skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I গুরকানিদের বিয়ের ভোজ

আমরা যাদের মোগল নামে চিনি, তারা মূলত নিজেদের গুরকানি বা তিমুরিদ নামে পরিচয় দিতেন। মোগল শব্দটি মোঙ্গল শব্দের অ্যাংলিসাইজ রূপ, সম্রাট বাবুর যেটাকে শুরুতেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তার বংশপরিচয় থেকে। গুরকানি অর্থ খানদের মেয়ের স্বামী; কারণ, তৈমুর লঙের এই বংশধরেরা খানদের মেয়েদের বিয়ে করতেন আর এ নিয়ে গর্বিত ছিলেন। মোগল রাজদরবারের বিয়ের ভোজ নিয়ে বিশদ লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

গুরকানি তথা মোগলদের বিয়ের ভোজ নিয়ে সেভাবে লিখিত কিছু নেই। কিছু দরবারি প্রথার কথা জানা যায়; কিন্তু খাবারের তালিকার বেলায় বিস্তারিত কিছু নেই। বিভিন্ন বই থেকে যা পাওয়া যায়, সেগুলো বাদশাহর ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। কিন্তু শাহি আয়োজনের খাবারের বর্ণনা মেলে কেবল বাহাদুর শাহ যাফরের ক্ষেত্রেই। তাই আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনার কিছু মেলবন্ধন ঘটিয়েই এগিয়ে যেতে হবে দেখতে যে কেমন ছিল গুরকানিদের বিয়ের ভোজ।

গুরকানিদের ভোজ-উৎসবগুলো ছিল বহুমাত্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যের প্রতীকী আয়োজন। খাবারের সমতা ও ভাগাভাগি একধরনের বন্ধন আর সাহচর্যের সম্পর্ক তৈরি করত। এ ছাড়া ভোজ-উৎসবগুলো কর্তৃত্ব, শ্রেণিবিন্যাস, সম্পদ ও সার্বভৌমের পিতৃতান্ত্রিক ও উদার ভূমিকা প্রকাশ করত। রাজবংশের মহিমা ও ক্ষমতা ভোজের বিলাসবহুল আয়োজনের মাধ্যমে প্রদর্শিত হতো। তাই শাহযাদাদের বিয়ের ক্ষেত্রে সেটা যে কতটা জাঁকজমক নিয়ে আবির্ভূত হতো, তা হয়তো নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ‘পাদশাহনামা’র অলংকরণে হতভাগ্য শাহযাদা এবং হতে পারত ভারত-সম্রাট দারা শিকোহ্র বিয়ের বরযাত্রার ছবিতেই সেটা স্পষ্ট হয়।
প্রাথমিক খাবার দাবার নিয়ে কিছু বর্ণনা আমরা পাই ‘বাবুরনামাহ’ বইয়ে। বাবুর ও হুমায়ুনের সময়ে গুরকানিদের খাবারের বর্ণনা যা মেলে, তার সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য নেই আগেকার দিল্লি সালতানাতের বা তাদের তুর্কো-মোঙ্গল রীতির। বাবুরের দুটি বিয়ের তথ্য মেলে; প্রথমটি চাচাতো বোন আইশা সুলতান বেগমের সঙ্গে, দ্বিতীয়টি মাহাম বেগমের সঙ্গে। কোনো বিয়েরই ভোজপর্বের বর্ণনা তেমন নেই। ভোজের বিবরণ নেই শের শাহ সূরির আক্রমণে পারস্যের দিকে পালাতে থাকা সম্রাট হুমায়ুনের সঙ্গে হামিদা বানুর বিয়েরও।

দারা শিকোহ্র বিয়ের মিছিল

খাবার নিয়ে প্রথম বিস্তারিত বর্ণনা মেলে আবুল ফাযলের ‘আকবারনামা’ থেকে। সম্রাট জালাল-উদ-দিন ওরফে আকবারের রসুইঘরের বিবরণ সেখানে। সেখান থেকে জানা যায়, আকবার সপ্তাহে অন্তত তিন দিন নিরামিশাষী থাকতেন। শাক ও সামোসা তথা শিঙাড়ার প্রতি তার টান ছিল। তার জন্য অন্তত তিন ধরনের রান্না হতো—পারসিক, ভারতীয় ও মধ্য-এশীয়। এর কারণটাও সহজেই অনুমেয়—বাবুরের ভারতে অবস্থান চার বছর, যার ভেতরে যুদ্ধবিগ্রহই ছিল বেশির ভাগ সময়জুড়ে; হুমায়ুন তার দুই দফায় ভারত শাসন করেছেন ১১ বছর—সাম্রাজ্য পেয়েছেন, হারিয়েছেন, নির্বাসনে গিয়েছেন পারস্যে, আবার পুনরুদ্ধার করেছেন—তার পক্ষেও একটি দরবারি খাবার রীতির প্রচলন ঘটানো সম্ভব হয়নি। আকবারের শাসনামল দীর্ঘ, প্রায় অর্ধশতক। ফলে তার পক্ষে দরবারি খাবার, ভোজের একটি রীতি তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। বৈবাহিক সূত্রে ভারতীয় বহু খাবার ঢুকেছে তার হেঁসেলে; আবার বাবা হুমায়ুন ১৫ বছর পারস্যে নির্বাসনের পর যখন ফিরে এসেছিলেন, তখন বৈরাম বেগের মতো পারসিকরাও দরবারে এসেছিলেন তাদের সংস্কৃতি নিয়ে। আবার হারেমে থাকা গুলবদন বেগমের মতো নারীরা টিকিয়ে রেখেছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল তথা মধ্য-এশীয় খাবারের রীতিও। খিচুড়ির প্রতি আকবারের একটা টান ছিল বলে জানা যায়; আর তার দরবারে হাজির হওয়া সবাই সেটার ভাগ পেতেন বলে লেখা আছে। এ জন্য প্রতিদিনই এখনকার মাপে প্রায় ১ হাজার ২০০ কেজি খিচুড়ি রান্না হতো।
খাবার নিয়ে টুকরো টুকরো বর্ণনা আকবার পর্যন্তই। গুরকানি বা তিমুরিদদের রাজকীয় হেঁসেলের খাবার নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই পাই সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময়ে—‘আলওয়ান-ই-নিমাত’ (আভিধানিক অর্থ ‘ঐশ্বর্যের রং’ বা ‘টেবিলের রং’) বইয়ে, যা পুরোপুরি রেসিপির বই। ৪০টি অধ্যায়ে ৩৭৪টি খাবারের রান্নার প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছিলেন লেখক মুন্সি বুল্লাকি দাস। এই বই মূলত সাক্ষ্য দেয়, জাহাঙ্গিরের সময়ে মোগল রসুইঘর আরও ভারতীয় হয়ে উঠেছিল, বিশেষত গুজরাটি খাবারের প্রতি জাহাঙ্গিরের প্রেম দেখা যায়। তার প্রধান স্ত্রী মেহর-উন-নিসা তথা নূরজাহান তো ছিলেনই পারসিক বংশোদ্ভূত। এই বই থেকে আরও জানা যায়, সে সময়ে মসলার এতটা ব্যবহার ছিল না—জিরা, ধনিয়া, জাফরান—এ ধরনের তিন-চার পদের মসলা ব্যবহার হতো; স্বাদের বাকি কাজটা ছেড়ে দেওয়া হতো বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, ফুলের নির্যাস, কস্তুরী, গোলাপ জলের ওপর, খাবারে অনন্য ঘ্রাণও এনে দিত এগুলো। রান্নায় ব্যবহার করা হতো বৃষ্টির পানি। কালিয়া বা পোলাও রান্নাতেও ব্যবহৃত হতো চিনির সিরায় জারিত আম, মাল্টা, কলা, পর্তুগিজদের আনা আনারসের মতো ফল। এই বই-ই বলে, নূরজাহান সাম্রাজ্য দেখাশোনার পাশাপাশি রসবতীও সামলাতেন বেশ ভালোমতোই। জাহাঙ্গিরের প্রিয় খাবার হিসেবে বারবার উঠে এসেছে খিচুড়ির কথা। ‘আলওয়ান-ই-নিমাতে’ও আট রকমের খিচুড়ি রান্নার প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে।

সম্রাট শাহজাহানের সময়ে এ ধরনেরই আরেকটি বই রচিত হয়েছিল, নামহীন লেখকের ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি’ (আভিধানিক অর্থ ‘শাহজাহানের রন্ধনপ্রণালি’)। ‘নুসখা-ই-শাহ জাহানি’কে পোলাওয়ের বই বললেও ভুল হবে না; কারণ, এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ১৫ পদের নান, দ্বিতীয় অধ্যায়ে আশ তথা গ্রেভি, তৃতীয় অধ্যায়ে ৩৯ পদের কালিয়া ও দোপেয়াজা, চতুর্থ অধ্যায়ে ছয় পদের ভর্তা ও পঞ্চম অধ্যায়ে পাঁচ রকমের যের-বিরিয়ান তথা বিরিয়ানির রন্ধনপ্রণালির পাশাপাশি ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৫৬ রকমের পোলাও এবং সপ্তম অধ্যায়ে রয়েছে বেশ কয়েক রকমের মিষ্টি পোলাও। বলা বাহুল্য, জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নূরজাহান, শাহজাহানের সঙ্গে মুমতাজ মহলের বৈবাহিক সূত্রে এই দুই সম্রাটের সময়ে অসংখ্য পারসিকের ঠাঁই হয়েছিল দরবারে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে আগে থেকেই (সুলতানি আমল ও বাবুরের পারস্য নির্বাসন সূত্রে) প্রচলিত পারসিক পোলাও দরবারি খাবারের তালিকায় আরও খানিকটা ওপরের দিকে উঠে যায়; সঙ্গে যোগ হয় আরও নতুন নতুন পোলাও। আবারও মনে করিয়ে দিই, পোলাও হলো দরবারি, রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহদের খাবার; আর বিরিয়ানি লস্করি, তথা সৈন্যদের ও যুদ্ধের ময়দানের ওয়ানপট মিল। তাই যের-বিরিয়ান খাবারটাকে ‘আলওয়ান-ই-নিমাত’ ও ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি’তে দেখে উল্লসিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। আর যের-বিরিয়ান বিরিয়ানির উৎস হলেও বিরিয়ানির সঙ্গে তফাতও রয়েছে ঢের। সে প্রসঙ্গ এখানে আনা সমীচীন হবে না। সম্রাট শাহজাহানেরও খিচুড়িপ্রীতি ছিল বলেই জানা যায়। সম্রাট আওরঙ্গযিব অন্য শাসকদের চেয়ে বেশ ব্যতিক্রম, অন্তত খাবারের দিক থেকে। মিতাহারী, স্বল্পব্যয়ী হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তার প্রিয় খাবার ছিল কাবুলি-ছোলা, আখরোট, কাঠবাদাম আর তুলসীপাতা দেওয়া খিচুড়ি। এ ছাড়া অন্য ধরনের খিচুড়ি আর পাঁচমিশালি ডাল ছিল তার প্রিয় খাবারের তালিকায়।
ভারতবর্ষে বাবুর থেকে আওরঙ্গযিবের সময় পর্যন্ত ‘গ্রেট মোগল’দের সময়কাল বলা হয়। দরবারি জাঁকজমক মূলত শেষ হয়ে গিয়েছিল আওরঙ্গযিবের হাতে, দক্ষিণ ভারতে লড়াইয়ের রসদ জোগাতে। সেই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় নাদির শাহের ভারত আক্রমণ। ফলে গ্রেট মোগলদের খাবারের যা বিবরণ, তাতে আলাদা করে নেই ভোজোৎসবের খাবার-দাবারের বিবরণী; যা আছে সবই তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের খাবারের কথা আর রন্ধনপ্রণালি, বিয়ের বিশেষ খাবারের বর্ণনা তো আরও দূরের গল্প!

হারেমের নারীদের মাঝে একমাত্র পুরুষ দারা শিকোহ্র হিনাবন্দি অনুষ্ঠান, যাকে বাংলার গায়েহলুদ অনুষ্ঠান বলা যায়

গুরকানি বিয়ের বর্ণনা যা মেলে তাতে জানা যায়, বাদশাহ রাজকীয় বিয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও, ভোজ আর উৎসবের দায়িত্ব ছিল হারেমের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের। বিয়ের প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে কনের পরিবারের প্রবীণেরা প্রস্তাব গ্রহণের প্রতীক হিসেবে পান পাঠাতেন বরের বাড়িতে। এরপর বরের বাড়ি থেকে কনের পরিবারে প্রথমবারের মতো বিয়ের উপহার পাঠানো হতো। এরপর একদিন মেহেদিবন্দী অনুষ্ঠান হতো হারেমে, যেখানে বরের হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগিয়ে দিতেন হারেমের নারীরা। মূল বিয়ের অনুষ্ঠানের দিনে শাহযাদা ও অন্য অভিজাতেরা বরের বাড়িতে গিয়ে তাকে বিয়ের উপহার দিতেন। এরপর প্রাসাদ থেকে একটি জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা বের হতো, যেখানে বর সাধারণত হাতি বা ঘোড়ায় সওয়ার হতেন আর তার পিছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কেউ কেউ সাজানো ঘোড়ায় এবং কেউ কেউ হেঁটে দিওয়ান-ই-আম পর্যন্ত যেতেন। সেখানে সম্রাট নিজেই বরের কপালে মুক্তা ও মূল্যবান রত্নে তৈরি সেহরা বেঁধে দিতেন, যেটাকে বলা হতো সেহরাবন্দী। এরপর শোভাযাত্রা বাদশাহকে নিয়ে কনের ঘরের উদ্দেশে যাত্রা করত, যেখানে তাদের আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানানো হতো আর একটি শুভ মুহূর্তে কাজী বাদশাহর সামনে বিয়ে সম্পন্ন করতেন। শেষে নবদম্পতির ওপর সোনা-রুপার মুদ্রা ও মূল্যবান রত্ন বর্ষিত হতো।
মোগল ইতিহাসে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠান দেখতে পাই। আসাফ খানের (নূরজাহানের ভাইয়ের) মেয়ে আরজুমান্দ বানু বেগমের সঙ্গে শাহযাদা খুররমের (শাহজাহান) বিয়ে ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। মূল বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে, সম্রাট জাহাঙ্গির তার স্ত্রীদের নিয়ে আসাফ খানের বাড়িতে গেলে সেখানে একটি ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর জাহাঙ্গির আরও একবার আসাফ খানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা বের করা হয়েছিল এবং শোভাযাত্রা থেকে লোকেদের উপহার বিতরণ করা হয়েছিল। রাতের আকাশ আলোকিত করে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়েছিল। উৎসবটি চলেছে প্রায় এক মাস।
আরেকটি জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে ছিল শাহজাহানের বড় ছেলে দারা শিকোহ্র সঙ্গে শাহজাহানের সৎভাই শাহযাদা পারভেজের মেয়ে নাদিরা বেগমের। এই বিয়ে মুমতাজ মহল বেঁচে থাকতেই ঠিক করেছিলেন; কিন্তু অকালমৃত্যুর কারণে তিনি সেটা দেখে যেতে পারেননি। এই বিয়ের আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব পড়েছিল শাহযাদি জাহান আরার ওপর। ২৪ নভেম্বর ১৬৩২ তারিখে এক লক্ষ টান্কার জিনিসপত্র ও আরও নগদ অর্থ প্রথম উপহার হিসেবে শাহযাদা পারভেজের বিধবা স্ত্রী জাহান বানু বেগমের প্রাসাদে পাঠানো হয়েছিল। উপহারের প্রায় অর্ধেকই ছিল অলংকার; বাকি অর্ধেক ছিল মূল্যবান জিনিস ও পোশাক। এর প্রায় দুমাস পর (২৫ জানুয়ারি ১৬৩৩) আগ্রা দুর্গের দিওয়ান-ই-আমে জাহান আরা বেগম ও সাতি-উন-নিসা খানুম বিয়ের উপহারের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। রাজপরিবারের শাহযাদা, শাহযাদি এবং অভিজাতদের স্ত্রী ও কন্যাদের শত শত সম্মানসূচক পোশাক দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য দামি পোশাক ও অলংকারও উপহার দেওয়া হয়েছিল। হিনাবন্দী অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১১ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে। এ উপলক্ষে শাহজাহান হারেমে নাচ ও গান পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সম্মতি দিয়েছিলেন, যা মুমতাজ মহলের মৃত্যুর কারণে আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো আগ্রা আলো ও আতশবাজি দিয়ে আলোকিত করা হয়েছিল। পরের দিন অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে মোট ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১৬ লাখ টাকা জাহান আরা বেগম একাই দিয়েছিলেন। আর মুমতাজ মহলও কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন এই উদ্দেশ্যে।
আবারও জাহান আরা বেগম তার দ্বিতীয় ভাই শাহযাদা সুজার সঙ্গে মির্যা রুস্তম সাফাভির মেয়ের বিয়ের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ শুক্রবার রাতে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। মির্জা রুস্তমের প্রাসাদে ১ লাখ ৬০ হাজার টান্কা নগদ ও এক লক্ষ টান্কার জিনিসপত্র উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারি জাহান আরা ও সাতি-উন-নিসা ১০ লক্ষ টান্কার বিয়ের উপহারসামগ্রীর প্রদর্শনী করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও জাহান আরা, শাহ সুজার মেয়ে জাহান্যিব বানুর সঙ্গে আওরঙ্গযিবের ছেলে মুহাম্মাদ আযমের বিয়ের দায়িত্বেও ছিলেন। আওরঙ্গযিবের মেয়ে যুবদাৎ-উন-নিসার সঙ্গে দারা শিকোহ্র ছেলে সিফির শুকোহ্র বিয়ের দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহানের আরেক মেয়ে গাওহার বেগম; মুইয-উদ-দিনের সঙ্গে সাইয়্যিদ-উন-নিসার বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন যিনাৎ-উন-নিসা। কিন্তু এই উৎসবগুলোর খাবারের তালিকা কোনো কারণে উল্লেখ করেননি ইতিহাসের বর্ণনাকারীরা। হয়তোবা খাবারের মতো গৌণ বিষয় নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না!
শেষ সম্রাট হওয়ার সুবাদে বাহাদুর শাহ যাফরের দরবারের বেশ কিছু বর্ণনা মেলে ১৮৫৭ সালের পরপর লেখা কিছু বইয়ে। সেখান থেকে তার কিছু ভোজোৎসবের আলাপের সূত্র মেলে। তেমনই একটি বই ‘বাযম-ই-আখির’ (আভিধানিক অর্থ ‘শেষ সমাবেশ’)। এই বইয়ের লেখক মুনশি ফাইযুদ্দিন দেহল্ভি ছিলেন বাহাদুর শাহ যাফরের শ্বশুর মির্যা ইলাহি বাক্শের পরিচারক। এই বইয়ে বহু দরবারি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন এবং সেই অনুষ্ঠানগুলোর ভোজের বিবরণ রয়েছে। কিন্তু এখানেও অনুপস্থিত বিয়ের খাবার। তারপরও আমরা একটি চিত্র পাই ভোজগুলোর। ধারণা করা যেতে পারে, বিয়ের কিছু নির্দিষ্ট রীতি ছাড়া খাবারগুলো মোটামুটি একই রকম ছিল। তো কেমন হতে পারে বাহাদুর শাহ যাফরের সময়কার উৎসবের ভোজ? এই ভোজের বর্ণনার সময়ে মাথায় রাখা প্রয়োজন, তত দিনে গুরকানিদের সূর্য ডুবে গিয়েছিল; সিংহাসনে কে বসবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিত ব্রিটিশ বেনিয়ারা; সম্রাটের মাসিক ভাতা বরাদ্দ ছিল কোম্পানি থেকে—যেটাকে বাড়ানোর জন্য সম্রাট বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন। সেই দুর্দিনেও বাহাদুর শাহ যাফরের ভোজের তালিকা ছিল ভয়াবহ ধরনের বিলাসী। রসুইঘরের পরিচারিকারা সাত গজ লম্বা ও তিন গজ চওড়া চামড়ার টুকরো বিছিয়ে তার ওপরে রাখতেন সাদা কাপড় এবং হাতে বোনা পাতলা গালিচা; তার ওপরে রাখা হতো নকশা করা দস্তরখান। আর তার মধ্যিখানে, দুই গজ লম্বা, দেড় গজ চওড়া ও ছয় আঙুল উঁচু কাঠের টেবিল রাখা হতো। সিল করা খাবারগুলো এই টেবিলে রাখার আগে আরেক প্রস্থ চামড়া ও টেবিলের আচ্ছাদন রাখা হতো। এরপর খাবার পরিবেশন করা হতো। খাওয়ার শুরুতে পরিবেশন করা হতো বিভিন্ন ধরনের ফল—মাল্টা, শরিফা, পেয়ারা, আনার আর অন্য সব মৌসুমি ফল। এরপর পরিবেশিত হতো শিঙাড়া, মিষ্টি নিমকি, শাখেই, মিষ্টি খাজা, বিভিন্ন ধরনের বরফি। সঙ্গে থাকত তিন-চার ধরনের নানখাটাই। এরপর মূল খাবারে থাকত বিভিন্ন ধরনের রুটি—চাপাতি, ফুলকা, পরোটা, রোগনি রুটি, বিরি রুটি, বেসনি রুটি, খামিরি রুটি, নান, শিরমাল, গাও দিদা, গাও যাবান, কুলচা, বাকরখানি, গাউসি রুটি, বাদামের রুটি, পিস্তার রুটি, চালের রুটি, গাজরের রুটি, মিছরির রুটি, নান পানাব্বা, নান গুলযার, নান কিমাশ, নান তিনকি। সঙ্গে থাকত বিভিন্ন ধরনের পোলাও—আখনি, নূর মহলি, নুকতি, নার্গিসি, কিশমিশ, যামারুদ্দি, লাল, মুযাফফার, ফলসাইয়ি, আবি, সোনালি, রুপালি, মুর্গ, বাইযা, আনানাস, কোফতা, চিলাও, আস্ত বকরির কা পুলাও, বুট পুলাও, শোলা খিচুড়ি, কাবুলি, তাহেরি, মুতানজান, জর্দা মুযাফার। এসব খাওয়ার সহযোগী হিসেবে দস্তরখানে থাকত মাংসের বিভিন্ন পদ—কোরমা, কালিয়া, দোপেয়াজা, হরিণের কোরমা, মুরগির কোরমা এবং মাছের বিভিন্ন পদ। কাবাবের ভেতরে থাকত শিক কাবাব, শামি কাবাব, গোলি কাবাব, তিতির কাবাব, বটের কাবাব, নুকতি কাবাব, খাটাই কাবাব, হুসাইনি কাবাব। পাতের পাশের জন্য থাকত বিভিন্ন ধরনের চাটনি, আশ, দই বড়া, বেগুনভর্তা, আলুভর্তা, ছোলার ডালের ভর্তা, আলুর দোলমা, বেগুনের দোলমা, করলার দোলমা, বাদশাহ পাসান্দ করলা, বাদশাহ পাসান্দ ডাল আর দই দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পদ—বুরানি (আমাদের বোরহানি নয়; বেগুন আর দই দিয়ে তৈরি পদ), রাইতা, শসার দোগ, ফুটির দোগ। আলাদা করে দেওয়া হতো বিভিন্ন ধরনের মোরব্বা ও আচার—আম, আপেল, পেয়ারা, জাম্বুরা, করলা, লেবু, আনারস, বাঁশ-কোড়ল ইত্যাদি। মিষ্টি ও মিষ্টান্নের তালিকা দীর্ঘ—সেমাই, মান ও সালওয়া, ফিরনি; বিভিন্ন পদের ক্ষীর—বাদামের ক্ষীর, কদুর ক্ষীর, গাজরের ক্ষীর, কাউনের ক্ষীর, ইয়াকুতি, নিমাশ, দুধের দোলমা, বাদামের দোলমা। হালুয়া ছিল নানা ধরনের—লাউজিয়াত রাভে কা হালুয়া, গাজর, লাউ, মালাই, বাদাম, পিস্তা, মাল্টা, সোহান, পাপড়ি, গোন্দ হালুয়া, হাবশি হালুয়া। মিষ্টান্ন থাকত মতিচুর লাড্ডু, মুগ, বাদাম ও পিস্তার লাড্ডু, মালাই লাড্ডু, দুধ মিঠাই, পিস্তা মিঠাই, বাদাম মিঠাই, জাম মিঠাই, মাল্টা মিঠাই, ফলসা মিঠাই, পেঠা মিঠাই, পিস্তা মাগজি, আমৃতি, জিলাপি, ফিরনি, কালাকান্দ, মোতি পাক, দার বাহিস্ত, বালুশাহি, আন্দারসার গোলিয়াঁ ইত্যাদি।

বাবুর দক্ষিণ মাদ্রাসায় খাবার গ্রহণ করছেন

এ তো গেল বাহাদুর শাহ যাফরের খাবারের বর্ণনা। কিন্তু এই যে মহান গুরকানিদের খাবারের বর্ণনায় ভোজের আয়োজনের বিশেষত বিয়ের ভোজের বর্ণনার অপ্রতুলতা কেন? এর কারণ লুকিয়ে আছে গুরকানিদের পরবর্তী পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসে। গুরকানিরা স্বীকার করুক আর না করুক, তারা বৃহত্তর মোঙ্গল গোত্রেরই তো অংশ। মোঙ্গলদের আদি ইতিহাসে, এমনকি হুমায়ুন পর্যন্ত, আমরা নারী স্বাধীনতার যে প্রকৃতি দেখি, তাতে দেখা যায় নারীরা সম্রাটদের চলমান কাফেলার অংশ। এই নারীরা মধ্য-এশিয়ার কিছু রীতি-নীতি পালন করতেন, যেগুলোর মধ্যে ছিল গুরকানি হারেমের নারীদের রহস্যময় উৎসব এবং সম্রাট আর শাহযাদাদের বিয়ের আয়োজনও। সম্ভবত হারেমের ভেতরে থাকা নারীদের ভেতরকার অনুশীলন বলেই সেগুলো ইতিহাসে ঠিকঠাক উঠে আসেনি। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতে যিব-উন-নিসা বা রওশন আরা, জাহান আরা বা অন্য কারও কোনো লেখা আবিষ্কার হবে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসবে গুরকানি তথা মোগল বিয়ের ভোজের বর্ণনা।
দায় স্বীকার: আবদুল হামিদ লাহোরি, ‘পাদশাহ নামা’; মুহাম্মাদ আমিন কাযুইনি, ‘পাদিশাহ নামা’; ইনায়াত খান, ‘শাহ জাহান নামা’; সাকি মুস্তাইদ খান, ‘মাসির-ই-আলমগিরি’; এন এল মাথুর, ‘রেড ফোর্ট অ্যান্ড মুঘল লাইফ’; বি পি সাক্সেনা, ‘হিস্ট্রি অব শাহজাহান অব দিল্লি’; যদুনাথ সরকার, ‘স্টাডিজ ইন মুঘল ইন্ডিয়া’; আর নাথ, ‘প্রাইভেট লাইফ অব দ্য মুঘলস অব ইন্ডিয়া’; সোমা মুখার্জি, ‘রয়্যাল মুঘল লেডিজ অ্যান্ড দেয়ার কন্ট্রিবিউশনস’; রুবি লাল, ‘ডোমেস্টিসিটি অ্যান্ড পাওয়ার ইন দ্য আর্লি মুঘল ওয়ার্ল্ড’; ইরা মুখোতি, ‘ডটার্স অব দ্য সান’; আল মারুফ রাসেল, ‘দিল্লি: চার উপাখ্যান’

চিত্রকর্ম: দিল্লি মিউজিয়াম থেকে লেখকের তোলা ছবি এবং সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top