয়েটে। আসলে এসব জটিলতা হয় মেটাবলিজমের কারণে।
পরিচয় সন্ধান
মেটাবলিজম এমন এক প্রক্রিয়া বা ধাপ, যা ঘুমের মধ্যেও আমাদের শরীরে সক্রিয় থাকে। সহজ করে বললে, এটি হলো আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে ঘটে চলা অসংখ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে খাবার রূপান্তরিত হয় শক্তিতে, কোষ তৈরি হয় এবং দেহের কার্যক্রম সচল থাকে। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট—এগুলোকে বলা হয় ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট; যা দেহে প্রবেশের পর এনজাইমের মাধ্যমে ভেঙে যায় এবং উৎপন্ন করে গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড ও ফ্যাটি অ্যাসিড। এগুলো কোষের শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এই শক্তি ব্যবহার প্রক্রিয়ার রয়েছে তিনটি ধাপ।
 বিএম আর: অর্থাৎ বিশ্রামরত অবস্থায় যে শক্তি ব্যয় হয়;
 থার্মিক ইফেক্ট অব ফুড: খাবার খাওয়ার পর তা হজমে ব্যবহৃত শক্তি;
 অ্যাকটিভিটি লেভেল অব এনার্জি এক্সপেন্ডিচার: অর্থাৎ দৈনন্দিন কাজ বা ব্যায়ামে ব্যবহৃত শক্তি।
এই তিনের যোগফলই নির্ধারণ করে আমাদের টোটাল মেটাবলিক রেট। সেই রেট স্বাভাবিক রাখতে যে ধরনের খাবারই গ্রহণ করি না কেন, সেগুলো অবশ্যই পুষ্টিসম্পন্ন হওয়া চাই।
উপাদান উৎস
মেটাবলিজম ডায়েট মেইনটেইন করতে নানা রকম পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করা জরুরি।
ভিটামিন ডি
হাড়ের যত্ন ও শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ডির গুরুত্ব মোটামুটি সবারই জানা; তবে মেটাবলিজমের সঙ্গে এর সরাসরি যে সম্পর্ক রয়েছে, তা-ও জানা থাকা জরুরি।
 ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বৃদ্ধি: ভিটামিন ডি ইনসুলিন রিসেপ্টরের কার্যকারিতা উন্নত করে। এর ফলে কোষ সহজে গ্লুকোজ গ্রহণে সক্ষম হয়; যা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, বিশেষত টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
 ফ্যাট মেটাবলিজমে ভূমিকা: শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকলে কোষে ফ্যাট সঞ্চয় কম হয় এবং তা শক্তি উৎপাদনে বেশি ব্যবহৃত হয়। ফলে ভিটামিন ডি ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।
 হরমোন ব্যালেন্স: এ ক্ষেত্রেও ভিটামিন ডির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে; যা আমাদের শরীরে মেটাবলিজমের যে বিশেষ ধাপটি, তা কন্ট্রোলে সাহায্য করে।
বি-ভিটামিন কমপ্লেক্স
মেটাবলিজমের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ধরা হয় ভিটামিন বি কমপ্লেক্সকে। শক্তি উৎপাদন, চর্বি ও প্রোটিন ভাঙন এমনকি নতুন কোষ গঠনে এবং রক্তে অক্সিজেন পরিবহনেও ভিটামিন বি অপরিহার্য। তাই এগুলোর ঘাটতি হলে ক্লান্তি, অবসাদ, ঝিমুনি এমনকি স্লো মেটাবলিজমের উৎপাত বাড়তে পারে।
আয়রন
এটি অক্সিজেন পরিবহনের চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত। আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে, যা কোষে অক্সিজেন সরবরাহে ভূমিকা রাখে। যথেষ্ট অক্সিজেন না পেলে কোষীয় মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়; ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
ম্যাগনেশিয়াম
এনজাইমের প্রাকৃতিক সহায়ক এটি। আমাদের দেহে তিন শতাধিক এনজাইম মেটাবলিজমের জন্য ম্যাগনেশিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া এটি গ্লুকোজ ও ফ্যাটি অ্যাসিডকে এনার্জিতে রূপান্তর করে।
আয়োডিন ও সেলেনিয়াম
এগুলোকে বলা হয় থাইরয়েড হরমোনের বন্ধু। আর থাইরয়েড হরমোনই শরীরের বেসাল মেটাবলিজম রেট (বিএমআর) নির্ধারণ করে। হরমোন তৈরিতে আয়োডিন যেমন প্রয়োজন, তেমনি হরমোনকে সক্রিয় রূপে রূপান্তরে সহায়তা করে সেলেনিয়াম।
প্রাত্যহিক পাতে
মেটাবলিজম সক্রিয় রাখতে সঠিক পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতি অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় কিছু খাবারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা শ্রেয়।
প্রোটিন
এটি শুধু পেশি গঠন করে না; বরং পেশি টিস্যু বিশ্রাম অবস্থাতেও শক্তি ব্যয় করে। অর্থাৎ, যত বেশি পেশি, তত বেশি মেটাবলিজম। তাই প্রতিদিন শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রতি কেজিতে গড়ে ০.৮ থেকে ১ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ডিমের কুসুম ও মাছের তেল
ভিটামিন ডির সেরা উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় এগুলো রাখা যেতে পারে। সকালে নাশতার সঙ্গে একটি ডিম আর সপ্তাহে দু-এক দিন দুপুরে মাছের ডিমের আইটেম রাখা মঙ্গল।
বাদাম, বীজ, সবুজ শাক ও কলা
বাদাম ও বীজজাতীয় খাবার থেকে যথেষ্ট ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়। মধ্য সকালে কিংবা বিকেলের নাশতায় বাড়তি ক্যালরিসমৃদ্ধ স্ন্যাকস বাদ দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন মিক্সড নাট বা সিডস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের স্যালাদ।
আয়োডিনযুক্ত লবণ ও সামুদ্রিক মাছ
থাইরয়েড হরমোনের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আয়োডিনযুক্ত লবণ রাখা আবশ্যক। এ ছাড়া সপ্তাহে দুদিন সামুদ্রিক মাছ পাতে রাখতে পারেন।
রসুন
শুধু খাবারের স্বাদ বাড়াতেই কাজ করে না; এতে থাকা সেলেনিয়াম আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি মেটাবলিজমেও ভূমিকা রাখে।
পানি
শরীরে প্রতিটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া পানির উপস্থিতিতেই ঘটে। ডিহাইড্রেশন হলে কোষীয় কার্যক্রম কমে যায় এবং হজম, পুষ্টি শোষণ এমনকি এনার্জি ব্যয়ও কমে। তাই ফ্লুইড ব্যালেন্সের জন্য সারা দিনে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন।
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন সমন্বয়
সুস্থ থাকতে ফুড হেবিট ও লাইফস্টাইল ব্যালেন্স হওয়া জরুরি। যেসব অভ্যাস আমাদের মেটাবলিজম কমিয়ে দেয়, জীবনযাপনের রুটিন থেকে সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে ফেলা চাই।
 ডায়েট মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়; তাই খুব কম খাওয়া কিংবা অতি ডায়েটিংয়ের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন।
 পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মেটাবলিজম স্লো হয়ে যায়; তাই সঠিক সময়ে ঘুম প্রয়োজন।
 শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শরীরের জন্য কল্যাণকর নয়।
 অতিরিক্ত মানসিক চাপ দিনশেষে অমঙ্গল ডেকে আনে; তাই পরিত্যাগই শ্রেয়।
 ডিহাইড্রেশন বা শরীরে পর্যাপ্ত পানির ঘাটতি যেন দেখা না দেয়, সচেতন থাকুন।
অনেক সময় এসব কারণে যত ক্যালরিই কম খাওয়া হোক না কেন, ওজন কমতে চায় না। অন্যদিকে, কিছু ভালো অভ্যাস আমাদের মেটাবলিজম বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
 সারা দিনে একবারে অনেক খাবার না খেয়ে ছোট ছোট মিল গ্রহণ করা অধিক স্বাস্থ্যকর। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পরপর খাবার গ্রহণের অভ্যাস করতে পারলে রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে এবং এনার্জি ব্যালেন্স সাধিত হয়।
 স্ট্রেন্থ ট্রেনিং বেসাল মেটাবলিজম ও পেশি টিস্যু বাড়াতে সাহায্য করে।
 বিনা প্রয়োজনে রাত না জেগে টানা ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো ভালো। এটি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
 ইয়োগা, মেডিটেশন বা রিলাক্সেশন চর্চা মানসিক প্রশান্তি ও বিপাকক্রিয়ায় সহায়ক। তাই সপ্তাহে দু-তিন দিন ভোরে উঠে স্নিগ্ধ বাতাসে কিছু সময়ের জন্য ইয়োগা বা মেডিটেশন এবং স্ট্রেস রিলিফ করুন।
 রোদ থেকে ভিটামিন ডি উৎপাদিত হয়, হরমোনাল ভারসাম্য বজায় থাকে, ফ্যাট মেটাবলিজমে ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন সকালে বা বিকেলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রোদে থাকা মঙ্গল।
মেটাবলিজম ডায়েট মানে শুধু ক্যালরি কমানো নয়; বরং শরীরের প্রতিটি কোষ সক্রিয় রাখার মতো পুষ্টি বেছে নেওয়া। ভুল ডায়েটের চর্চা করলে হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলে ক্ষতিকর ফল বয়ে আনতে পারে। তাই যেকোনো ডায়েট শুরুর আগে কোনো বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ কিংবা ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top